চীন থেকে চিঠি, বাণিজ্যে নেতিবাচক প্রভাবের আশঙ্কা

চীনে নতুন ধরনের করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে যে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, তাতে বাংলাদেশের আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যে বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে।

এই আশঙ্কার কথা উঠে এসেছে চীন থেকে আসা একটি চিঠি ও সরকারি এক সংস্থার প্রতিবেদনে। চিঠিটি দিয়েছেন চীনে বাংলাদেশের কমার্শিয়াল কাউন্সিলর মোহাম্মদ মনসুর উদ্দিন। আর প্রতিবেদনটি তৈরি করেছে বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশন (বিটিটিসি)।

ওই চিঠি ও প্রতিবেদন মেলালে বাংলাদেশের জন্য একটি দুশ্চিন্তাজনক চিত্র উঠে আসে। কারণ, দেশের শিল্পের কাঁচামাল ও মধ্যবর্তী পণ্য থেকে শুরু করে যন্ত্র ও যন্ত্রাংশ এবং নিত্যব্যবহার্য নানা পণ্যের বড় উৎস চীন। এমনকি ওষুধের কাঁচামালের একটি বড় অংশ চীন থেকে আসে। আবার বাংলাদেশের চামড়া, পাট, কাঁকড়াসহ কিছু পণ্যের বড় রপ্তানি বাজার চীন।

সব মিলিয়ে ২০১৮–১৯ অর্থবছরে চীন থেকে বাংলাদেশ ১ হাজার ৩৮৫ কোটি মার্কিন ডলারের পণ্য আমদানি করেছে, যা মোট আমদানির প্রায় ২৫ শতাংশ। আর রপ্তানি করেছে ৮৩ কোটি ডলারের পণ্য, যা মোট রপ্তানির ২ শতাংশ।

আশঙ্কার বিষয় এই যে বাংলাদেশ যে চীনের বিকল্প খুঁজবে, স্বল্প মেয়াদে সে সুযোগটিও কম। ব্যবসায়ীরা বলছেন, চট করে চীনের মতো কম দামে বিপুল পণ্য সরবরাহের সক্ষমতা তৈরি করা অন্যদের পক্ষে কঠিন।

এদিকে ব্যবসা–বাণিজ্যে করোনার প্রভাব নিয়ে সরকারের উচ্চপর্যায়ে গত মঙ্গলবার একটি বৈঠক হওয়ার কথা ছিল, যা পরে স্থগিত হয়। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে ট্যারিফ কমিশন এ নিয়ে একটি বিস্তারিত প্রতিবেদন তৈরি করছে। জানতে চাইলে ট্যারিফ কমিশনের সদস্য (বাণিজ্য প্রতিবিধান) মোস্তফা আবিদ খান প্রথম আলোকে বলেন, করোনার কারণে শুধু বাংলাদেশ নয়, বৈশ্বিক সরবরাহ ব্যবস্থাই সমস্যায় পড়বে। চীন মধ্যবর্তী পণ্যের একটি বিরাট উৎস। মধ্যবর্তী পণ্য আমদানি ব্যাহত হলে শিল্পকারখানাগুলোর উৎপাদন ব্যাহত হয়।

চীন থেকে চিঠি
চীনে বাংলাদেশের কমার্শিয়াল কাউন্সিলর মোহাম্মদ মনসুর উদ্দিন গত সোমবার চিঠিটি দেন ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন বাংলাদেশ শিল্প ও বণিক সমিতি ফেডারেশনকে (এফবিসিসিআই)। এর অনুলিপি দেওয়া হয় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো ও বাংলাদেশ–চীন চেম্বারকে।

চীনের পরিস্থিতি তুলে ধরে চিঠিতে বলা হয়, বড় ছুটি শেষে চীনের সব সরকারি কার্যালয় ও বেশির ভাগ বেসরকারি প্রতিষ্ঠান খুলেছে। শুল্ক দপ্তর, সব বন্দর ও ব্যাংকের কার্যক্রম আবার শুরু হয়েছে। কিছু ক্ষেত্রে কর্মীরা বাসায় থেকে দায়িত্ব পালন করছেন। কিছু অফিস ন্যূনতম সংখ্যার কর্মী নিয়ে চলছে। এত দিন বন্ধ থাকার পর ছোট ও মাঝারি কারখানাগুলো খোলার ক্ষেত্রে সরকারের অনুমোদন পেতে দীর্ঘসূত্রতার মধ্যে পড়তে হচ্ছে। 

