দেশে সোয়া দুই কোটি টাকার বেশি সম্পদ মাত্র ১৩ হাজার মানুষের

টাকা। প্রতীকী ছবি
টাকা। প্রতীকী ছবি

১৯৭৫ সালে রাজধানীর অদূরে আশকোনা এলাকায় পাঁচ কাঠা জমি কেনেন অবসরপ্রাপ্ত এক সরকারি কর্মকর্তা। সব মিলিয়ে জমিটির জন্য তাঁর খরচ পড়েছে তিন হাজার টাকা। গত ৪৫ বছরে ওই এলাকায় জমির দাম বহুগুণ বেড়েছে। ফলে ওই জমি বিক্রি করলে এখন অন্তত আড়াই কোটি টাকা পাওয়া যাবে। অথচ সাড়ে চার দশক ধরেই তিনি তাঁর জমির মূল্য দেখান ওই তিন হাজার টাকা। আইনের মারপ্যাঁচে তাঁকে সারচার্জ দিতে হয় না। বাজারমূল্য দেখানোর বিধান থাকলে তাঁর ওপর সারচার্জ প্রযোজ্য হতো।

জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সবশেষ হিসাব অনুযায়ী ২০১৭-১৮ অর্থবছরে দেশে সোয়া দুই কোটি টাকার সম্পদের মালিক, এমন করদাতার সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১২ হাজার ৮২১। তাঁরা সব মিলিয়ে সারচার্জ দিয়েছিলেন ৪৫৯ কোটি টাকা। তবে গত ২০১৮-১৯ অর্থবছরের হিসাব এখনো চূড়ান্ত করেনি এনবিআর। তবে প্রাথমিক হিসাব অনুযায়ী দুই কোটি টাকার বেশি সম্পদ আছে, এমন ১৩ হাজারের বেশি ব্যক্তি গত অর্থবছরে সারচার্জ দিয়েছেন। শিগগিরই গত অর্থবছরের বার্ষিক প্রতিবেদন প্রকাশ করবে এনবিআর।

দেশে ২০১১-১২ অর্থবছর থেকে সারচার্জ আরোপ করা হয়। ওইঅর্থবছর থেকে দুই কোটি টাকার বেশি সম্পদের বিপরীতে সারচার্জ দেওয়ার নিয়ম করা হয়। সে অনুযায়ী ২০১১-১২ অর্থবছরে ৪ হাজার ৪৪৬ জন সারচার্জ দিয়েছেন। সাত বছরের ব্যবধানে এমন ধনীর সংখ্যা তিন গুণ বেড়েছে। অবশ্য এর আগে সম্পদ কর ছিল, যা ১৯৯৭ সালে উঠিয়ে দেওয়া হয়।

চলতি ২০১৯-২০ অর্থবছর থেকে তিন কোটি টাকার বেশি সম্পদ থাকলে তার বিপরীতে সারচার্জ আরোপ করা হয়েছে।

এনবিআরের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সারচার্জ আদায়ের মূল সমস্যা হলো, যে দামে সম্পদ কেনা হয়, সেটিই আয়কর নথিতে দেখাতে হয়। চলতি বাজারমূল্য এখানে বিবেচনা করা হয় না। ফলে বাস্তবে বিপুল বিত্তবৈভবের মালিক হয়েও অনেককে সারচার্জ দিতে হয় না। যেমন রাজধানীর গুলশান, বনানী, ধানমন্ডি, উত্তরার মতো অভিজাত এলাকাগুলোয় অনেকে সত্তর ও আশির দশকে প্লট কিনেছেন। সেখানে তাঁরা বিলাসবহুল ও জাঁকজমকপূর্ণ জীবন যাপন করেন। বিএমডব্লিউ, মার্সিডিজ, পোরশে, লেক্সাসের মতো দামি ব্র্যান্ডের গাড়ি হাঁকিয়ে চলেন। কিন্তু তাঁদের বার্ষিক আয়কর বিবরণীতে এমন সম্পদের বর্তমান প্রকৃত মূল্য না দেখিয়ে কেনা দামই দেখান। আবার বড় ব্যবসায়ীরা যেসব বাড়ি-গাড়ি ব্যবহার করেন, সেগুলো দেখানো হয় তাঁদের কোম্পানির নামে। এতে সম্পদ গোপনই থেকে যায়। আবার উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত জমিজমা, বাড়িসহ সম্পদের মূল্যমান তো নির্ধারণ করাই যায় না।

>

কেনা মূল্যে বছরের পর বছর সম্পদের মূল্য হিসাব করা হয়। এতে বহু করদাতা সারচার্জের বাইরে থেকে যাচ্ছেন।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর প্রথম আলোকে বলেন, প্রথমেই এটি এনবিআরের অদক্ষতা। তাদের কাছে এমন কোনো তথ্যভান্ডার নেই। ফলে তারা বুঝতে পারে না কারা বিপুল সম্পদের মালিক। সম্পদের বাজারমূল্যমান ঠিক করা হয় না বলে সংস্থাটি জানে না কার কাছে কত সম্পদ আছে। কেনা দামকেই সম্পদের মূল্য ধরা হয়। এ কারণে ২০০-৩০০ কোটি টাকার সম্পদের মালিক হয়েও অনেককে কোনো সারচার্জ দিতে হয় না। আবার একটি ছোট ফ্ল্যাটের মালিককে সারচার্জ দিতে হয়। এটি করদাতাদের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ।

