স্বাস্থ্যসংকটে প্রস্তুতি নেওয়া হয়নি, অর্থনৈতিক সংকটে যেন তা না হয়

হোসেন জিল্লুর রহমান
হোসেন জিল্লুর রহমান

তিন ধরনের জনগোষ্ঠী করোনাভাইরাসের কারণে জোরালো অর্থনৈতিক ক্ষতির সম্মুখীন হবে বলে আমার মনে হয়। একটা গোষ্ঠী হলো যাদের উৎপাদিত পণ্যের বাজার পুরোপুরি বিদেশের ওপর নির্ভরশীল। ছোট আকারেই বলি। যেমন সাতক্ষীরা অঞ্চল থেকে কাঁকড়া রপ্তানি হয়। এর প্রধান বাজার চীন। আমাদের অর্থনীতির ভেতর এমন যারা পুরোপুরি বিদেশি চাহিদার ওপর নির্ভরশীল, তারা ইতিমধ্যে ক্ষতির মুখে পড়েছে বা পড়বে। এ গোষ্ঠীর মধ্যে বড় হলো তৈরি পোশাকশিল্প।

সম্ভাব্য ক্ষতির মুখে পড়া দ্বিতীয় গোষ্ঠী হলো অর্থনৈতিক উদ্যোক্তা, যাদের সরবরাহ চেইন বিদেশ থেকে আমদানি করা কাঁচামাল, মেশিনারিজ—এসবের ওপর নির্ভরশীল। এই সাপ্লাই চেইন করোনাভাইরাসের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

তৃতীয় এবং বলা যায় সবচেয়ে বড় ক্ষতিগ্রস্ত গোষ্ঠী হলো, যাদের জীবিকা অভ্যন্তরীণ চাহিদার ওপর নির্ভরশীল। এদের মধ্যে নিম্নবিত্ত বা নিম্নমধ্যবিত্ত শ্রেণি আছে। যেমন রিকশাচালকদের কথা ধরা যাক। ঢাকা শহরে যদি রিকশা চড়ার মানুষ না থাকে, তবে তাঁর আয় হবে না। আমি খোঁজ নিয়ে দেখেছি, ইতিমধ্যে ঢাকার রিকশাচালকদের অনেকে এখানে কাজ পাচ্ছেন না দেখে এলাকায় ফিরে কাজের চেষ্টা করছেন। ছোট দোকানির কথা বলা যায়। চাহিদা না থাকায়, পণ্য বিক্রি না হলে এসব মানুষও ক্ষতির মুখে পড়বেন। এমন সেবা খাতের অনেক মানুষের ওপর আসলে ক্রমিক প্রভাব হবে। সেবা খাতটাই বেশি ক্ষতিগ্রস্ত ইতিমধ্যে হয়েছে, আরও হবে। আসল কথা হলো শ্রম দিয়ে যেসব মানুষের জীবন চলে, তাদের ওপর বড় প্রভাব পড়বে। শিল্পের আগে আমাদের এই সেবা খাত আক্রান্ত হয়েছে। শ্রমনির্ভর মানুষেরা অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়বে। পরিবহনসেবা ইতিমধ্যে ধাক্কা খেয়েছে। সেটাও এই সেবা খাতের মধ্যে পড়ে। আমাদের দেশে প্রথম ধাক্কা খেয়েছে পর্যটনশিল্প। এ শিল্পের সঙ্গে যুক্ত ভাড়ায়চালিত গাড়ির খাতটি সমস্যায় পড়েছে ইতিমধ্যে।

আমাদের সম্ভাব্য ক্ষতিগ্রস্ত গোষ্ঠীর মধ্যে তৈরি পোশাক খাতের মালিকদের একটি বড় প্ল্যাটফর্ম আছে। তাদের বক্তব্য ইতিমধ্যেই শোনা গেছে। কিন্তু সাধারণ মানুষ, দরিদ্র জনগোষ্ঠী, শ্রমজীবী মানুষ, তাঁরা কিন্তু তাঁদের কথা ভালোভাবে বলতে পারবেন না। তাঁদের জন্য অর্থনীতিবিদ, নীতিনির্ধারকদের এগিয়ে আসতে হবে। তাঁদের সমস্যা তুলে ধরা জরুরি। ইতিমধ্যে অনেক পোশাক কারখানার ক্রয়াদেশ বাতিল হয়েছে। এটা সত্যি। এ সমস্যার দিকে দৃষ্টি দিতে হবে। কিন্তু অনানুষ্ঠানিক খাতে যে লাখ লাখ মানুষ আছে, তাঁদের বিষয়টি যেন অন্য আলোচনার মধ্যে হারিয়ে না যায়, সেদিকে বেশি দৃষ্টি দিতে হবে।

