করোনাভাইরাসের ঝুঁকি: কোন পথে হাঁটবে বাংলাদেশ?

বৈদেশিক মুদ্রা আয়ে বাংলাদেশের অন্যতম পথ হচ্ছে পণ্য রপ্তানি। তবে সেই পথে করোনাভাইরাসের পাগলা ঢেউ লেগেছে। শুরুতে চীনা কাঁচামাল ও পণ্যের সংকটের কারণে ছোটখাটো ধাক্কা খেয়েছে কমবেশি সব পণ্য রপ্তানি খাত। মাসখানেক আগেও বিষয়টিকে বড় ধরনের সমস্যা মনে হলেও সেটি ছিল আসলে উপসর্গ। প্রাণঘাতী ভাইরাসটি ইউরোপ-আমেরিকাসহ বিশ্বের এক শর বেশি দেশে ছড়িয়ে পড়ায় বড় দুশ্চিন্তা ভর করেছে।

করোনাভাইরাসের আতঙ্কের কারণে বিশ্বের অনেক দেশের মানুষজন বাইরে কম বের হচ্ছে। ভ্রমণের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে অনেক দেশের সরকার। তাতে পণ্যের বিক্রি কমে যাচ্ছে। বিক্রি কমে গেলে স্বাভাবিকভাবেই পণ্য উৎপাদনের ক্রয়াদেশও কমার আশঙ্কা থাকে। সমস্যার এখানেই শেষ নয়, দেশেও করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয়েছে। বিদেশফেরত অনেককে নিজ বাড়িতে কোয়ারেন্টাইন করে রাখা হচ্ছে। তার মানে, ঘরে-বাইরে সমস্যা তীব্র হচ্ছে। তাতে করোনার ধাক্কা যে কোন পর্যায়ে গিয়ে ঠেকবে, সেটি অনুমান করা মুশকিল হয়ে পড়েছে।

গত ২০১৮-১৯ অর্থবছরে বাংলাদেশ ৪ হাজার ৫৩ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি করে। তখন প্রবৃদ্ধি ছিল সাড়ে ১০ শতাংশের মতো। তবে চলতি ২০১৯–২০২০ অর্থবছরের দ্বিতীয় মাস থেকেই রপ্তানি আয় কমতে থাকে। শেষ পর্যন্ত অর্থবছরের প্রথম আট মাসে (জুলাই-ফেব্রুয়ারি) ২ হাজার ২৯১ কোটি পণ্য রপ্তানি হয়েছে, যা গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ৪ দশমিক ৭৯ শতাংশ। তবে করোনাভাইরাসের কারণে বছর শেষে পণ্য রপ্তানি আয়ের চেহারা আরও খারাপ হতে পারে—অনেক উদ্যোক্তা ইতিমধ্যেই এমন আশঙ্কা প্রকাশ করছেন।

পোশাক রপ্তানির প্রভাব কতটা
মোট পণ্য রপ্তানি আয়ের ৮৩ শতাংশই তৈরি পোশাক খাত থেকে আসে। চলতি অর্থবছর এমনিতেই পোশাক রপ্তানির অবস্থা ভালো নয়। গত মাস পর্যন্ত ২ হাজার ১৮৪ কোটি ডলারের পোশাক রপ্তানি হয়েছে, যা আগের বছরের চেয়ে সাড়ে ৫ শতাংশ কম। তবে নতুন করে দুশ্চিন্তা হয়ে এসেছে করোনাভাইরাস। চীনে গত ডিসেম্বরে ভাইরাসটি প্রথম শনাক্ত হয়। তারপর থেকেই দেশটি থেকে কাপড়, কাঁচামাল ও সরঞ্জাম আসা বাধাগ্রস্ত হয়। তাতে ইতিমধ্যে অনেক পোশাক কারখানায় উৎপাদনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে।

