খেলাপির হারে বাংলাদেশ শীর্ষে

প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই বলে আসছেন, দেশের ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ আর বাড়বে না। কয়েকবারই এ কথা বলেছেন তিনি। কিন্তু বাস্তবে ঘটছে উল্টোটা। যেমন ২০১৮ সাল শেষে যেখানে মোট খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ৯৩ হাজার ৯১১ কোটি টাকা, সেখানে ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বর মাসে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ১৬ হাজার ২৮৮ কোটি টাকা। অর্থাৎ ৯ মাসে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ২২ হাজার ৩৭৭ কোটি টাকা।

এদিকে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) বলছে, প্রকৃত অর্থে বাংলাদেশে খেলাপি ঋণের পরিমাণ আরও অনেক বেশি।

কাহিনি এখানেই শেষ নয়, এবার বিশ্বব্যাংকের ‘গ্লোবাল ইকোনমিক প্রসপেক্টস’ শীর্ষক প্রতিবেদন থেকে জানা গেল, ২০১৯ সালের প্রাক্কলিত হিসাব অনুযায়ী দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশেই খেলাপি ঋণের হার সবচেয়ে বেশি—১১ দশমিক ৪ শতাংশ। এরপর দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্থানে আছে ভুটান ও আফগানিস্তান, যাদের খেলাপি ঋণের হার যথাক্রমে ১০ দশমিক ৯ ও ১০ দশমিক ৮ শতাংশ।

প্রতিবেদনে অবশ্য বলা হয়েছে, শুধু বাংলাদেশ নয়, পুরো দক্ষিণ এশিয়ার অর্থনৈতিক অবস্থাই খারাপ। গত ছয় মাসে অবস্থা খারাপ হয়েছে। দেশগুলোর আর্থিক খাত এখন চ্যালেঞ্জের মুখে। যে কারণে বিনিয়োগকারী ও ভোক্তাদের আস্থা কমে যাচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে দক্ষিণ এশিয়ায় ব্যক্তিপর্যায়ের ভোগ ও বিনিয়োগ কমছে।

বিশ্বব্যাংকের ধারণা, দক্ষিণ এশিয়ার অর্থনীতিতে ঝুঁকি আরও বাড়বে। ঝুঁকির মূল কারণগুলো হচ্ছে আর্থিক খাতের দুরবস্থা, ভূরাজনৈতিক উত্তেজনা ও সংস্কারের ধীরগতি। ভারত ও পাকিস্তানের সাম্প্রতিক উত্তেজনা কমে এলেও তা যদি আবারও বাড়ে, তাহলে এই অঞ্চলের বিনিয়োগ ব্যাহত হবে।

বাংলাদেশে খেলাপি ঋণ বাড়লেও চলতি ২০১৯-২০ অর্থবছরসহ পরবর্তী অর্থবছরেও মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) প্রবৃদ্ধির হার ৭ শতাংশের ওপরেই থাকবে বলে পূর্বাভাস দিয়েছে বিশ্বব্যাংক। সংস্থাটির মতে, বাংলাদেশের আর্থিক খাত নাজুক হলেও সামষ্টিক অর্থনৈতিক কাঠামো সংহত, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বিদ্যমান, মেগা প্রকল্পগুলো বাস্তবায়িত হচ্ছে এবং ব্যবসার পরিবেশ সংস্কারেও পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। ফলে এ দেশে প্রবৃদ্ধির হার ৭ শতাংশের ওপরেই থাকবে। 

তবে রাজস্ব কাঠামোর সংস্কারে তেমন অগ্রগতি না থাকায় শ্রীলঙ্কার মতো বাংলাদেশেও রাজস্ব ঘাটতি আরও বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে প্রতিবেদনে। এতে অবকাঠামো খাতে বিনিয়োগ করা কঠিন হয়ে উঠবে, যার প্রভাব পড়বে প্রবৃদ্ধিতে।

অন্যদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরো অঞ্চলে প্রত্যাশার চেয়ে বেশি প্রবৃদ্ধি হলে দক্ষিণ এশিয়ার বাণিজ্য, আর্থিক খাত ও আস্থায় ইতিবাচক
প্রভাব পড়বে।

সহায়ক অবকাঠামোর অভাব অনেক ক্ষেত্রে বড় বাধা হয়ে ওঠে। প্রতিবেদনটি তৈরি করতে গিয়ে বিশ্বব্যাংক বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যোগাযোগ করেছে। তারা জানিয়েছে, পাকিস্তান ও বাংলাদেশে তাদের উৎপাদনশীলতা কম। ঋণ পাওয়াও অনেক ক্ষেত্রে কঠিন। কারণ হিসেবে তারা বলেছে, দক্ষিণ এশিয়ায় ব্যাংকিং খাতের সম্পদ মূলত রাষ্ট্রীয় ব্যাংকের হাতে, ভারতে যা প্রায় ৭০ শতাংশ। আর খেলাপি ঋণ বৃদ্ধি পাওয়ার মতো বিষয় তো আছেই। বাংলাদেশের বেলায় ব্যাংকিং খাত থেকে সরকারের ঋণ নেওয়ার পরিমাণ বেড়ে যাওয়াটা বেসরকারি খাতের জন্য বড় প্রতিবন্ধকতা হিসেবে কাজ করে। সরকার অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসেই ব্যাংকিং খাত থেকে পুরো বছরের লক্ষ্যমাত্রার প্রায় সমান ঋণ নিয়ে ফেলেছে।

