সামাজিক উত্তরণে তলানিতে বাংলাদেশ

আপনার আর্থিক অবস্থা ভালো নয়। দেশে মানসম্পন্ন শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা সীমিত পরিসরে থাকলেও সামাজিক ও আর্থিক কারণে সেগুলোর সুবিধা নিতে পারছেন না। প্রতিযোগিতার বাজারে আপনি ধনীদের তুলনায় পিছিয়ে পড়ছেন।

তিন দশক ধরেই শিক্ষা, স্বাস্থ্য, দারিদ্র্য বিমোচনসহ বিভিন্ন সামাজিক সূচকে বেশ ভালো করছে বাংলাদেশ। প্রায় সব মহলেই প্রশংসা। কিন্তু সামাজিক উত্তরণে ধনীরাই বেশি সুবিধা পাচ্ছে, গরিবেরা তেমন পাচ্ছে না। এই চিত্র ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের (ডব্লিউইএফ) সর্বশেষ সামাজিক উত্তরণ সূচকেও উঠে এসেছে। এতে বাংলাদেশ ৮২টি দেশের মধ্যে ৭৮তম স্থানে আছে, অর্থাৎ সবার সুষম উন্নয়নের ক্ষেত্রে এখনো তলানির সারির একটি দেশ বাংলাদেশ।

গত ১৯ জানুয়ারি ডব্লিউইএফ সামাজিক উত্তরণ সূচক ২০২০ প্রকাশ করেছে। তালিকায় শীর্ষে আছে ডেনমার্ক। পরের দুটি স্থানে নরওয়ে ও ফিনল্যান্ড। বাংলাদেশের পেছনে আছে পাকিস্তান, ক্যামেরুন, সেনেগাল ও আইভরিকোস্ট। দক্ষিণ এশিয়ায় শ্রীলঙ্কা সবচেয়ে ভালো অবস্থায়, ৫৯তম। আর ভারত ও পাকিস্তান যথাক্রমে ৭৬ ও ৭৯তম।

সামাজিক উত্তরণ সূচকের মাধ্যমে কোনো দেশের মানুষের জীবনমান উন্নয়নে ধনী-গরিবনির্বিশেষে সবাই শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কর্মসংস্থানসহ মৌলিক সুবিধা কতটা পাচ্ছে, সেটা বোঝানো হয়।

এ নিয়ে অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, শিক্ষা, স্বাস্থ্যের মতো সামাজিক উত্তরণের সুবিধা গ্রহণ করার সক্ষমতা এ দেশের সবার এক রকম নয়। এর প্রধান কারণ জন্মগত বাধা। এসব সুবিধা সমানভাবে না পাওয়ায় ধনী ও গরিবের মধ্যে বিশাল বৈষম্য সৃষ্টি হয়েছে। যেমন ধনী পরিবারের সন্তানেরা শহরের ভালো স্কুলে পড়ে, মানসম্পন্ন শিক্ষা পায়। অন্যদিকে গরিবেরা তা থেকে বঞ্চিত হয়। ফলে দক্ষ মানবসম্পদ হওয়ার পথে গরিবেরা বাধার মুখে পড়ে। একই চিত্র স্বাস্থ্য খাতে। এমনকি জন্ম–পূর্ববর্তী বঞ্চনার শিকার হয় শিশুরা। গরিব ঘরের গর্ভবতী মায়েরা মানসম্পন্ন খাবার পান না, শিশুর জন্মের পর টিকাও দেওয়া হয় না। ফলে একধরনের অপুষ্টিতে ভোগে দরিদ্র পরিবারের শিশুরা। এভাবে মৌলিক সুবিধা পাওয়ার ক্ষেত্রে বৈষম্যের কারণে ধনী–গরিবনির্বিশেষে সামাজিক উত্তরণে বাংলাদেশ এত পিছিয়ে আছে।

>

দেশে ধনীরা মানসম্পন্ন সেবা নিতে পারেন, গরিবদের সুযোগ কম। সামাজিক উত্তরণে পেছনের সারিতে বাংলাদেশ।

১০টি উপসূচক দিয়ে সামাজিক উত্তরণ সূচক তৈরি করেছে ডব্লিউইএফ। এগুলো হলো স্বাস্থ্য, শিক্ষার সুযোগ, মান ও সমতা; জীবনভর শিক্ষার সুবিধা, প্রযুক্তির লভ্যতা, কাজের সুযোগ, ন্যায্য মজুরি, কাজের পরিবেশ, সামাজিক সুরক্ষা ও সরকারি সেবার বিস্তৃতি।

উপসূচকগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের সবচেয়ে খারাপ অবস্থা জীবনভর শিক্ষার সুযোগে। এ উপসূচকে ৮২টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ৮২তম। শিক্ষকদের দুর্বল প্রশিক্ষণ, বাজারচাহিদা অনুযায়ী শিক্ষানীতির অভাব, তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহারের অভাবের কারণে বাংলাদেশ বেশ পিছিয়ে আছে।

সামাজিক সুরক্ষার কার্যক্রমের পরিধি আগের চেয়ে বেড়েছে, কিন্তু মিলছে না সুফল। এ উপসূচকে ৮১তম স্থানে বাংলাদেশ। এর মানে সামাজিক সুরক্ষা সেবা প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর কাছে যথাযথভাবে পৌঁছাচ্ছে না। আর বিভিন্ন সরকারি সেবার বিস্তৃতিতে ৮০তম স্থানে আছে, অর্থাৎ সরকারি সেবার কার্যকারিতা খুবই কম।

