ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পে বিশেষ মনোযোগ দরকার

নাজনীন আহমেদ
নাজনীন আহমেদ

এ কথা এখন স্পষ্ট যে কোভিড-১৯-এর প্রভাবে বিশ্ব অর্থনীতি ঝুঁকির মুখে পড়তে যাচ্ছে। সে ঝুঁকি মোকাবিলায় বিভিন্ন দেশ, বিশ্বব্যাংক, ইউরোপিয়ান কমিশনসহ নানা সংস্থা জরুরি তহবিলের নানান অর্থনৈতিক প্রণোদনার ঘোষণা দিয়েছে। বাংলাদেশের অর্থনীতির ভবিষ্যৎ স্বাস্থ্য নিয়ে জরুরি ভিত্তিতে পদক্ষেপের সময় এসে গেছে। এ ক্ষেত্রে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের প্রতি বিশেষ মনোযোগ দরকার।

২০১৩ সালে রানা প্লাজা ট্র্যাজেডির পর বড় শিল্পোদ্যোক্তাদের রক্ষায় যে ধরনের সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হয়েছিল, তাতে ঘুরে দাঁড়াতে পেরেছে তৈরি পোশাক খাত। এবারের করোনাভাইরাসের অর্থনৈতিক প্রভাবের নির্মম কশাঘাত আসবে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের ওপর। যদি না আমরা কিছু পদক্ষেপ না নিই।

২০১৩ সালের সর্বশেষ বাংলাদেশের শিল্পনীতি–২০১৬ সালের সংজ্ঞা অনুযায়ী ১৬ থেকে ৩০০ জন পর্যন্ত কর্মীর প্রতিষ্ঠান অণু, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের অন্তর্ভুক্ত। ২০১৯ সালের শিল্প খাতের জরিপ অনুযায়ী দেশে ৪৬ হাজার ২৯১টি শিল্পপ্রতিষ্ঠান আছে (এতে গৃহকেন্দ্রিক প্রতিষ্ঠান অন্তর্ভুক্ত নয়), যার ৯৩ ভাগই অণু, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পপ্রতিষ্ঠান। এই জরিপ অনুযায়ী অণু, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প খাতে কর্মসংস্থানের ৩১ দশমিক ৫ শতাংশ। অণু, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পপ্রতিষ্ঠানে বা এমএসএমইর অবদান জিডিপির ৪ দশমিক ৮৫ শতাংশ। এ খাতের উদ্যোক্তাদের আয় ও সঞ্চয় সীমিত। ঝুঁকি মোকাবিলার সক্ষমতাও কম। ফলে অর্থনীতির গতি-প্রকৃতির যে ঝুঁকিগুলো বর্তমানে দেখা যাচ্ছে, সেগুলো বিবেচনায় এনে এই শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোর প্রবৃদ্ধি, এমনকি টিকে থাকার কথা আমাদের ভাবতে হবে! 

এমএসএমইগুলো মূলত দেশের অভ্যন্তরীণ বাজারের জন্য উৎপাদন করে। কাজেই অভ্যন্তরীণ বাজারের চাহিদার ওপর তাদের আয় অনেকাংশেই নির্ভরশীল। এই সময় যেহেতু নানা শিল্পপণ্যের চাহিদা কমে গেছে, তাই এসব প্রতিষ্ঠান সমস্যায় পড়তে পারে। যেমন, স্বাধীনতা দিবস, পয়লা বৈশাখকে ঘিরে বিভিন্ন এমএসএমইর যেমন বেচাকেনা হওয়ার কথা ছিল, তা কিন্তু এবার হবে না। আবার কেভিড-১৯–এর প্রভাব অনিশ্চিত হওয়ায় উৎপাদনকারীরা বুঝতে পারছেন না এ বছর পণ্যের চাহিদা কেমন হবে। এভাবে পণ্যের চাহিদা ঝুঁকির মুখে থাকায় বিপাকে পড়তে যাচ্ছে দেশের এমএসএমইগুলো। এ পরিপ্রেক্ষিতে নিম্নলিখিত পদক্ষেপগুলো বিবেচনা করা যায়:

