বেসিক ব্যাংক কেলেঙ্কারি: ঘুষের টাকায় বাড়ি কেনেন বাচ্চু ও তাঁর ভাই

বেসিক ব্যাংকের চেয়ারম্যান থাকার সময় শেখ আবদুল হাই ওরফে বাচ্চু ১১০ কোটি টাকা দিয়ে ঢাকায় একটি বাড়ি কিনেছিলেন। শেখ আবদুল হাই একক কর্তৃত্বে নামে-বেনামে হাজার হাজার কোটি টাকা ঋণ দিয়েছিলেন। সেই ঋণের একটি বড় অংশ ঘুষ হিসেবে নিয়েছেন তিনি। সেই টাকা দিয়েই কেনা হয়েছে এই বাড়ি।

বাড়িটি কেনা হয় আবদুল হাই, তাঁর স্ত্রী, ছেলে-মেয়ে ও ভাইয়ের নামে। ঢাকার ক্যান্টনমেন্ট বাজার এলাকার শহীদ সরণিতে থাকা এ বাড়ির আয়তন দেড় বিঘা। বাড়িটির বিক্রেতা বেস্ট হোল্ডিংস গ্রুপের চেয়ারম্যান ও হোটেল লা মেরিডিয়ানের মালিক আমিন আহমেদ।

এত বড় বাড়ি কেনার জন্য আবদুল হাই এত টাকা কোথায় পেলেন—বাংলাদেশ ব্যাংক তার উৎস অনুসন্ধান করে সাত বছর আগেই একটি প্রতিবেদন পাঠিয়েছিল দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক)। দুর্নীতির দায়ে অনেকের সম্পত্তি জব্দ করলেও আবদুল হাইয়ের এ সম্পত্তি জব্দের ব্যাপারে দুদক কিছুই করেনি। তাঁর বিষয়ে তদন্ত ও মামলা করার জন্য আদালতের দেওয়া সময়সীমা কয়েকবার পার করে দুদক এখন চুপচাপ আছে।

অথচ বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনেই উঠে এসেছিল যে অবৈধভাবে ঋণ নেওয়া বেসিক ব্যাংকের বিভিন্ন গ্রাহকের কাছ থেকে শেখ আবদুল হাই ও তাঁর ভাই শেখ শাহরিয়ার ওরফে পান্না মোটা অঙ্কের টাকা নিয়েছেন। অর্থাৎ দুই ভাইয়ের নেতৃত্বে বাড়ি কেনা হলেও সেই বাড়ি কেনার জন্য টাকা দিয়েছেন ব্যাংকের অন্য গ্রাহকেরা।

এ প্রসঙ্গে বক্তব্য জানতে গত মঙ্গলবার দুদক চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদের কার্যালয়ে গেলে তাঁর একান্ত সচিব ফজলুল জাহিদ পাভেল বিষয়বস্তু জানতে চান। জানানোর পর তিনি বলেন, চেয়ারম্যান এ বিষয়ে সংস্থার পরিচালক প্রণব কুমার ভট্টাচার্যের সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দিয়েছেন।

দুদক পরিচালক প্রণব কুমার ভট্টাচার্য প্রথম আলোকে বলেন, ‘বেসিক ব্যাংকের মামলার তদন্ত শেষ হয়নি। আর ব্যাংকটির সাবেক চেয়ারম্যানের সম্পত্তির বিষয় মুখ্য হিসেবে কখনো আসেনি। যখন আসবে, দুদক তখন আইনানুযায়ী পদক্ষেপ নেবে।’ 

তবে দুদকের এই বক্তব্য অবশ্য নতুন কিছু নয়। শেখ আবদুল হাইয়ের প্রসঙ্গ এলে প্রতিবারই দুদক এমন মন্তব্য করে। এর আগে বেসিক ব্যাংক নিয়ে একাধিক মামলা হলেও শেখ আবদুল হাইয়ের নাম কখনোই রাখা হয়নি।