এসব গোষ্ঠীকে অনিশ্চয়তার মধ্যে থেকে কীভাবে সহায়তা দেওয়া যায়, সে বিষয়ে জানা দরকার। সে বিষয়ে আলোচনা করা জরুরি। এ ক্ষেত্রে সরকারের অত্যন্ত জোরালো পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন। যদিও সরকারের সে ধরনের উদ্যোগ দেখছি না। এই মুহূর্তে আমরা স্বাস্থ্যসংকটটা নিয়ে বেশি কথা বলছি। তাই অর্থনৈতিক সংকটটা হয়তো জোরালোভাবে উঠে আসছে না। কিন্তু ভুক্তভোগীরা এর মাশুল দিচ্ছেন। করোনার কারণে এবার যে অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে, সেটা ২০০৮-০৯ সালে বৈশ্বিক আর্থিক সংকটের চেয়ে ভিন্নতর। ২০০৮-০৯ সালে বিশ্ব পুঁজিবাদী ব্যবস্থার একটা দুর্বলতার জন্য আবাসনশিল্প একটা অস্থির জায়গায় চলে গিয়েছিল। সেটার সূত্র ধরেই সংকটটা তৈরি হয়েছিল। এবারের সংকট থেকে আমরা ঘুরে দাঁড়াতে পারব কি না, তা নির্ভর করছে এর স্থায়িত্ব কত দিন হবে, তার ওপর। আগামী এপ্রিল ও মে মাসের মধ্যে যদি প্রকোপ শেষ হয়ে যায়, তাহলে একটা অবস্থা হবে। কিন্তু এর পরে গেলে বড় বিপর্যয়ের মধ্যে চলে যাব আমরা।

আমাদের অর্থনীতির একটা বড় শক্তি হলো প্রবাসী আয়। করোনার কারণে এর নেতিবাচক প্রভাব এই মুহূর্তে না পড়লেও পরে পড়বে। সংকটের এই মুহূর্তে এখন একটা প্রয়োজনীয় বিষয় হলো তথ্য। বিদেশ থেকে কে এল, কোথায় এল, তাদের সম্পর্কে তথ্য জানাটা জরুরি। তথ্যের বিষয়ে মনোযোগী হওয়াটা এই মুহূর্তের সবচেয়ে জরুরি কাজ। এটার ভিত্তিতে ভবিষ্যতে করণীয় ঠিক করা হবে। ক্ষতিগ্রস্ত মানুষকে সহায়তা দেওয়ার বিষয়ে তথ্য না থাকলে কারচুপি, অপচয় ইত্যাদি দেখা দেবে। 

তথ্যভান্ডার তৈরি করতে হবে, এটা ঠিক আছে। কিন্তু ইতিমধ্যে তথ্যের বিশ্বাসযোগ্যতার একটা সংকট তৈরি হয়েছে। এটা আরও মারাত্মক। তথ্য না থাকা একটা সমস্যা। আর তথ্যের বিশ্বাসযোগ্যতার ঘাটতি আরেকটি সমস্যা। এটা সৃষ্টি হলে মানুষ কোনো কিছুর ওপর ভরসা রাখতে পারে না। সরকারি পর্যায়ে তথ্য দেওয়ার ক্ষেত্রে, কোনো মন্তব্য করার ক্ষেত্রে অনেক বেশি নিয়মানুবর্তী হওয়া উচিত। সরকারের বিভিন্ন মানুষের নানা ধরনের কথাবার্তায় বিশ্বাসযোগ্যতার ঘাটতি তৈরি হচ্ছে। বিশ্বাসযোগ্যতার ঘাটতির কারণেই আতঙ্ক বাড়ছে।

স্বাস্থ্যের বিষয়ে আমরা আগাম প্রস্তুতি নিতে পারিনি। এটা পরিষ্কার। সম্ভাব্য অর্থনৈতিক সংকটের ক্ষেত্রে আমরা যেন একই ভুল না করি। সুনির্দিষ্ট খাত ধরে কী ধরনের সহায়তা দেওয়া যায়, তা নির্ধারণ করতে হবে। এটা আর্থিক প্রণোদনা হতে পারে, নীতিসহায়তাও হতে পারে। এই মুহূর্তে সরকারের আমলাতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে সহায়তার চিন্তা না করে একটা আলোচনা করা দরকার। যারা ক্ষতিগ্রস্ত, তাদের সঙ্গে আলোচনা করা উচিত, সবার কথা শোনা উচিত। শোনার কাজটা আবার শুধু সরকারের ওপর ছেড়ে দিলে চলবে না। অর্থনীতিবিদেরাও তো উদ্যোগ নিতে পারেন। যেসব প্রতিষ্ঠান সংগঠিত, তারাও উদ্যোগ নিতে পারে। শুধু সরকারের দিকে চেয়ে বসে থাকাটা ঠিক হবে না।

হোসেন জিল্লুর রহমান
নির্বাহী চেয়ারম্যান, পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টার (পিপিআরসি)