বড় সংকটের পথে পোশাক খাত

প্রথম আলো ফাইল ছবি
প্রথম আলো ফাইল ছবি

করোনাভাইরাসের কারণে তৈরি পোশাক রপ্তানির ক্রয়াদেশ বাতিল ও স্থগিতাদেশের পরিমাণ প্রতিদিনই বাড়ছে। গতকাল বুধবার পর্যন্ত ৮৪ পোশাক কারখানার ১০ কোটি মার্কিন ডলারের ক্রয়াদেশ বাতিল ও স্থগিত হয়েছে, যা দেশীয় মুদ্রায় ৮৫০ কোটি টাকার কাছাকাছি।

পোশাক রপ্তানির বড় বাজার ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রে করোনা ভাইরাস ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ায় আরও ক্রয়াদেশ বাতিল ও স্থগিত হওয়ার আশঙ্কা করছেন এ শিল্পের উদ্যোক্তারা। তাঁরা বলছেন, একের পর এক চলমান ক্রয়াদেশ স্থগিত করছে ক্রেতারা। বাতিলের সংখ্যাও বাড়ছে। নতুন ক্রয়াদেশও আসছে না। এমনটা চলতে থাকলে কারখানা বন্ধ করে দেওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় থাকবে না। 

করোনার কারণে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে নিজেদের সদস্যের কাছ থেকে ক্রয়াদেশ বাতিল ও স্থগিতাদেশের তথ্য নিচ্ছে পোশাকশিল্প মালিকদের দুই সংগঠন বিজিএমইএ ও বিকেএমইএ। গত মঙ্গলবার বিজিএমইএ আনুষ্ঠানিকভাবে ২০ কারখানার ২ কোটি ৭২ লাখ ডলারের ক্রয়াদেশ বাতিল ও স্থগিত হওয়ার তথ্য পায়। গতকাল বিকেল পর্যন্ত মোট ৬৯ কারখানার ৯ কোটি ৩০ লাখ ডলারের ক্রয়াদেশ বাতিল ও স্থগিত হয়েছে। অন্যদিকে গত রাতে বিকেএমইএ জানায়, ১৫ কারখানার ৭৩ লাখ ৮৭ হাজার ডলারের ক্রয়াদেশ স্থগিত হয়েছে। 

চীনে গত বছরের নভেম্বরে প্রথম করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব দেখা যায়। গতকাল পর্যন্ত ভাইরাসটি ১৫৯টি দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। ভাইরাসটির কারণে ইতালি, স্পেন, ফ্রান্স ও যুক্তরাষ্ট্রে জরুরি অবস্থা জারি করা হয়েছে। জার্মানিও ধুঁকছে। দেশগুলোতে নিত্যপণ্য ছাড়া অন্যান্য দোকানপাট ও প্রতিষ্ঠান বন্ধ। অতি জরুরি প্রয়োজন ছাড়া লোকজন বাইরে বের হচ্ছেন না। অনেক পোশাকের ব্র্যান্ড তাদের শত শত বিক্রয়কেন্দ্র ঘোষণা দিয়ে বন্ধ রেখেছে। 

করোনাভাইরাস ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়া ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) দেশগুলো বাংলাদেশি পোশাকের বড় বাজার। গত ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৩ হাজার ৪১৩ কোটি ডলারের পোশাক রপ্তানি হয়েছে। তার মধ্যে ৬১ দশমিক ৯১ শতাংশ বা ২ হাজার ১১৩ কোটি ডলারের পোশাকের গন্তব্য ছিল ইইউভুক্ত দেশ। আর যুক্তরাষ্ট্রে গেছে ৬১৩ কোটি ডলারের পোশাক। 

চট্টগ্রামের ডেনিম এক্সপার্ট লিমিটেডের ২০ লাখ ডলার সমমূল্যের ৪টি ক্রয়াদেশ স্থগিত করেছে ক্রেতাপ্রতিষ্ঠান। প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোস্তাফিজ উদ্দিন গত রাতে বিষয়টি নিশ্চিত করে প্রথম আলোকে বলেন, ক্রেতারা একের পর এক ক্রয়াদেশ স্থগিত ও বাতিল করছে। নতুন ক্রয়াদেশ দিচ্ছে না। অবস্থা যে পর্যায়ে যাচ্ছে, তাতে বড় কারখানায় দুই মাস পর কোনো কাজ থাকবে না। ছোট ও মাঝারি কারখানা তার আগেই বসে যাবে।