দলিলে যা আছে
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনের সূত্র ধরে ঢাকার তেজগাঁও রেজিস্ট্রেশন কমপ্লেক্স থেকে বাড়িটির দলিল সংগ্রহ করে প্রথম আলো। দেখা যায়, বেচাকেনার সময় বাড়ির দলিল হয় দুটি। একটি দলিল ১৮ কাঠার। এটি হয় শেখ আবদুল হাই, তাঁর স্ত্রী শেখ শিরীন আক্তার এবং ভাই শেখ শাহরিয়ার ওরফে পান্নার নামে। অন্য দলিলটি ১২ দশমিক ২৫ কাঠার। এর দলিল হয় শেখ আবদুল হাইয়ের ছেলে শেখ সাবিদ হাই অনিক ও মেয়ে শেখ রাফা হাইয়ের নামে। দেড় বিঘা আয়তনের পুরো বাড়ির দলিলমূল্য দেখানো হয় ১৫ কোটি ২৫ লাখ টাকা। এর মধ্যে ১৮ কাঠার দলিলমূল্য ৯ কোটি টাকা এবং ১২ দশমিক ২৫ কাঠার দলিল মূল্য ৬ কোটি ২৫ লাখ টাকা।

জাতীয় পার্টি থেকে ১৯৮৬ সালের সংসদ নির্বাচনে বাগেরহাট-১ আসন থেকে অংশ নিয়ে শেখ আবদুল হাই একবার সাংসদ হয়েছিলেন। এরপর সরাসরি রাজনীতি করতে তাঁকে দেখা যায়নি। ২০০৮ সালের নির্বাচনে জয়ী আওয়ামী লীগ সরকার ২০০৯ সালের সেপ্টেম্বরে বেসিক ব্যাংকের চেয়ারম্যান পদে তাঁকে তিন বছরের জন্য নিয়োগ দেয়। এই মেয়াদ শেষ হওয়ার আগের মাস অর্থাৎ ২০১২ সালের আগস্টে তিনি বেস্ট হোল্ডিংস গ্রুপের চেয়ারম্যান আমিন আহমেদের সঙ্গে বাড়িটি কেনার বায়না চুক্তি করেন। বায়না চুক্তিপত্রটি বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে রয়েছে। চুক্তিপত্রে জমির পরিমাণ দেখানো হয় দলিল হওয়া জমির চেয়ে একটু বেশি অর্থাৎ ৩০ দশমিক ৩০ কাঠা। ২০১২ সালের ৮ আগস্টে হওয়া এ বায়না চুক্তিপত্রে আবদুল হাইসহ তাঁর স্ত্রী, পুত্র, কন্যা ও ভাইয়ের স্বাক্ষর রয়েছে।

বায়না চুক্তিপত্রে বাড়িটির মূল্য ১১০ কোটি টাকা উল্লেখ করা হয়। চুক্তিপত্রের শর্ত অনুযায়ী ওই দিনই ১০ কোটি টাকা নগদ পেয়ে যান আমিন আহমেদ। বাড়ির মূল্য বাবদ বাকি ১০০ কোটি টাকা পরিশোধিত হওয়ার কথা ২০১২ সালের ৩০ আগস্টের মধ্যে। চুক্তিপত্র অনুযায়ী, ‘জমির মূল্য ১১০ কোটি টাকা। অদ্য পরিশোধকৃত ১০ কোটি টাকা, বাকি ১০০ কোটি টাকা ৩০ আগস্টের মধ্যে রেজিস্ট্রি বায়না দলিল সম্পাদনের সময় দেওয়া হবে।’

