করোনা নিয়ে দুশ্চিন্তায় দেশের উদ্যোক্তারা

করোনাভাইরাস। প্রতীকী ছবি
করোনাভাইরাস। প্রতীকী ছবি

চীনে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে করোনাভাইরাস। দেশটির অধিকাংশ কারখানা ও অফিস বন্ধ। তাদের পণ্য সরবরাহব্যবস্থা ভেঙে পড়ার উপক্রম। সেটির প্রভাব ইতিমধ্যে বাংলাদেশের ব্যবসা-বাণিজ্যেও পড়তে শুরু করেছে। চীন থেকে আমদানি করা কাঁচামাল সময়মতো পাওয়া নিয়ে শঙ্কায় আছেন রপ্তানিকারকেরা। চীনে বাংলাদেশি পণ্য রপ্তানি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার শঙ্কাও প্রবল।

করোনাভাইরাস নিয়ে বড় ধরনের ব্যবসায়িক ক্ষতির আশঙ্কায় আছেন তৈরি পোশাক, চামড়া ও পাট সুতাসহ বিভিন্ন পণ্যের রপ্তানিকারকেরা। তবে আমদানিকারকেরা বলছেন, নববর্ষের ছুটির কারণে চীনা ব্যবসায়ীদের সঙ্গে তাঁদের যোগাযোগ হয়নি। ছুটি শেষ হলে অবস্থা বোঝা যাবে। তবে করোনাভাইরাসের কারণে ছুটির সময় বাড়লে পরিস্থিতি জটিল হবে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যানুযায়ী, চীন থেকে সবচেয়ে বেশি কাঁচামাল, যন্ত্রপাতি, প্রস্তুত পণ্য আমদানি করে বাংলাদেশ। গত ২০১৮-১৯ অর্থবছরে চীন থেকে ১ লাখ ১৪ হাজার কোটি টাকার পণ্য আমদানি হয়েছে, যা মোট আমদানির ২৬ শতাংশের বেশি।

করোনাভাইরাসের কারণে বেশি দুশ্চিন্তায় পড়েছেন পোশাকশিল্পের মালিকেরা, বিশেষ করে যাঁরা ওভেন পোশাক রপ্তানি করেন। কারণ, ওভেন পোশাকের ৬০-৬৫ শতাংশ কাপড় আমদানি হয়, যার একটি বড় অংশ চীন থেকে আসে।

জানতে চাইলে ক্ল্যাসিক গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. শহিদউল্লাহ আজিম গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘চীনে আমাদের প্রতিষ্ঠানের কাপড়ের সাত–আটটি কনসাইনমেন্ট আছে। এগুলোর মধ্যে কিছু উৎপাদন স্তরে এবং কিছু জাহাজীকরণের পর্যায়ে রয়েছে। তবে চীনে আমাদের সরবরাহকারীদের সঙ্গে আমরা কথাই বলতে পারছি না। নববর্ষের ছুটি ও করোনাভাইরাসের কারণে তাদের কারখানা ও অফিস বন্ধ।’ তিনি বলেন, ‘আমরা খুবই শঙ্কার মধ্যে আছি। কারণ, সময়মতো কাপড় না এলে কারখানায় উৎপাদন হবে না। পণ্য জাহাজীকরণে বিলম্ব হবে। তখন ক্রেতাকে মূল্যছাড় দিতে হবে অথবা বিমানে পণ্য পাঠাতে হবে।’

বিকল্প কোনো ব্যবস্থা আছে কি না জানতে চাইলে শহিদউল্লাহ আজিম বলেন, ‘দেশের বস্ত্রকলে সব ধরনের কাপড় উৎপাদিত হয় না। তা ছাড়া চীনের চেয়ে আমাদের দেশের কাপড়ের দাম বেশি। চীনা কাপড়ের দাম ধরেই পোশাকের ক্রয়াদেশ নেওয়া হয়েছে।’

বিদায়ী ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৩ হাজার ৪১৩ কোটি মার্কিন ডলারের পোশাক রপ্তানি হয়েছে। তার জন্য কাঁচামাল আমদানি হয়েছে ১ হাজার ২১৭ কোটি মার্কিন ডলারের। আমদানি হওয়া এই কাঁচামালের বড় অংশ চীন থেকে আসছে বলে জানালেন পোশাকশিল্পের মালিকেরা।