এদিকে নতুন আইন ছাড়া সম্পদের মূল্যমান ঠিক করা সম্ভব নয় বলে মনে করেন এনবিআরের সদস্য মেফতাহ উদ্দিন খান। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, সম্পদ কেনার সময় যে দাম দেখানো হয়, তা-ই করদাতারা তাঁদের কর নথিতে দেখান। ফলে সম্পদের বাজারদরে সারচার্জ আদায় করা সম্ভব হয় না। ফলে অনেকেই সারচার্জের আওতার বাইরে থেকে যান। বাজারদরে সম্পদের মূল্যমান নির্ধারণ করতে নতুন আইন লাগবে। এ ধরনের আইন প্রণয়ন সরকারের নীতিগত সিদ্ধান্তের বিষয়।

২০১১-১২ অর্থবছরের পর থেকে দুই কোটি টাকার বেশি সম্পদধারীর সংখ্যা বাড়তে থাকে। যেমন এই সংখ্যা ২০১২-১৩ অর্থবছরে ৫ হাজার ৬৬২; ২০১৩-১৪ অর্থবছরে ১০ হাজার ১৫২, ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ১০ হাজার ৯৩১, ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ১০ হাজার ৬৫৫ এবং ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ১১ হাজার ২৩৪-এ উন্নীত হয়েছে। অবশ্য ২০১৫-১৬ অর্থবছর থেকে সীমা কিছুটা বাড়িয়ে সোয়া দুই কোটি টাকার বেশি সম্পদধারীদের ওপর সারচার্জ বসানো হয়।

এনবিআর কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, মূলত গত সাত বছরে যাঁরা ফ্ল্যাট ও প্লট কিনেছেন, তাঁদের বেশির ভাগই এই তালিকায় ঢুকেছেন।

কোথায় কত সম্পদশালী

 প্রথমবারের মতো একটি কর অঞ্চলে সোয়া দুই কোটি টাকার বেশি সম্পদধারীর সংখ্যা এক হাজার পেরিয়েছে। ঢাকার কর অঞ্চল-১৫-তে সবশেষ ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ১ হাজার ১২ জন করদাতা ৮ কোটি ১৮ লাখ টাকা সারচার্জ দিয়েছেন। ওই কর অঞ্চলে বিভিন্ন কোম্পানির পরিচালকদের বড় অংশ নিবন্ধিত। এ ছাড়া এই কর অঞ্চলে পুরানা পল্টন, নয়াপল্টন, রাজারবাগ, মতিঝিল, শান্তিনগর, খিলগাঁও, শাহজাহানপুর—এসব এলাকার করদাতারা বার্ষিক কর বিবরণী জমা দেন।

সারচার্জ দেওয়া করদাতার সংখ্যায় দ্বিতীয় অবস্থানে আছে কর অঞ্চল-১। সেখানে ৯২১ জন করদাতা ১৭ কোটি ১৭ লাখ টাকা সারচার্জ দেন। ওই কর অঞ্চলেও কোম্পানি পরিচালকেরাই সংখ্যায় বেশি। এ ছাড়া কিছু সরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত করদাতাও আছেন। তৃতীয় স্থানে আছে কর অঞ্চল-১০। সেখানে ৭২৯ জন করদাতা সারচার্জ দিয়েছেন।

দেশের বড় করদাতাদের মধ্যে মাত্র ৪৩০ জন সারচার্জ দেন। তাঁরা অবশ্য কর অঞ্চল হিসেবে সবচেয়ে বেশি প্রায় ১০৮ কোটি টাকা সারচার্জ দিয়েছেন। তাঁরা বৃহৎ করদাতা ইউনিটের (এলটিইউ) করদাতা। তাঁরা বড় বড় কোম্পানির মালিক। এলটিইউ সূত্রে জানা গেছে, এলটিইউয়ের করদাতারা বড় বড় প্রতিষ্ঠানের মালিক বা পরিচালক হওয়ায় তাঁরা প্রতিষ্ঠানের বাড়ি-গাড়ি ব্যবহার করেন। উল্লেখ্য, এলটিইউতে নিবন্ধিত করদাতা আছেন ৭০৬ জন।

সারা দেশের মধ্যে ঢাকা বিভাগেই সোয়া দুই কোটি টাকার বেশি সম্পদের মালিক, এমন ব্যক্তিদের সংখ্যা সর্বোচ্চ। এই বিভাগে এমন করদাতা আছেন ৯ হাজার ৭১১ জন। এ ধরনের করদাতা সবচেয়ে কম রংপুর বিভাগে, মাত্র ১০৯ জন। এ ছাড়া বিভাগীয় হিসাবে দেখা যায়, চট্টগ্রামে ২ হাজার ২৭৭ জন, খুলনায় ২৯৫ জন, রাজশাহীতে ১৯৮ জন, বরিশালে ২১৫ জন, সিলেটে ৩২৮ জন, ময়মনসিংহে ১৩০ জন এমন সম্পদধারী আছেন।