বায়না চুক্তি অনুযায়ী বাড়ির মালিকানা হওয়ার কথা পাঁচজনের নামে। এতে জমির বণ্টন প্রস্তাব করা হয় এভাবে—শেখ আবদুল হাই ওরফে বাচ্চু ৬ দশমিক ৩ কাঠা, শেখ শাহরিয়ার ওরফে পান্না ৬ কাঠা, শেখ শিরীন আক্তার ২ কাঠা, শেখ সাবিদ হাই ওরফে অনিক ৮ কাঠা এবং শেখ রাফা হাই ৮ কাঠা। দলিল দুটি বিশ্লেষণে দেখা যায়, জমির মালিক আমিন আহমেদ বায়না চুক্তি হওয়ার পাঁচ মাস আগে ২০১২ সালের ৮ মার্চ দেড় বিঘার পুরো প্লটকে ৬ ও ৬এ নামে দুটি ভাগে রূপান্তর করেন। ৬ নম্বর প্লটে ১২ দশমিক ২৫ কাঠা আর ৬এ নম্বর প্লটে ১৮ কাঠা জমি।

জমি বিক্রেতা আমিন আহমেদ গত ২২ জানুয়ারি নিকুঞ্জ কার্যালয়ে বসে প্রথম আলোকে বলেন, চুক্তি অনুযায়ী পুরো ১১০ কোটি টাকাই তিনি পেয়েছেন এবং বিক্রির টাকায় ব্যাংকের দেনা পরিশোধ করেছেন তিনি। এর বাইরে কিছু বলতে চাননি আমিন আহমেদ।

চুক্তিপত্র অনুযায়ী ২০১২ সালের ৩০ আগস্টের মধ্যে বাড়ির দলিল হওয়ার কথা থাকলেও তা আর হয়নি। চেয়ারম্যান হিসেবে তিন বছর মেয়াদ শেষ হওয়ার কিছুদিন আগে ওই বছরের সেপ্টেম্বরে আবদুল হাইকে পুনর্নিয়োগ দেয় সরকার এবং এরপরের মাসেই পুরো বাড়ির দলিল হয়। অর্থাৎ উভয় দলিলই হয় শেষ পর্যন্ত ২০১২ সালের ১৮ অক্টোবর।

দলিল দুটি ঘেঁটে দেখা যায়, বায়না চুক্তির তুলনায় চূড়ান্ত বণ্টনে একটু হেরফের হয়েছে। শেষ পর্যন্ত আবদুল হাইসহ তিনজন কিনেছেন ১৮ কাঠা জমি, যার দাম দেখানো হয়েছে ৯ কোটি টাকা। এর মধ্যে শেখ আবদুল হাই ৮ কাঠা, শেখ শাহরিয়ার ওরফে পান্না ৬ কাঠা এবং শেখ শিরীন আক্তার ৪ কাঠা জমির মালিক হয়েছেন। অন্য দলিল অনুযায়ী শেখ সাবিদ হাই ৬ দশমিক ২৫ কাঠা এবং শেখ রাফা হাই ৬ কাঠা জমির মালিক। 

উভয় দলিলে পাঁচজনের ঠিকানা একই দেখানো হয়। ঠিকানাটি হচ্ছে ২/২এ ডিওএইচএস, বনানী, ঢাকা। এটিও শেখ আবদুল হাইয়ের আরেকটি বাড়ি। আবদুল হাই, তাঁর স্ত্রী এবং ভাইয়ের পেশা ব্যবসা দেখানো হলেও তাঁর ছেলে শেখ সাবিদ হাই ও মেয়ে শেখ রাফা হাইয়ের পেশা উল্লেখ করা হয় শিক্ষার্থী। 

এ বিষয়ে কথা বলার জন্য চেষ্টা করেও শেখ আবদুল হাই ওরফে বাচ্চুকে পাওয়া যায়নি। তবে তাঁর ভাই শেখ শাহরিয়ার ওরফে পান্না গত মঙ্গলবার মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ১১০ কোটি টাকায় তাঁরা বাড়ি কেনেননি, কিনেছেন আরও কমে। তবে কত কমে, তা জানাতে চান না তিনি। 

বেসিক ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েছেন—এমন অনেক গ্রাহকের হিসাব থেকে বাড়ি বিক্রেতার হিসাবে টাকা গেছে এবং এই তথ্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে রয়েছে—এ কথা জানালে শেখ শাহরিয়ার বলেন, মিথ্যে কথা। নিজেদের টাকা এবং কিছু ফ্ল্যাট বিক্রির টাকা দিয়ে তাঁরা এই বাড়ি কিনেছেন।

