ব্যাংকে সুদ কমছে, টাকা এখন কই রাখবেন?

সঞ্চয় থেকে পাওয়া মুনাফা দিয়েই চলে অনেক পরিবার। তাই সুদহার একটু ভালো যেখানে, সেখানেই বিনিয়োগের জন্য ভিড় বেশি। ছবি: শুভ্র কান্তি দাশ
সঞ্চয় থেকে পাওয়া মুনাফা দিয়েই চলে অনেক পরিবার। তাই সুদহার একটু ভালো যেখানে, সেখানেই বিনিয়োগের জন্য ভিড় বেশি। ছবি: শুভ্র কান্তি দাশ

একটু বড় অঙ্কের আমানত নিয়ে ব্যাংকে গেলে আদর-সমাদর জুটত, সঙ্গে বছর শেষে ১০ শতাংশ সুদ। এই সুখ আর থাকছে না। ব্যাংকগুলো আমানতের সুদের হার কমাতে শুরু করেছে। কিছু ব্যাংক কমিয়ে ফেলেছে। সরকারের যে পরিকল্পনা তাতে টাকা রাখলে কোনো ব্যাংকেই ৬ শতাংশের বেশি সুদ পাওয়া যাবে না। 

এখন প্রশ্ন হলো, আমানত তাহলে রাখবেন কোথায়? যাঁদের পর্যাপ্ত আয় আছে, তাঁদের কাছে হয়তো আমানতের সুদের হার কিছুটা কমবেশি হওয়া কোনো বিষয় নয়। কিন্তু যাঁদের সংসার চলে সঞ্চয়ের ওপর, এক শতাংশ যাঁদের কাছে অনেক কিছু, তাঁদের হয়তো টাকা রাখার লাভজনক ও নিরাপদ কোনো জায়গা খুঁজতে হচ্ছে। তাঁদের জন্যই এই লেখা। 

আগে জেনে নিই, ব্যাংকে টাকা রাখা কেন আর লাভজনক নয়, অন্তত সুদের হারের দিক দিয়ে। সরকার দেড় বছর ধরে সুদের হার নিয়ে যে নয়-ছয় চিন্তা করছে, তা কার্যকর হবে আগামী এপ্রিল থেকে। আমানতের সুদ না কমালে ঋণের সুদ কমানো যাবে না। তাই ব্যাংকগুলোর ব্যবস্থাপনা পরিচালকেরা গত মাসের শেষ দিকে এক বৈঠকে আমানতের সুদের ৬ শতাংশে আনার সিদ্ধান্ত নেন, যা কার্যকর হয়ে গেছে। মূল্যস্ফীতি এখন ৬ শতাংশের কিছু কম আছে। পণ্যমূল্য বাড়ছে। ফলে সেটা ৬ শতাংশ হওয়ার আশঙ্কা আছে। বাস্তবেই যদি হয়ে যায়, তাহলে কিন্তু ব্যাংকে রাখলে আপনার টাকা বাড়বে না। 

ধরেন, আপনি ১০০ টাকা ব্যাংকে স্থায়ী আমানত হিসেবে রেখে বছর শেষে ১০৬ টাকা পেলেন। মূল্যস্ফীতির কারণে আপনার ওই ১০০ টাকার মূল্যমানও কিন্তু ৬ টাকা কমে গেল, তাহলে টাকা বাড়ল কই? আমানতের সুদ যদি ১০ শতাংশ হতো, তাহলে ৬ শতাংশ মূল্যস্ফীতি হলেও আপনার জমা টাকার প্রকৃত পরিমাণ ৪ শতাংশ বাড়ত। প্রাপ্ত সুদের ওপর ১০ থেকে ১৫ শতাংশ উৎসে আয়কর না হয় হিসাবে না-ই ধরলাম। সেটা ধরলে আপনার টাকা আরও কমবে (প্রকৃত মূল্য)। 

টাকা রাখতে পারেন ডাকঘরের সঞ্চয় ব্যাংকে। সেখানে তিন বছর মেয়াদে টাকা রাখলে ১১ দশমিক ২৮ শতাংশ হারে সুদ পাওয়া যায়। ১ লাখ টাকা জমা রাখলে তিন বছর শেষ উৎসে কর কাটার পর হাতে পাবেন বাড়তি ৩০ হাজার ৪৫৬ টাকা। একজন ব্যক্তি একই নামে ৩০ লাখ টাকা পর্যন্ত জমা রাখতে পারেন। যৌথ হিসাবে জমা রাখা যায় ৬০ লাখ টাকা পর্যন্ত। 