ভারতের অবস্থা

>বিশ্বব্যাংকের ‘গ্লোবাল ইকোনমিক প্রসপেক্টস’ শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আর্থিক খাতের দুর্বলতা দক্ষিণ এশিয়ার জন্য অন্যতম ঝুঁকি।

চলতি ২০১৯-২০ অর্থবছরে দক্ষিণ এশিয়ার সার্বিক জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার কমে ৪ দশমিক ৯ শতাংশে নেমে আসবে বলে প্রাক্কলন করেছে বিশ্বব্যাংক। মূলত অভ্যন্তরীণ চাহিদা কমে যাওয়ার কারণেই এমনটা হবে। ভারতে খেলাপি ঋণ বেড়ে যাওয়ার কারণে ব্যাংকগুলো অতি সতর্ক। ফলে ঋণ কমে গেছে। এতে ব্যক্তিপর্যায়ের ভোগও কমেছে। ফলে দক্ষিণ এশিয়ার প্রবৃদ্ধিতে প্রভাব পড়ছে।

বিশ্বব্যাংক মনে করে, ভারতে ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক খাতের ঋণপ্রবাহের দুর্বলতা দীর্ঘায়িত হতে পারে। চলতি অর্থবছরের (এপ্রিল ২০১৯-মার্চ ২০২০) শেষ দিকে দেশটির জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার কিছুটা বাড়তে পারে, যদিও অর্থবছরের প্রথম ভাগে শ্লথগতি দেখা গেছে। সংস্থাটির পূর্বাভাস অনুযায়ী এবারে দেশটিতে ৫ শতাংশের মতো প্রবৃদ্ধি হবে। আর ২০২১-২২ অর্থবছরে তা বেড়ে ৬ দশমিক ১ শতাংশে উন্নীত হতে পারে। রাজস্ব ও কাঠামোগত সংস্কারের কারণে তারা বর্তমান পরিস্থিতি কাটিয়ে উঠবে বলে ধারণা করছে বিশ্বব্যাংক।

শিক্ষা নেওয়া

ভারতে কয়েক বছর ধরে প্রবৃদ্ধি কমছে। এর অন্যতম কারণ হচ্ছে আর্থিক খাতের বিশৃঙ্খলা। এই পরিস্থিতিতে অন্যদের সতর্ক হওয়া উচিত বলে মনে করেন বাংলাদেশের গবেষণা সংস্থা সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান। তিনি বলেন, ভারত থেকে শিক্ষা নেওয়া উচিত। বাংলাদেশের আর্থিক খাত যে পরিস্থিতিতে আছে এবং খেলাপি ঋণ যে হারে বাড়ছে, তা উন্নত দেশ হওয়ার লক্ষ্যমাত্রার সঙ্গে সাংঘর্ষিক।

গতকাল সন্ধ্যায় সেলিম রায়হান প্রথম আলোকে বলেন, ‘খেলাপি ঋণ আর বাড়বে না—এ কথা আমরা কয়েকবারই শুনেছি। কাজের কাজ তো কিছু হয়নি, বরং খেলাপি ঋণ আরও বেড়েছে। অন্যদিকে ব্যাংক খাত থেকে সরকারের ঋণ নেওয়ার পরিমাণ এত বেড়ে গেছে যে ব্যক্তি খাতের ঋণপ্রবাহ এখন ১১ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। আর্থিক খাতে সুশাসনের অভাব প্রকট। দেশে বিশেষ কিছু গোষ্ঠীর স্বার্থ সংরক্ষিত হচ্ছে।’

অন্যদিকে সুদের হার যেভাবে চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে, তাতে উল্টো ফল হতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেন সেলিম রায়হান। এ নিয়ে গভীরভাবে চিন্তিত হওয়ার অবকাশ আছে জানিয়ে তিনি বলেন, নীতিপ্রণেতাদের মধ্যে ‘সিরিয়াসনেসের’ ঘাটতি রয়েছে।

এদিকে খেলাপি ঋণের দিক থেকে দক্ষিণ এশিয়ায় চতুর্থ স্থানে আছে ভারত। দেশটির খেলাপি ঋণের হার এখন ৮ দশমিক ৯ শতাংশ। এ ছাড়া এই হার পাকিস্তানে ৮ দশমিক ২ শতাংশ, মালদ্বীপে ৯ দশমিক ৩ শতাংশ ও শ্রীলঙ্কায় ৩ দশমিক ৬ শতাংশ।