আবাসন কোম্পানিতে সন্দেহজনক অর্থ
দলিল হওয়ার পরের মাসে অর্থাৎ ২০১২ সালের নভেম্বরে বেসিক ব্যাংকের শান্তিনগর শাখার ওপর বিশেষ পরিদর্শন করে বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি দল। পরিদর্শন প্রতিবেদনে গুরুতর অনিয়ম-দুর্নীতির চিত্র উঠে আসে। তিন মাস পর ২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে দেওয়া প্রতিবেদনে বলা হয়, মাত্র এক বছরের ব্যবধানে শাখাটি অস্বাভাবিক ঋণ দিয়েছে এবং যেসব প্রতিষ্ঠান ঋণ পেয়েছে, তাদের মধ্যে নামসর্বস্ব প্রতিষ্ঠানও রয়েছে। আরও বলা হয়েছে, ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়া গ্রাহকের অর্থ এমন সব আবাসন কোম্পানিতে স্থানান্তরিত হয়েছে, যেগুলোর সঙ্গে গ্রাহক প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যবসায়িক সম্পর্ক নেই। তবে এর সঙ্গে আবদুল হাই বাচ্চুর বাড়ি কেনার সম্পর্ক রয়েছে বলে বিশ্লেষণে দেখা যাচ্ছে।

আবাসন কোম্পানিতে গ্রাহকদের অর্থ স্থানান্তরের যে তথ্য উঠে আসে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদনে, তার মধ্যে রয়েছে বিডি পাইপস অ্যান্ড পাওয়ার নামের একটি কোম্পানির নাম। কোম্পানিটি ২০১২ সালের ৩ থেকে ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত আটটি পে-অর্ডারের মাধ্যমে শেখ আবদুল হাই ও শেখ শাহরিয়ার পান্নার মালিকানাধীন কোম্পানি ক্রাউন প্রোপার্টিজকে ২ কোটি ৭০ লাখ টাকা দেয়।

বিডি পাইপস সম্পর্কে বাংলাদেশ ব্যাংক বলেছে, ‘মাত্র দুই মাসের ব্যবধানে কোম্পানিটির ঋণসীমা ১০ কোটি থেকে ৩০ কোটি টাকায় উন্নীত করা হয়েছে।’ বেসিক ব্যাংক জানায়, কোম্পানিটি এখন ব্যাংকের কাছে ১০৬ কোটি টাকার দেনাদার। 

বিডি পাইপসের এমডি রিয়াজুল ইসলাম গত ২৬ জানুয়ারি প্রথম আলোকে বলেন, ‘ক্রাউন প্রোপার্টিজের কাছ থেকে কিছু টাকা এনেছিলাম। ওই টাকা পরিশোধ করেছি। বিষয়টি এ ছাড়া কিছুই নয়।’

একইভাবে ২০১২ সালের এপ্রিল ও মে—এ দুই মাসে আখওয়ান ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল নামক আরেক গ্রাহক ১ কোটি ৩০ লাখ টাকা দেয় ক্রাউন প্রোপার্টিজকে। আখওয়ান ট্রেড জনশক্তি রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান। এর মালিকানায় আছেন সিরাজুল আমিন, ফোরকানুল আমিনসহ পাঁচ ব্যবসায়ী। 

বাসার এন্টারপ্রাইজ নামক একটি প্রতিষ্ঠান একই বছরের জুন থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত চার মাসে মিতুল প্রোপার্টিজ নামক এক আবাসন কোম্পানিকে ৬ কোটি ৫০ লাখ এবং নাইলা প্রোপার্টিজ নামক আরেক আবাসন কোম্পানিকে ৩ কোটি ৭০ লাখ টাকা দেয়। আগস্ট-সেপ্টেম্বরে আরেক গ্রাহক যমুনা অ্যাগ্রো কেমিক্যালস পে-অর্ডারের মাধ্যমে মিতুল প্রোপার্টিজকে ৫০ লাখ টাকা এবং ক্রাউন প্রোপার্টিজকে ৫০ লাখ টাকা দেয়।