মোস্তাফিজ উদ্দিন বলেন, এইচঅ্যান্ডএম, সিঅ্যান্ডএ, এমঅ্যান্ডএসের মতো বড় ক্রেতা প্রতিষ্ঠান চলমান ক্রয়াদেশ বাতিল করছে না। তারা বাতিল করছে ভবিষ্যতের ক্রয়াদেশ। তবে ছোট ছোট অনেক প্রতিষ্ঠান চলমান ক্রয়াদেশ বাতিল করে দিচ্ছে। তিনি আরও বলেন, করোনার কারণে ইউরোপের ক্রেতারাই মূলত ক্রয়াদেশ স্থগিত ও বাতিল করছে। তবে আজ-কালের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের ক্রেতারা সেই পথে হাঁটতে পারেন। 

>৮৪ পোশাক কারখানার ১০ কোটি মার্কিন ডলারের ক্রয়াদেশ বাতিল ও স্থগিত হয়েছে

নিট পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএর প্রথম সহসভাপতি মোহাম্মদ হাতেম গতকাল বলেন, ‘ইউরোপের ব্র্যান্ড ও ক্রেতা প্রতিষ্ঠান আজকে (গতকাল) পর্যন্ত আমাদের সদস্য কারখানার ৭৩ লাখ ডলারের ক্রয়াদেশ স্থগিত করছে। আশঙ্কা করছি, আজ সেটি ১ কোটি ডলারে চলে যাবে। স্থগিত হওয়া ক্রয়াদেশের ভবিষ্যৎ কী হবে, সেটি আমরা জানি না।’

জানতে চাইলে বিজিএমইএর সহসভাপতি আরশাদ জামাল বলেন, ‘আমরা ক্রয়াদেশ স্থগিত ও বাতিলের যতটুকু তথ্য পাচ্ছি, বাস্তব পরিস্থিতি তার থেকেও ভয়াবহ। গ্রীষ্ম মৌসুমে ব্র্যান্ডগুলো বড় ব্যবসা করে থাকে। তার আগ মুহূর্তে করোনা আঘাত হেনেছে। ইউরোপে এইচঅ্যান্ডএমের ৬২ শতাংশ বিক্রয়কেন্দ্র বন্ধ। ফলে সামনে আমাদের জন্য কী আছে, বলা যাচ্ছে না।’ তিনি বলেন, সরকারের উচিত সবার আগে মানুষকে বাঁচানো। তারপর দেশের শিল্পকে বাঁচাতে কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে। 

এদিকে শ্রম অধিকার নিয়ে কাজ করা সংগঠনের আন্তর্জাতিক জোট ক্লিন ক্লথ ক্যাম্পেইন (সিসিসি) পোশাকশ্রমিকের স্বাস্থ্য ও জীবনযাত্রার ওপর করোনাভাইরাসের প্রভাব সীমিত পর্যায়ে রাখতে ক্রেতাদের জরুরি ভিত্তিতে উদ্যোগ নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে। মঙ্গলবার এক বিজ্ঞপ্তিতে সিসিসি বলেছে, করোনার কারণে বিক্রয়কেন্দ্র বন্ধ ও চাহিদা কমে যাওয়ায় ক্রেতারা ক্রয়াদেশ হ্রাস করতে থাকলে অনেক কারখানা সাময়িকভাবে বন্ধ হতে পারে। সেই পরিস্থিতিতে শ্রমিকের মজুরি নিয়মিত পরিশোধের বিষয়টি ক্রেতাদের নিশ্চিত করতে হবে। করোনায় আক্রান্ত কিংবা লক্ষণ দেখা গেলে সংশ্লিষ্ট শ্রমিককে সবেতনে ছুটি দেওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে।