যেভাবে বাড়ছে চালের দাম

চালের ছবিটি প্রতীকী।
চালের ছবিটি প্রতীকী।

সরকারি হিসাবে দেশে এ বছর চাহিদার তুলনায় ৩৫ লাখ টন চাল উদ্বৃত্ত। তাই বাড়তি চালের কিছু অংশ রপ্তানির উদ্যোগ নিয়েছিল সরকার। এ জন্য ১৫ শতাংশ ভর্তুকিও ঘোষণা করা হয়। কিন্তু এখন, যখন বাজারে চালের চাহিদা সবচেয়ে বেশি, তখনই সরবরাহে টান পড়েছে। ফলে দাম বাড়ছে লাফিয়ে লাফিয়ে।

বাজারে এখন মোটা চালের দাম উঠেছে প্রতি কেজি সর্বনিম্ন ৩৮ থেকে ৪০ টাকায়, যা সপ্তাহ দেড়েক আগেও সর্বনিম্ন ৩২ টাকা ছিল। জনপ্রিয় সরু মিনিকেট চালের দাম বেড়ে প্রতি কেজি ৫৬ থেকে ৬০ টাকায় উঠেছে। এ ক্ষেত্রে বাড়তি ৫ থেকে ৬ টাকা। মাঝারি বিভিন্ন চালের দামও কেজিতে চার-পাঁচ টাকা বেড়েছে।

সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) তথ্য অনুযায়ী গত ১০ দিনে মোটা চালের দাম ২৬ শতাংশের মতো বাড়তি।

আরেকটু পেছনে তাকালে দেখা যাবে, চালের দাম ধাপে ধাপে বেড়ে এ পর্যায়ে এসেছে। গত নভেম্বর মাসেও বাজারে সরু মিনিকেট চাল ৪৪ থেকে ৪৫ টাকা কেজি ছিল। নভেম্বরের শেষের দিকে সেটা বেড়ে ৫০ টাকার আশপাশে দাঁড়ায়।
এরপর আরেক দফা বেড়ে ৫৩-৫৪ টাকা হয়। বাকিটা বাড়ল করোনাভাইরাসের আতঙ্কে বাড়তি কেনাকাটার কারণে।

বাজারে আতঙ্কের কেনাকাটার চাপ এখন কিছুটা কমেছে। তাই পেঁয়াজ, রসুন ও আদার দাম কিছুটা কমতি। কিন্তু চাল ব্যবসায়ীরা স্বস্তির খবর দিতে পারছেন না। তাঁরা বলছেন, সরবরাহ এখনো কম। দাম চড়াই আছে। তাঁরা এ-ও বলছেন, বিপুল চাল থাকলে সরবরাহ কম কেন? কারণ, কুষ্টিয়া অথবা উত্তরবঙ্গ থেকে চালের ট্রাক দুপুরে রওনা দিলে রাতে ঢাকায় এসে পৌঁছে যায়।

পুরান ঢাকার চালের মোকাম বাবুবাজারের একজন আড়তমালিক নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ জানিয়ে বলেন, এতটা উদ্বৃত্ত আছে বলে মনে হয় না।

>

সরকারি হিসাবে এ বছর ৩৫ লাখ টন চাল উদ্বৃত্ত
পাইকারি ব্যবসায়ীরা বলছেন, সরবরাহে টান পড়ায় দাম বাড়তি

সরু চালের দাম এখন ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসের সংকটকালের কাছাকাছি। ওই বছর বন্যায় বোরো মৌসুমে চালের আবাদ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তাতে বাজারে দাম ব্যাপকভাবে বেড়ে যায়। মৌসুম শেষে দেখা যায়, আগের বছরের তুলনায় ওই বছর চালের উৎপাদন কম হয়েছিল প্রায় ১১ লাখ টন। এ বছর কিন্তু উৎপাদন পরিস্থিতি একেবারেই ভিন্ন। আগের বছরের তুলনায় ১১ লাখ টন উৎপাদন বেড়েছে। দুই বছরে বেড়েছে ২৭ লাখ টন।