কাজের পরিবেশ উপসূচকে ৭৯তম স্থানে বাংলাদেশ। ন্যায্য মজুরি সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান তুলনামূলকভাবে ভালো। এ উপসূচকে ৩৩তম স্থানে বাংলাদেশ। এ ছাড়া সার্বিকভাবে স্বাস্থ্য সূচকে ৭৯তম, শিক্ষার সুযোগে ৭৫তম, শিক্ষার মান ও সমতায় ৭৮তম, প্রযুক্তির লভ্যতায় ৭৬তম, কাজের সুযোগে ৭০তম স্থানে আছে।

বৈষম্য বাড়ছে

বাংলাদেশ এখন উচ্চ বৈষম্যের দিকে যাচ্ছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ খানা আয় ও ব্যয় জরিপ অনুযায়ী, দেশের সবচেয়ে গরিব ২০ লাখ পরিবারের প্রতি মাসে গড় আয় মাত্র ৭৪৬ টাকা। আর সবচেয়ে ধনী ২০ লাখ পরিবারের গড় আয় ৮৯ হাজার টাকা। এই ধনী পরিবারগুলো সবচেয়ে গরিব পরিবারগুলোর চেয়ে ১১৯ গুণ বেশি আয় করে। আয়বৈষম্যের কারণে মানসম্পন্ন শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবাসহ জীবনমান উন্নত করার সুযোগ থেকে পিছিয়ে থাকছে গরিব পরিবারগুলো। বিবিএস বলছে, দেশের মানুষের যত আয়, তার ৩৮ শতাংশই হলো সবচেয়ে ধনী ১০ শতাংশ মানুষের। আর সবচেয়ে গরিব ১০ শতাংশের হাতে মাত্র ১ শতাংশের মতো আয়।

এ দেশে শিক্ষিত তরুণদের কাজের সুযোগও তুলনামূলক কম। গত বছরের শ্রমশক্তি জরিপ অনুযায়ী, দেশের বেকারদের ৩৯ শতাংশই উচ্চমাধ্যমিক কিংবা স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারী। সপ্তাহে মজুরির বিনিময়ে এক ঘণ্টা কাজ না পেলেই বেকার হিসেবে ধরা হয়। সেই হিসাবে দেশে বেকার প্রায় ২৭ লাখ। তাঁরা স্বীকৃত বেকার। কিন্তু ছদ্ম বেকারের সংখ্যাও কম নয়। এই সংখ্যা প্রায় ৬৬ লাখ। তাঁরা মনমতো কাজ পাচ্ছেন না। তাঁরা টিউশনি, বিক্রয়কর্মী, অ্যাপের মাধ্যমে যাত্রী পরিবহনের (রাইড শেয়ারিং) চালকসহ বিভিন্ন ধরনের অস্থায়ী কাজ করছেন। গত অক্টোবর মাসে প্রকাশিত বিশ্বব্যাংকের বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট আপডেট প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এ দেশে স্নাতক পাস করে কমপক্ষে এক–দুই বছর বেকার বসে থাকতে হয়।

দেশের শিক্ষাব্যবস্থা বাজারচাহিদা অনুযায়ী মানবসম্পদ তৈরি করতে পারছে না। গ্রামের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর মান শহুরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মানের চেয়ে বেশ পিছিয়ে।

গত ১০ বছরে সামাজিক সুরক্ষায় সরকার খরচ প্রায় তিন গুণ বৃদ্ধি করলেও অতিদরিদ্র অর্ধেক গরিব মানুষ তা পাচ্ছেন না। দেশের ৭৪ লাখ লোককে বিধবা ভাতা, দরিদ্র নারীদের মাতৃত্বকালীন ভাতার পাশাপাশি টেস্ট রিলিফ, ভালনারেবল গ্রুপ ফিডিং (ভিজিডি), কাজের বিনিময়ে টাকাসহ (কাবিটা) বিভিন্ন সামাজিক সুরক্ষা সুবিধা দেওয়া হয়। কিন্তু দেশে প্রায় পৌনে দুই কোটি অতিদরিদ্র মানুষ আছে।

একটি শিশু জন্মগ্রহণ করে যে পরিবেশে বেড়ে ওঠে, সেই পরিপ্রেক্ষিতে তার সম্ভাবনা কতটা কাজে লাগাতে পারে, তা ধরে ২০১৮ সালে বিশ্বব্যাংক মানবসম্পদ সূচক তৈরি করেছে। সেখানে দেখা গেছে, বাংলাদেশের শিশুরা তার সম্ভাবনার মাত্র অর্ধেক কাজে লাগাতে পারে। এর মানে, বাকি অর্ধেক সম্ভাবনাই নষ্ট হয়ে যায়।

এসব বিষয়ে জানতে চাইলে পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের (জিইডি) সদস্য শামসুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, সামাজিক উত্তরণের বাধাগুলো চিহ্নিত করা হয়েছে। এই জন্য সংস্কারমূলক পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। তাই অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় বিনিয়োগ ক্ষেত্র পুনর্বিন্যাস করা হবে। তাঁর মতে, শুধু সামাজিক সুরক্ষা দিয়ে বৈষম্য কমানো যাবে না। দারিদ্র্য কমাতে হবে। এ ছাড়া শিক্ষা, স্বাস্থ্য বরাদ্দ বাড়ালে দক্ষ মানবসম্পদ গড়ে উঠবে। তখন এমনিতেই আয়বৈষম্য কমে যাবে।