দেশের সব ডাকঘরে এ সেবা পাওয়া যায়। তবে এক ডাকঘরে টাকা জমা রেখে অন্য ডাকঘর থেকে সেই টাকা উত্তোলন করা যায় না। বাংলাদেশ ডাক অধিদপ্তরের কর্মচারীরা জানান, জেলা পর্যায়ে এই সঞ্চয় ব্যাংকে টাকা জমা রাখার প্রবণতা বেশি। জমা ফরম এক পাতার, ফলে প্রক্রিয়া খুবই সহজ। এখন সরকারের একটি অধিদপ্তরের ওপর আপনি আস্থা রাখবেন কি না, সে সিদ্ধান্ত আপনার।

সঞ্চয়পত্রে টাকা খাটানো একটু কঠিন হয়েছে। তবে সুদের হার বা মুনাফা কিন্তু সেখানে এখনো বেশি। পাঁচ বছর মেয়াদি বাংলাদেশ সঞ্চয়পত্র, পরিবার সঞ্চয়পত্র, তিন মাস অন্তর মুনাফাভিত্তিক সঞ্চয়পত্র এবং পেনশনার সঞ্চয়পত্র—বর্তমানে এ চার ধরনের সঞ্চয়পত্র চালু রয়েছে। সুদের হার সঞ্চয়পত্রের ধরন ও মেয়াদ ভেদে ৯ দশমিক ৩৫ থেকে ১১ দশমিক ৭৬ শতাংশ পর্যন্ত। 

তবে সবাই সব ধরনের সঞ্চয়পত্র কিনতে পারেন না। পাঁচ বছর মেয়াদি বাংলাদেশ সঞ্চয়পত্র ও তিন মাস অন্তর মুনাফাভিত্তিক সঞ্চয়পত্র কেবল সবার জন্য উন্মুক্ত। ১ লাখ টাকার বেশি হলেই ব্যাংকের চেকের মাধ্যমে সঞ্চয়পত্র কিনতে হবে—গত ১ জুলাই থেকে এ নিয়ম চালু হওয়ার পর অনেকেই সঞ্চয়পত্র কিনতে পারছেন না। ১ লাখ টাকার বেশি মূল্যের সঞ্চয়পত্র কিনতে কর শনাক্তকরণ নম্বর বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। ৫ লাখ টাকা পর্যন্ত বিনিয়োগে মুনাফার ওপর উৎসে আয়কর ৫ শতাংশ, এর বেশি হলে ১০ শতাংশ। আপনার বৈধ ও প্রদর্শিত আয়ের জন্য সঞ্চয়পত্র ভালো বিনিয়োগের ক্ষেত্র হতে পারে। 

বিনিয়োগের সুযোগ রয়েছে সরকারের ট্রেজারি বিল এবং বন্ডেও। মূলত ব্যাংকগুলো এসব বিল ও বন্ডে বিনিয়োগ করে। তবে নীতিমালা অনুযায়ী বাংলাদেশের যেকোনো নাগরিক এসব বন্ডে বিনিয়োগ করতে পারেন। বাংলাদেশ ব্যাংক সরকারের পক্ষে ট্রেজারি বিল ও বন্ডে বিনিয়োগ কার্যক্রম পরিচালনা করে। যেকোনো ব্যাংক শাখার মাধ্যমে এতে বিনিয়োগ করা যায়। 

দুই বছর মেয়াদি ট্রেজারি বন্ডে সুদের হার ৮ দশমিক ২৭ শতাংশ। এ ছাড়া পাঁচ বছর মেয়াদি বন্ডে ৮ দশমিক ৮৬ শতাংশ, ১০ বছর মেয়াদি বন্ডে ৯ দশমিক ১৫ শতাংশ, ১৫ বছর মেয়াদি বন্ডে ৯ দশমিক ৩৭ শতাংশ ও ২০ বছর মেয়াদি বন্ডে ৯ দশমিক ৬২ শতাংশ সুদ পাওয়া যায়।

আর ৯১ দিন মেয়াদি ট্রেজারি বিলে ৬ দশমিক ৭০ শতাংশ, ১৮২ দিন মেয়াদি বিলে ৭ দশমিক ৮১ শতাংশ ও ৩৬৪ দিন মেয়াদি বিলে ৭ দশমিক ৭০ শতাংশ সুদ পাওয়া যায়।

এর বাইরে শেয়ারবাজারে টাকা খাটাতে পারেন। আর্থিক প্রতিষ্ঠানে রাখতে পারেন। বিমা কোম্পানিতে রাখতে পারেন। প্রবাসীরা রাখতে পারেন প্রবাসী বন্ডে। সুযোগ অনেক আছে। যেখানেই রাখেন, টাকা আপনার, বিবেচনা আপনার।