>চেয়ারম্যান থাকার সময়ে ১১০ কোটি টাকায় বাড়ি কিনেছিলেন শেখ আবদুল হাই ওরফে বাচ্চু ও তাঁর ভাই শেখ শাহরিয়ার ওরফে পান্না।

বাসার এন্টারপ্রাইজের চেয়ারম্যান বগুড়া জেলা আওয়ামী লীগের শিল্প ও বাণিজ্যবিষয়ক সম্পাদক প্রয়াত আইনুল হক সোহেলের স্ত্রী ভায়লা সেলিনা। তাঁদের মেয়ে অনিন্দিতা হক ওরফে গুঞ্জন প্রথম আলোকে বলেন, বাবা বেঁচে থাকাকালীন এসব ঘটনার কিছুই তাঁর জানা নেই।

যমুনা অ্যাগ্রো কেমিক্যালের মালিকানায় আছেন জাতীয় পার্টির সাবেক সাংসদ শওকত চৌধুরী, তাঁর স্ত্রী মাহবুবা খাতুন ও মেয়ে ইফফাত আফসানা। শওকত চৌধুরী ১১৬ কোটি টাকা ফেরত না দেওয়া বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংকের শীর্ষ পাঁচ ঋণখেলাপির একজন। গত ২৬ জানুয়ারি শওকত চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, ‘ব্যবসা করা অনেক কষ্টের। সহজে ব্যাংকঋণ পাওয়া যায় না। তাই ঘুষ দিয়ে ঋণ নিতে হয়েছিল।’ 

আর নাইলা প্রোপার্টিজের মালিকানায় আছেন প্রয়াত আবাসন ব্যবসায়ী শামীম আহমেদ, তাঁর স্ত্রী লাকী আহমেদ এবং শামীম আহমেদের ভাই ওমর শরীফ। লাকী আহমেদ প্যান প্যাসিফিক ফিলিং স্টেশনের স্বত্বাধিকারী এবং লাকী জাগরণ ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান। 

লাকী আহমেদকে তিন মাসে ১২ বার ফোন দেওয়া হলেও তিনি রিসিভ করেননি। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম মেসেঞ্জার ও মুঠোফোনে দেওয়া খুদে বার্তারও জবাব দেননি তিনি। তবে কোম্পানির পরিচালক ওমর শরীফ রনি বলেন, তিনি নামমাত্র পরিচালক। লাকী আহমেদই সবকিছু দেখেন। 

গ্রাহকেরাও দেন বাড়ি কেনার টাকা
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন বলছে, বেসিক ব্যাংকের ১০ গ্রাহক প্রতিষ্ঠান ৪০টি পে-অর্ডারের মাধ্যমে ২৪ কোটি টাকা দিয়েছে তিনটি প্রতিষ্ঠানকে। এর মধ্যে বেশি টাকা পেয়েছে শেখ আবদুল হাইয়ের ভাই শেখ শাহরিয়ার ওরফে পান্নার মালিকানাধীন বিএম কম্পিউটারস। এটি কম্পিউটার ও কম্পিউটারের যন্ত্রাংশ বিক্রির দোকান। হাতিরপুলের নাহার প্লাজার চতুর্থ তলায় গিয়ে দেখা যায়, বিএম কম্পিউটারসের ছোট দোকানটি এখনো আছে। প্রতিবেশী দোকানগুলো সূত্রে জানা গেছে, চার বছর ধরে এটি বন্ধ। যখন খোলা ছিল, তখন পাঁচ লাখ টাকার পণ্যও এতে ছিল না।

টাকা পাওয়া তিনটির মধ্যে অন্য দুটি প্রতিষ্ঠান হচ্ছে বাড়ি বিক্রেতা আমিন আহমেদের মালিকানাধীন বেস্ট হোল্ডিংস গ্রুপের দুটি সহযোগী কোম্পানি ক্যাপিটাল বনানী ওয়ান লিমিটেড ও বেস্ট হোল্ডিংস লিমিটেড।