ভালো খবর হচ্ছে, চীনে পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে। শিল্পকারখানা খুলতে শুরু করেছে। তাতে কয়েক দিনের মধ্যে হয়তো কাঁচামালের সংকট থাকবে না। অন্য দিকে খারাপ খবর হচ্ছে, ইউরোপ-আমেরিকাসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে করোনাভাইরাস ব্যাপক হারে ছড়িয়ে পড়েছে। ইতালিতে ভাইরাসে আক্রান্ত মৃত্যুর হার বাড়ছে। ইতালির সরকার পুরো দেশ অবরুদ্ধ করেছে।

গত কয়েক দিনে বেশ কয়েকজন উদ্যোক্তার সঙ্গে কথা হয়েছে। তাঁদের আশঙ্কা, ইউরোপজুড়ে করোনাভাইরাস ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ায় আগামী মৌসুমের ক্রয়াদেশ কমে যাবে। ইতিমধ্যে ক্রেতা প্রতিষ্ঠান ও ব্র্যান্ডের প্রতিনিধিরা সেই ইঙ্গিত দিতে শুরু করেছেন।

উদ্যোক্তাদের এই আশঙ্কা হয়তো সত্য হবে, হয়তো হবে না। শঙ্কার সঙ্গে অল্প কিছু সম্ভাবনাও আছে। করোনার কারণে চীনের পরিস্থিতি যে জটিল আকার ধারণ করেছে, তাতে অনেক ক্রেতা প্রতিষ্ঠানই তাদের ক্রয়াদেশের একটা অংশ অন্য দেশে স্থানান্তর করতে চাচ্ছে। ফলে সেই ক্রয়াদেশের একটি অংশ বাংলাদেশে আসার সুযোগ রয়েছে। সে জন্য উদ্যোক্তাদের প্রস্তুত থাকতে হবে।

দেশের বাইরের পরিস্থিতির সঙ্গে দেশের বিষয়টিও গুরুত্বের সঙ্গে নিতে হবে। কারণ, বাংলাদেশে ইতিমধ্যে করোনায় আক্রান্ত রোগী শনাক্ত করা হয়েছে। পোশাক কারখানাগুলো ঝুঁকির মধ্যে আছে। কারণ, অনেক কারখানায় হাজার হাজার শ্রমিক একসঙ্গে কাজ করেন। এক মুহূর্ত বিলম্ব না করে উদ্যোক্তাদের উচিত নিজ নিজ কারখানায় সর্বোচ্চ নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা নেওয়া। শ্রমিকদের সচেতন করা দরকার প্রতিদিন। করোনাভাইরাসের কারণে কারখানার উৎপাদন বাধাগ্রস্ত হলে বর্তমান ক্রয়াদেশের কাজ শেষ করা যাবে না। অন্যদিকে ভবিষ্যতে ক্রয়াদেশ আসার কোনো সম্ভাবনা থাকলে সেটিও নষ্ট হবে। এটির খেসারত অনেক বড়।

করোনার কারণে চীনের কাঁচামাল সংকটের বিষয়টি ভুলে গেলে চলবে না। এখান থেকে শিক্ষা নিয়ে হবে উদ্যোক্তাদের। পশ্চাৎমুখী শিল্পকারখানা স্থাপনে নতুন বিনিয়োগ করতে হবে। এ ছাড়া পোশাক রপ্তানিকে টেকসই করতে হলে বস্ত্র খাতে বড় বিনিয়োগকে উৎসাহিত করতে হবে। সে ক্ষেত্রে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের অগ্রাধিকার দেওয়া উচিত। দীর্ঘদিন ধরেই পোশাক ও বস্ত্র খাতে বিদেশি বিনিয়োগকে নানাভাবে নিরুৎসাহিত করেছেন দেশীয় উদ্যোক্তারা। বর্তমান পরিস্থিতিতে সেখান থেকে সরে না এলে বাংলাদেশের বড় বিপদ সামনে।