এমএসএমই উদ্যোক্তাদের ঋণ পুনঃ তফসিলের বিষয়টি সহৃদয়তার সঙ্গে ভাবতে হবে। নিদেনপক্ষে এ খাতের ঋণকারীদের সময়সীমা এক বছর বাড়ানোর কথা ভাবা যেতে পারে। এর পাশাপাশি অথবা বিকল্প হিসেবে একটি তহবিল গড়ে তোলা, যেখান থেকে অতি অল্প সুদে এমএসএমইদের ঝুঁকি মোকাবিলা ঋণ প্রদান করা হবে। এখানে বলে রাখা ভালো, সম্প্রতি সরকার যে উদ্যোগ নিয়েছে, জুন মাস পর্যন্ত ঋণ শ্রেণীকরণ বন্ধ রাখার, তাতে কিন্তু দেশীয় বাজারভিত্তিক এমএসএমইদের খুব বেশি সুবিধা হবে না। বরং যাঁরা রপ্তানিকৃত পণ্যের মূল্য পরিশোধ না হওয়ার কারণে ব্যাংকঋণ শোধ করতে পারছেন না, তাঁদের সুবিধা হবে। কিন্তু এমএসএমইগুলো তাদের পণ্য নিকট ভবিষ্যতে কতটা বিক্রি করতে পারবে, তা নিয়ে শঙ্কায় আছে। পণ্যের চাহিদা না থাকলে, তাদের পণ্যের বিক্রি না হলে তখন তারা কিন্তু জুন মাসের মধ্যেও ব্যাংকের পাওনা পরিশোধ করে খেলাপি হওয়া থেকে রেহাই পাবে না। তাই তাদের জন্য ঋণ পুনঃ তফসিল করার দরকার হতে পারে। এদের জন্য জরুরি তহবিলও দরকার।

বিপণনব্যবস্থায় সহায়তার জন্য অনলাইনে কেনাকাটার মালামাল পৌঁছানো যেন সহজ ও নিরাপদ হয়, সে জন্য মালামাল সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে স্বাস্থ্য ঝুঁকি মোকাবিলায় সতর্ক হয়ে পণ্য পৌঁছাতে হবে। এর পাশাপাশি মোবাইলভিত্তিক আর্থিক লেনদেন নগদ বিকাশ করেই এরা অনলাইন কেনাকাটায় বিশেষ সুবিধা দিতে পারে।

সর্বোপরি এমএসএমইর পণ্য উৎপাদননির্ভর করবে বাজারের সার্বিক চাহিদার ওপর। চাহিদাকে চাঙা রাখতে কর্মী ছাঁটাই যাতে না হয়, সে জন্য নানা প্রতিষ্ঠানকে আহ্বান জানাতে হবে। আপৎকালীন ভোগ-ঋণ সহজ সুদে দেওয়ার ব্যবস্থা করা যায়। সরকারের ৯ শতাংশ ব্যাংকসুদের বাস্তবায়নে ভোগ-ঋণকে বাদ দেওয়ার পরামর্শ দিয়ে আসছিলাম এ যাবৎ। তবে বর্তমান পরিস্থিতিতে স্বল্পমেয়াদি ভোগ-ঋণ অল্প সুদে প্রদান করা যুক্তিসংগত হবে। যদি চলমান স্থবিরতা আরও দুই মাস চলতে থাকে।

সময়টা অস্থির, কিঞ্চিৎ অনিশ্চিত। সাম্প্রতিককালের চিন্তিত অর্থনৈতিক অবস্থায় অধিক দুশ্চিন্তার কালোছায়া যুক্ত হয়েছে। ভাবতে হবে সবার কথাই। তবে দুর্যোগে যেন দুর্বলের প্রতি মনোযোগ বেশি থাকে, সে প্রত্যাশাই করছি।

নাজনীন আহমেদ
জ্যেষ্ঠ গবেষক, বিআইডিএস