যোগাযোগ করা হলে তুসুকা ফ্যাশনসের চেয়ারম্যান আরশাদ জামাল বলেন, ‘১৬ কনটেইনার কাপড় নিয়ে আমরা দুশ্চিন্তায় আছি। সময়মতো কাপড় না এলে এপ্রিল ও মে মাসে কারখানার উৎপাদন ভয়াবহভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। চীনে আমাদের নিজস্ব অফিস থাকার পরও চীনা সরবরাহকারীদের সঙ্গে আমরা যোগাযোগ করতে পারছি না।’

আরশাদ জামাল তৈরি পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর সহসভাপতি। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, পোশাকশিল্পে বর্তমানে চ্যালেঞ্জিং সময় যাচ্ছে। তার মধ্যে নতুন করে আতঙ্ক ছড়াচ্ছে করোনাভাইরাস। পুরো বিষয়টি অনুধাবন করতে হবে—সরবরাহব্যবস্থা ভেঙে পড়লে সবাই ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তাই বন্দর কর্তৃপক্ষ, এনবিআরসহ সংশ্লিষ্ট দপ্তরকে আমদানি ও রপ্তানির পণ্য দ্রুত খালাস ও জাহাজীকরণে কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে।

পোশাকের মতো চামড়া রপ্তানিকারকেরাও আছেন বিপাকে। সাভারের হেমায়েতপুরে চামড়াশিল্প নগরে কেন্দ্রীয় বর্জ্য পরিশোধনাগার (সিইটিপি) চালু না হওয়ায় ইউরোপের ক্রেতারা সরাসরি বাংলাদেশ থেকে চামড়া কেনে না। বর্তমানে দেশের ৭০ শতাংশ চামড়ার ক্রেতাই হচ্ছে চীনারা। গত বছর ১৬ কোটি ডলারের চামড়া রপ্তানি হয়েছিল।

বাংলাদেশ ফিনিশড লেদার, লেদারগুডস অ্যান্ড ফুটওয়্যার এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিএফএলএলএফইএ) চেয়ারম্যান মহিউদ্দিন আহমেদ গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, প্রতিটি কারখানায় ফিনিশড চামড়ার স্তূপ জমা হয়ে আছে। চীনারা আমদানি স্থগিত রেখেছে। করোনাভাইরাসের সমস্যাটি দ্রুত সমাধান না হলে চামড়া খাতে ভয়াবহ বিপর্যয় নামবে।

চলতি ২০১৯-২০ অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে ৩১ কোটি ডলারের পাটের সুতা রপ্তানি হয়েছে। পাটসুতার বড় ক্রেতা তুরস্ক। দ্বিতীয় অবস্থানে আছে চীন। দেশটি ৪ কোটি ৬১ লাখ ডলারের পাটসুতা আমদানি করেছে। ১ কোটি ১৬ লাখ ডলারের কাঁচা পাটও কিনেছেন দেশটির ব্যবসায়ীরা। ফলে করোনাভাইরাসের কারণে পাট খাতেও নেতিবাচক প্রভাব পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। অবশ্য জুট স্পিনার্স অ্যাসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান জাহিদ মিয়া বলেন, চীনাদের অনেক ক্রয়াদেশ পাটকলে আছে। নববর্ষের ছুটি শেষ হলে পরিস্থিতি বোঝা যাবে।

চীন থেকে রসুন ও আদা আমদানি করেন শ্যামবাজারকেন্দ্রিক আমদানিকারক আবদুল মাজেদ। তিনি বলেন, ‘নববর্ষের পর আজ চীনের অফিস খোলার কথা। শুনেছি এখন সেই ছুটি বাড়িয়ে ১০ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত করা হয়েছে। আমাদের কাঁচামালের মধ্যে যেগুলোর জাহাজীকরণ হয়েছে, সেগুলো নথিপত্র আসেনি। নথি না এলে পণ্য খালাস করা যাবে না। তাই বিষয়টি নিয়ে আমরা দুশ্চিন্তায় আছি।’ অবশ্য ইতিমধ্যে দেশের বাজারে চীনা রসুনের দাম বেড়েছে। কয়েক দিন আগে দেড় শ টাকা কেজি দরে বিক্রি হলেও এখন তা ১৮০-২০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।