ট্যানারিতে চামড়ার স্তূপ
দেশের চতুর্থ সর্বোচ্চ রপ্তানি আয় চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য থেকে আসে। তবে বৈশ্বিক সংস্থা লেদার ওয়ার্কিং গ্রুপের (এলডব্লিউজি) অনুমোদন ব্যতীত অন্য কোনো ট্যানারি থেকে চামড়া কেনে না ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রের বড় ব্র্যান্ডগুলো। তবে সেটি অর্জন করতে পারেনি সাভারের চামড়াশিল্প। কারণ, কেন্দ্রীয় বর্জ্য পরিশোধনাগারের (সিইটিপি) কাজই পুরোপুরি শেষ হয়নি। তাই আমদানি করা চামড়ার ওপর অধিকাংশ জুতা রপ্তানিকারককে নির্ভর করতে হচ্ছে। অন্যদিকে ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্র রপ্তানির সুযোগ না থাকায় বাংলাদেশি চামড়ার বড় ক্রেতা হয়ে উঠেছে চীন।

চীনের ওপর অতিনির্ভরতার কারণে ইতিমধ্যে ট্যানারিগুলো বিপদে পড়েছে। করোনাভাইরাস প্রাদুর্ভাবের পর চীনা ক্রেতারা চামড়া নেওয়া সাময়িকভাবে বন্ধ রেখেছে। তাতে ট্যানারিগুলোতে চামড়ার স্তূপ জমছে। পরিস্থিতি আরও কিছুদিন দীর্ঘস্থায়ী হলে অনেক ট্যানারি উৎপাদন বন্ধ করতে বাধ্য হবেন বলে জানিয়েছেন কয়েকজন ট্যানারিমালিক।

বর্তমান অবস্থায় হয়তো অনেকেই হয়তো বলবেন, কিছুই করার নেই। তবে কেন ১৭ বছরেও সাভারের চামড়াশিল্প নগরী কেন শেষ হলো না? কেন এলডব্লিউজি সনদ নেওয়ার জন্য প্রস্তুতি শেষ করা গেল না? এসব হলে তো রপ্তানি বাজার সংকুচিত হতো না। দেশের বৈদেশিক মুদ্রার আয় বাড়ত।

বর্তমানে করোনাভাইরাস পরিস্থিতি যেদিকে যাচ্ছে, তাতে সব রপ্তানি খাতই কমবেশি আক্রান্ত হওয়ার শঙ্কা রয়েছে। এই অবস্থায় রপ্তানি আয় একটা পর্যায়ে ধরে রাখতে হলে চিন্তাভাবনা করে পদক্ষেপ নিতে হবে। উদ্যোক্তাদের দায়িত্বশীল আচরণ করতে হবে। কোনো সংকট তৈরি হলেই দেখা যায়, উদ্যোক্তারা সহজ পথে হাঁটেন। সরকারের কাছে নগদ সহায়তা চেয়ে বসেন। সরকারও অনেক ক্ষেত্রে সেই আবদারে সায় দেয়। তাতে সাময়িক কিছু লাভ হলেও দীর্ঘস্থায়ী সুফল পাওয়া যায় না।

করোনার বর্তমান সংকটটি বিশ্বব্যাপী। ফলে সহজ পথে হাঁটার সুযোগ নেই। কোন পথে হাঁটলে পা পিছলে পড়বে না, সেই পথের সন্ধানে এখনই সরকার, অর্থনীতিবিদ, গবেষক ও উদ্যোক্তাদের এক টেবিলে বসতে হবে। উদ্যোক্তা বলতে কেবল পোশাক খাতের নয়, সব খাতের। এই কথা বলার কারণ, গত সপ্তাহে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবজনিত বাণিজ্য পরিস্থিতি পর্যালোচনাসংক্রান্ত উচ্চপর্যায়ের এক সভায় উপস্থিত ছিলেন কেবল তৈরি পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন—বিজিএমইএ ও বিকেএমইএর প্রতিনিধিরা। সেখানে এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি থাকলেও অন্য কোনো রপ্তানি খাতের প্রতিনিধি ছিলেন না।