প্রতিবেদনের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, ১৩টি পে–অর্ডারের মাধ্যমে ৬ কোটি ৩০ লাখ টাকা গেছে বিএম কম্পিউটারসের হিসাবে। এর মধ্যে বিএম কম্পিউটারসকে চারটি পে–অর্ডারে যমুনা অ্যাগ্রো কেমিক্যালস দিয়েছে ২ কোটি ২০ লাখ টাকা। 

তিনটি পে-অর্ডারে সোনার বাংলা ন্যাচারাল ১ কোটি ২৫ লাখ, এক পে-অর্ডারে মালিপুর ফ্লাওয়ার মিলস ৯৩ লাখ এবং এক পে-অর্ডারে বিডি পাইপস ৫০ লাখ টাকা দিয়েছে। এ ছাড়া চারটি পে-অর্ডারে আখওয়ান ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল দিয়েছে ১ কোটি ১৫ লাখ টাকা। মুঠোফোনে কোম্পানির এমডি আবদুল ওয়াদুদ ভুঁইয়ার সঙ্গে কয়েক দফা যোগাযোগ করলেও তিনি ফোন ধরেননি।

মালিপুর ফ্লাওয়ার মিলসের কাছে ব্যাংকের পাওনা ২৩ কোটি ৯৩ লাখ টাকা। প্রতিষ্ঠানটির স্বত্বাধিকারী শাহেদ উদ্দিন মিল্লাত প্রথম আলোকে বলেন, ‘কাউকে না কাউকে টাকা দিয়েই ঋণ নিতে হয়।’ প্রতিবেদককে বাকিটা বুঝে নিতে বলেন তিনি।

আবার আখওয়ান গ্রুপের আরেক প্রতিষ্ঠান এভিয়েট ইন্টারন্যাশনাল থেকেও টাকা নিয়েছে শেখ শাহরিয়ার ওরফে পান্নার প্রতিষ্ঠান বিএম কম্পিউটারস। কোম্পানি সূত্রে জানা গেছে, ঘটনাটি এ রকম—এভিয়েট ইন্টারন্যাশনালকে শেখ শাহরিয়ার ঋণ পাইয়ে দেবেন ৩০ কোটি টাকা। বেসিক ব্যাংকের বসুন্ধরা শাখা প্রথম দফায় ৮ কোটি ৩০ লাখ টাকার ঋণ অনুমোদন করে। কিন্তু পুরো ঋণের ১৬ শতাংশ কমিশন ধরে ১৩টি পে-অর্ডারে ৪ কোটি ৮০ লাখ টাকাই নিয়ে নেয় বিএম কম্পিউটারস। দুদকে ২০১৩ সালের ডিসেম্বরে এভিয়েট ইন্টারন্যাশনাল এক অভিযোগে জানিয়েছে, ৩০ কোটির বাকি টাকা তারা পায়নি, পেয়েছে মাত্র ৩ কোটি ৫০ লাখ টাকা। অথচ ব্যাংকের কাছে তারা ৮ কোটি ৩০ লাখ টাকা নেওয়ার দেনাদার। 

প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, ২০১২ সালের ১২ আগস্ট ক্যাপিটাল বনানী ওয়ানের নামে দুটি আলাদা পে–অর্ডারে দুই কোটি টাকা জমা করে বাসার এন্টারপ্রাইজ। দুই দিন পর ১৪ আগস্ট আলী কনস্ট্রাকশন নামক এক প্রতিষ্ঠান আলাদা পে–অর্ডারে ১ কোটি টাকা করে মোট ৫ কোটি টাকা জমা দেয় ক্যাপিটাল বনানী ওয়ানে। একই বছরের ১০ অক্টোবর কক্সেস ডেভেলপার লিমিটেড নামের কোম্পানি ক্যাপিটাল বনানীকে দেয় ১ কোটি এবং বেস্ট হোল্ডিংসকে দেয় ১ কোটি টাকা। 