মনসুর উদ্দিন আরও উল্লেখ করেন, চীনের কিছু প্রদেশ সীমিতসংখ্যক কর্মী নিয়ে কারখানা খুলেছে। কিছু জায়গায় কর্মীরা যোগাযোগব্যবস্থা বন্ধ থাকায় কর্মস্থলে ফিরতে পারছেন না। হুবেই ছাড়া অন্য কিছু প্রদেশের উদ্যোক্তাদের হিসাবে কারখানায় শ্রমিকের উপস্থিতি ৪০ থেকে ৬০ শতাংশ।

>চীনে বাংলাদেশের কমার্শিয়াল কাউন্সিলর এক চিঠিতে বলেছেন, করোনার কারণে দেশের আমদানি-রপ্তানি সত্যিকার অর্থেই ব্যাহত হতে পারে।

চীনের হুবেই প্রদেশের রাজধানী উহানে করোনাভাইরাস প্রথম ছড়িয়েছিল বলে সন্দেহ করা হয়। এটি চীনের একটি বড় শিল্প ও পরিবহন যোগাযোগ কেন্দ্র। গাড়ি ও ইলেকট্রনিকসের যন্ত্রাংশ, পোশাক, সুই ও বস্ত্র, প্রিন্টিং ও ডাইং এবং জুতার কারখানার জন্য শহরটি বাণিজ্যিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ। উহান বিভিন্ন বড় শহরের সঙ্গে রেল সংযোগেরও একটি কেন্দ্র। এসব তথ্য তুলে ধরে মনসুর উদ্দিন বলেন, হুবেই প্রদেশসহ ১৬টি শহর এখন বন্দী রয়েছে। কবে খুলবে তা এখনো জানা যায়নি।

বৈশ্বিকভাবে ওষুধের কাঁচামাল তথা অ্যাকটিভ ফার্মাসিউটিক্যাল ইনগ্রেডিয়েন্টের (এপিআই) উৎপাদন ও রপ্তানির কেন্দ্র হুবেই। কমার্শিয়াল কাউন্সিলর চীনের একটি পত্রিকার প্রতিবেদনের বরাত দিয়ে এ বিষয়ে বলেন, এপিআই উৎপাদন এখন বন্ধ। চীনের মোট এপিআই উৎপাদনের সাড়ে ১২ শতাংশ হুবেইতে হয়। অন্য প্রদেশেও এপিআই উৎপাদন স্থগিত আছে। 

বাংলাদেশের পোশাক খাত, চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য এবং কাঁকড়া রপ্তানি ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে বলেও উল্লেখ করা হয় চিঠিতে। তবে বাংলাদেশের আদা–রসুন আমদানিতে খুব একটা সমস্যা হবে না বলে দাবি করেন কমার্শিয়াল কাউন্সিলর। তিনি আরও উল্লেখ করেন, বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রকল্পে কর্মরত চীনা নাগরিকদের মধ্যে যাঁরা সে দেশে ছিলেন, তাঁরা কর্মস্থলে ফিরতে সমস্যায় পড়ছেন।

বাংলাদেশ ওষুধ শিল্প সমিতির মহাসচিব এস এম শফিউজ্জামান গত রাতে প্রথম আলোকে বলেন, সাধারণত ওষুধ কোম্পানিগুলোর কাছে তিন থেকে চার মাসের কাঁচামাল মজুত থাকে। সেটা দিয়ে এখন চলছে। চীনের সমস্যা যদি মার্চ মাসের মধ্যেও মিটে যায়, তাহলে বাংলাদেশের কোনো অসুবিধা হবে না। কিন্তু মার্চের মধ্যে কারখানা না খুললে দেশে ওষুধের একটা ঘাটতি পড়ার আশঙ্কা থেকে যায়। অন্য কোনো উৎস আছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘কিছু কিছু আমরা ভারত থেকে আনি। ভারত আবার মধ্যবর্তী পণ্য আনে চীন থেকে।’

১৩টি খাত
চীনে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব নিয়ে ট্যারিফ কমিশন অন্তর্বর্তী প্রতিবেদনটি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে পাঠায় গত রোববার। এতে ১৩টি খাতে নেতিবাচক প্রভাব পড়ার চিত্র তুলে ধরা হয়। খাতগুলো হলো রপ্তানিমুখী তৈরি পোশাক খাত, চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য, পোশাক খাতের অ্যাকসেসরিজ, প্রসাধন, বৈদ্যুতিক পণ্য, পাট সুতা, মুদ্রণশিল্প, চিকিৎসা সরঞ্জাম, চশমা, কম্পিউটার ও যন্ত্রাংশ, ইলেকট্রনিক পণ্য, কাঁকড়া ও কুঁচে রপ্তানি এবং প্লাস্টিকশিল্প।

