ব্যাংকে গতিময়তা

সফটওয়্যারের জন্য দরকারি ইলেকট্রনিকস যন্ত্রও তৈরি করে বিজনেস অটোমেশন। ছবি: সংগৃহীত
সফটওয়্যারের জন্য দরকারি ইলেকট্রনিকস যন্ত্রও তৈরি করে বিজনেস অটোমেশন। ছবি: সংগৃহীত

ব্যাংকের কাউন্টারে টাকা জমা দিতে ও ওঠাতে গ্রাহকদের লম্বা সারি। প্রায়ই সেই সারি বড় হতে হতে সড়কের ফুটপাতে পৌঁছায়। মাঝেমধ্যেই লাইনে দাঁড়ানো নিয়ে গ্রাহকদের মধ্যে বচসাও হচ্ছে। কাউন্টারের দৈনন্দিন সেবায় শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক কর্তৃপক্ষ দেশীয় একটি সফটওয়্যার প্রতিষ্ঠানের কাছে যায়।

ঘটনাটি ২০০৫ সালের। বর্তমানে দেশের অনেক ব্যাংকের কাউন্টারেই ডিজিটাল টোকেন ব্যবহার হচ্ছে। ব্যাংকের শাখায় আগের মতো লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে হয় না গ্রাহকদের। বরং শাখায় প্রবেশের সময় একটি টোকেন নিয়ে নির্দিষ্ট আসনে গিয়ে বসেন। ডিজিটাল পর্দায় কোন কাউন্টারে কত নম্বর টোকেনধারী সেবা নিতে যাবেন তা ভেসে ওঠে। পাশাপাশি ঘোষণাও দেওয়া হয়। সেটি দেখে বা শুনে গ্রাহক নির্দিষ্ট কাউন্টারে যান এবং সেবা নিয়ে থাকেন।

স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংকের কাছ থেকে প্রস্তাব পেয়ে টোকেন পদ্ধতির সফটওয়্যারটি প্রস্তুত করে বিজনেস অটোমেশন। প্রতিষ্ঠানটির বানানো এই ‘কিউ প্রো’ নামের সফটওয়্যারটি বর্তমানে ১৫টি বেসরকারি ব্যাংকের পাশাপাশি হাসপাতাল, টেলিকম প্রতিষ্ঠানের গ্রাহকসেবা কেন্দ্র ও সরকারের ওয়ান স্টপ সার্ভিস সেন্টারে ব্যবহৃত হচ্ছে। সব মিলিয়ে ৮০০ প্রতিষ্ঠান ও শাখা প্রতিদিন কিউ প্রোর মাধ্যমে গ্রাহকদের সেবা দিচ্ছে। প্রতিষ্ঠানটির দাবি, দেশের যেসব জায়গায় টোকেন পদ্ধতি ব্যবহৃত হচ্ছে, তার ৭০ শতাংশই বিজনেস অটোমেশনের।

দেশের পাশাপাশি বিজনেস অটোমেশনের কিউ প্রো সফটওয়্যার ভারত, ডোমেনিকান রিপাবলিক ও আর্জেন্টিনার সার্ভিস সেন্টারে ব্যবহৃত হচ্ছে। প্রতিষ্ঠানটির ভাইস প্রেসিডেন্ট অ্যান্ড হেড অব বিজনেস এস এম রাশিদুল হাসান বলেন, ‘স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক বাংলাদেশের হাত ধরেই ২০১১ সালে ভারতে কিউ প্রো পৌঁছায়। বর্তমানে সেখানকার স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক ও পাঞ্জাব ন্যাশনাল ব্যাংক এবং বুরগাঁও সিটি করপোরেশনে কিউ প্রো ব্যবহৃত হচ্ছে। ভারতের অন্যান্য আইটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে আমরা এই কাজটি পেয়েছি।’

শুরুর দিকের কথাও বললেন এস এম রাশিদুল হাসান। তিনি বলেন, ‘স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক তাদের শাখাগুলোর কাউন্টারের শৃঙ্খলা ফেরানোর চিন্তাভাবনা করছিল। তারাই প্রথম আমাদের কাছে সমস্যাটি নিয়ে আসে। তারা আমাদের ছয় মাস সময় দিয়েছিল। তবে আমরা তিন মাসেই সফটওয়্যারটি তৈরি করেছিলাম। পরে অবশ্য অনেক বিষয় আমরা উন্নত করেছি। তবে ২০০৯ সাল থেকে কিউ প্রো বাংলাদেশে জনপ্রিয় হতে শুরু করে।’