আলী ট্রেড ইন্টারন্যাশনালের চেয়ারম্যান মো. মাহবুবুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, ‘টাকা দেওয়ার ঘটনা আমার জানা নেই। এটি আগে সৈয়দ গ্রুপের হামিদুজ্জামান ওরফে বাবলুর একক মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান ছিল। আমি ও আহাদুজ্জামান বাতেন প্রতিষ্ঠানটি কিনে নিয়েছি।’ হামিদুজ্জামান মালয়েশিয়ায় থাকেন বলে জানা গেছে। 

একই বছরের ২৯ ও ৩০ আগস্ট ১৬টি পে-অর্ডারে আবাসন কোম্পানি হার্ব হোল্ডিংস ৯ কোটি টাকা দেয় বেস্ট হোল্ডিংসকে। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন বলছে, পে–অর্ডারগুলোর আবেদনকারী হচ্ছে হার্ব হোল্ডিংস আর বেনিফিশিয়ারি হচ্ছে বেস্ট হোল্ডিংস। হার্ব হোল্ডিংসের পরিচালক আহকাম উল্লাহ প্রথম আলোকে বলেন, ‘একটি জমি কেনার জন্য ২১ কোটি টাকা দেওয়া হয়েছিল বেসিক ব্যাংকের গুলশান শাখায়। শাখা ব্যবস্থাপক মোহাম্মদ আলী এই টাকা ব্যবহার করে পে–অর্ডার করে থাকতে পারেন। বেস্ট হোল্ডিংস বা শেখ আবদুল হাই বাচ্চুর সঙ্গে আমার কোনো সম্পর্ক নেই।’ 

সামগ্রিক বিষয় নিয়ে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, ‘বেসিক ব্যাংককে ধ্বংসের কিনারে নিয়ে যাওয়ার জন্য অন্যতম দায়ী শেখ আবদুল হাই বাচ্চু—সমাজের সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে গণমাধ্যম এবং আদালতপাড়ায় এ ঘটনা ব্যাপকভাবে আলোচিত। শেখ আবদুল হাই যদি ১১০ কোটি টাকায় ঢাকা শহরে বাড়ি কিনে থাকেন, আমার প্রথম প্রশ্ন হচ্ছে, এত টাকা তিনি পেলেন কোথায়। দ্বিতীয় প্রশ্ন, ব্যাংকের গ্রাহকেরা বাড়ি বিক্রেতাকে এই টাকা দিতে গেলেন কেন। উভয় প্রশ্নের জবাব জানাটা খুবই সহজ, দুদক যদি চায়। শেষ প্রশ্ন হচ্ছে, দুদক তা জানতে চায় কি না।’

বেসিক ব্যাংক একসময় সরকারি খাতের সবচেয়ে ভালো ব্যাংক ছিল। কিন্তু শেখ আবদুল হাই ওরফে বাচ্চু ২০০৯ সালে ব্যাংকের চেয়ারম্যান হওয়ার পরে তাঁর নেতৃত্বে বিপুল পরিমাণ অর্থ আত্মসাৎ করা হয়। এরপর থেকে ব্যাংকটি আর দাঁড়াতে পারেনি। বাংলাদেশ ব্যাংক এবং অর্থ মন্ত্রণালয়–সংক্রান্ত স্থায়ী কমিটি এর জন্য শেখ আবদুল হাইকে সরাসরি দায়ী করেছিল। কিন্তু তাঁর বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থাই নেওয়া হয়নি। সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত জাতীয় সংসদে ও সংসদের বাইরে বেসিক ব্যাংকের অর্থ আত্মসাৎকে ডাকাতির সঙ্গে তুলনা করে এর জন্য শেখ আবদুল হাইকে একাধিকবার দায়ী করেছিলেন। কিন্তু ‘অজ্ঞাত’ কারণে বহাল তবিয়তে থেকে গেছেন তিনি। কাউকে ধরা, কাউকে ছেড়ে দেওয়া—এ রকম নীতির কারণে ব্যাংক খাতের সংকট কাটছে না বলেই সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা মনে করেন।