ট্যারিফ কমিশন বলছে, ওভেন পোশাকের ৬০ শতাংশ বস্ত্র আসে চীন থেকে। নিট পোশাকের ১৫ থেকে ২০ শতাংশ কাঁচামাল এবং ডাইংয়ের রাসায়নিকের বড় উৎস চীন। চামড়া খাতে সম্ভাব্য ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়াবে ৩ হাজার কোটি টাকা। ইলেকট্রনিক পণ্যের ৮০ শতাংশ আসে চীন থেকে। বিভিন্ন ক্ষেত্রে স্থানীয় বাজারে সংকট পণ্যের দেখা দিচ্ছে বলে উল্লেখ করা হয় প্রতিবেদনে। 

বোঝা যাবে মার্চে
করোনাভাইরাসের প্রভাব ইতিমধ্যে বাংলাদেশের ব্যবসা–বাণিজ্যে পড়তে শুরু করেছে। বাজারে শিল্পের কাঁচামাল, মধ্যবর্তী পণ্য, খুচরা যন্ত্রাংশ, ইলেকট্রিক ও ইলেকট্রনিক পণ্যের মূল্যবৃদ্ধির খবর দিচ্ছেন ব্যবসায়ীরা। অবশ্য পরিস্থিতি এখনো ততটা মারাত্মক নয়। ব্যবসায়ীরা বলছেন, এ মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে আসল প্রভাব পড়বে। কারণ, চীনে নববর্ষের ছুটির কারণে ব্যবসায়ীরা বাড়তি পণ্য কিনে রেখেছিলেন, এ মাসে তাতে টান পড়বে।

দেশের শীর্ষস্থানীয় পোশাক রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান ভিয়েলাটেক্সের চেয়ারম্যান কে এম রেজাউল হাসনাত প্রথম আলোকে বলেন, ‘চীন থেকে কাঁচামাল আমদানি অনেকটা অনিশ্চিত হয়ে গেছে। এখনো তারা আমাদের যথাসময়ে পণ্য সরবরাহের কথা বলছে। কিন্তু কারখানা খোলার অনুমতি পেয়েছে কি না জানতে চাইলেই কোনো উত্তর দেয় না।’ তিনি বলেন, ‘আগামী মাসের প্রথম দিকে আমরা বুঝতে পারব, তারা পণ্য সরবরাহ করতে পারছে কি না।’

একটি মুঠোফোন সংযোজনকারী প্রতিষ্ঠানের প্রধান নির্বাহী নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ জানিয়ে বলেন, চীনা নববর্ষের কারণে তাঁরা আগে থেকেই পণ্য মজুত রেখেছিলেন। এ ছাড়া কারখানা করার কারণে এখন মাস দুয়েকের মজুত সবারই থাকে। সমস্যা আসলে হবে কি না, তা মার্চ মাসে বোঝা যাবে। 

এটা কি সুযোগও
চীনে করোনার প্রভাব দীর্ঘমেয়াদি হলে বাংলাদেশের জন্য সুযোগ দেখছেন কেউ কেউ। ভিয়েলাটেক্সের চেয়ারম্যান রেজাউল হাসনাত বলেন, পোশাক খাতে বস্ত্র ও অ্যাকসেসরিজের অনেক ক্ষেত্রেই বাংলাদেশের সক্ষমতা আছে। কিন্তু ক্রেতাদের শর্তের কারণে চীন থেকে আনতে হয়। তা এখন বাধ্য হয়ে বাংলাদেশ থেকে কিনতে বলতে পারেন ক্রেতারা।

বিনিয়োগ ও রপ্তানি বাণিজ্যে সুযোগ দেখছেন বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো মোস্তাফিজুর রহমানও। তিনি বলেন, ক্রেতারা অনেক দিন ধরেই চীনের পাশাপাশি আরেকটি উৎস দেশের কথা ভাবছিল। একে বলা হতো ‘চায়না প্লাস ওয়ান’ নীতি। শুধু চীনের ওপর নির্ভরশীলতা যে ভালো নয়, এবার তা প্রমাণিত হলো।

মোস্তাফিজুর রহমান তিনটি পরামর্শ দেন। এক. চীনের পরিস্থিতি নিবিড় পর্যবেক্ষণে রাখা ও স্বল্প মেয়াদে অন্য উৎস খোঁজা। দুই. অন্য দেশ থেকে আনতে বাড়তি খরচ পড়বে। এর ফলে মূল্যবৃদ্ধি থেকে ভোক্তা, ব্যবসায়ী ও শিল্প কারখানাকে সুরক্ষা দিতে স্বল্প মেয়াদের জন্য কিছু শুল্ক ছাড় দেওয়া। তিন. চীন থেকে সরে যাওয়া সম্ভাব্য ক্রয়াদেশ ও বিনিয়োগ ধরতে প্রস্তুতি নেওয়া।