কিউ প্রো সফটওয়্যার ব্যবহারের ফলে একদিকে গ্রাহকদের হয়রানি কমেছে; অন্যদিকে প্রতিষ্ঠানগুলো সহজেই বেশ কিছু তথ্য–উপাত্ত পেয়ে যাচ্ছে। যেমন—কোন কর্মী সারা দিনে কত গ্রাহককে সেবা দিয়েছেন। কোন কর্মী দ্রুত ও কোন কর্মী সেবা দিতে বেশি সময় নিচ্ছেন। এসব তথ্য বিশ্লেষণ করে প্রতিষ্ঠান কর্মীদের দক্ষতা কিংবা কাউন্টারের সংখ্যা বৃদ্ধির মতো গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিতে পারে—এমনটাই জানালেন এস এম রাশিদুল হাসান।

ডিজিটাল সেবা সাধারণ মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিতে ১৯৯৮ সালে বিজনেস অটোমেশনের যাত্রা শুরু হয়। বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটিতে কাজ করেন ১৬০ জন কর্মী। প্রতিষ্ঠানটির মূল উদ্যোক্তা দুজন—জাহিদুল হাসান ও শোয়েব আহমেদ। তা ছাড়া অংশীদার আছেন আরও পাঁচজন।

কিউ প্রো বড় সাফল্য হলেও বর্তমানে বিভিন্ন ধরনের প্রযুক্তিপণ্য উৎপাদন করছে বিজনেস অটোমেশন। গাজীপুরের কালিয়াকৈরে বঙ্গবন্ধু হাইটেক সিটিতে নিজেদের কারখানায় ডিজিটাল সাইনবোর্ড তৈরি হচ্ছে, যা বড় ব্র্যান্ডের বিক্রয়কেন্দ্র ও করপোরেট অফিসে দেখা যায়। তা ছাড়া ইনফরমেশন কিওসক, কাস্টমার ফিডব্যাক ডিভাইস, এলইডি ডিভাইস ইত্যাদি উৎপাদন করছে প্রতিষ্ঠানটি। শুরুতে টোকেন পদ্ধতির অনেক হার্ডওয়্যারসামগ্রী আমদানি করা হলেও বর্তমানে দেশেই উৎপাদন করছে তারা।

উড়োজাহাজের যাত্রীদের জন্য অনলাইনে চেক–ইন করে বোর্ডিং পাস নেওয়ার যন্ত্র ও সফটওয়্যার তৈরি করেছে বিজনেস অটোমেশন। তাদের তৈরি করা চারটি হেলথ কার্ড কিওসক সৌদি আরবে ব্যবহৃত হচ্ছে। সেই যন্ত্রের সাহায্যে বাংলাদেশি হাজিরা নিজেদের মেডিকেল হিস্ট্রি এক নিমেষে প্রিন্ট করে নিতে পারেন। তাতে অসুস্থ হাজিদের চিকিৎসা দ্রুত শুরু করা যায়।

জানতে চাইলে বিজনেস অটোমেশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) জাহিদুল হাসান প্রথম আলোকে বলেন, ‘টোকেন সিস্টেমের সাফল্যের অনুপ্রেরণা থেকেই আমরা সফটওয়্যারের পাশাপাশি হার্ডওয়্যার উৎপাদন শুরু করেছি। বঙ্গবন্ধু হাইটেক সিটিতে গত বছর আমাদের কারখানায় উৎপাদন শুরু করেছি। সেসব হার্ডওয়্যার দেশের বাজারের পাশাপাশি ভবিষ্যতে বিদেশিও রপ্তানি করার পরিকল্পনা রয়েছে আমাদের।’ তিনি আরও বলেন, ‘প্রতিষ্ঠানটির জন্মলগ্ন থেকেই আমরা তথ্যপ্রযুক্তিপড়ুয়া শিক্ষার্থীদের জন্য কর্মসংস্থানব্যবস্থার চেষ্টা করছি। সেটি ভবিষ্যতেও অব্যাহত থাকবে।’