বাজারে চালের দাম বেড়ে যাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে গত বুধবার সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার। তিনি বলেন, চালের কোনো সংকট নেই, বরং মজুত পর্যাপ্ত।

ভর্তুকি দিয়েও পিছু হটা

চাল রপ্তানিতে বেশি আগ্রহী ছিল কৃষি মন্ত্রণালয়। গত বছরের ২২ সেপ্টেম্বর বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে একটি সভায় এ বিষয়ে কৃষি মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধি দাবি করেন, চাল উদ্বৃত্ত আছে ৪৪ লাখ টন। অবশ্য সভায় বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনের প্রতিনিধি দাবি করেন, উৎপাদন ও ভোগ পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, খুব বেশি উদ্বৃত্ত থাকে না।

যদিও ট্যারিফ কমিশনই আবার চাল রপ্তানিতে প্রণোদনা দেওয়ার সুপারিশ করেছে। এ বিষয়ে কমিশনের প্রতিবেদনে কৃষি মন্ত্রণালয়ের বরাত দিয়ে বলা হয়, চাল উদ্বৃত্ত ৩৫ লাখ টন।

ডিসেম্বরে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের অনুরোধে আবার চাল রপ্তানির অনুমোদন দেওয়া বন্ধ করে দেয় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। এরপর গত ৩০ জানুয়ারি বাংলাদেশ ব্যাংক চাল রপ্তানিতে ১৫ শতাংশ ভর্তুকি দেওয়ার বিষয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করে।

দাম বাড়াতে চান মিলমালিকেরা

কুষ্টিয়া থেকে প্রথম আলোর প্রতিনিধি জানান, জেলার মিলগুলো থেকে সরবরাহ কমে যাওয়ায় এবং মূল্য বৃদ্ধি পাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে গত শনিবার জেলা প্রশাসক আসলাম হোসেন চালকল মালিক সমিতির নেতাদের নিয়ে বৈঠক করেন। মিলমালিকদের বক্তব্য শোনার পর জেলা প্রশাসক জানান, চালের দাম বাড়ানোর কোনো যৌক্তিকতা নেই। তিনি মিনিকেট চাল প্রতি কেজি ৪৯ টাকায় বিক্রির জন্য মিলমালিকদের জানিয়ে দেন। যদিও মিলমালিকদের দাবি ছিল প্রতি কেজি ৫২ টাকা।

সভায় মিল মালিক সমিতির কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি ও কুষ্টিয়া খাজানগর এলাকার সবচেয়ে বড় চাল উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান রশিদ অ্যাগ্রো ফুডের মালিক আবদুর রশিদ দাবি করেন, ৫২ টাকা কেজি দরের নিচে চাল বিক্রি করলে লোকসানে পড়তে হবে।

এ নিয়ে বাহাসের পর মিলমালিকেরা চলে যান। তবে তাঁরা আশ্বাস দেন, চালের দাম বাড়বে না। কিন্তু গতকাল রোববার মিলগেটে প্রতি কেজি ৫০ টাকায় মিনিকেট চাল বিক্রি হয়েছে।

জানতে চাইলে বাংলাদেশ অটো মেজর অ্যান্ড হাসকিং মিল মালিক সমিতির কুষ্টিয়া শাখার এক শীর্ষ নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, চাল ৫১ বা ৫২ টাকার নিচে বিক্রি করলে লোকসানে পড়তে হবে। তাই ৪৯ টাকা কেজি দরে বিক্রি করা যাচ্ছে না।

খোলাবাজারে বিক্রি বন্ধ

সরকার ঢাকায় খোলাবাজারে (ওপেন মার্কেট সেল বা ওএমএস) যে চাল বিক্রি করত, তা-ও এখন বন্ধ রয়েছে। ফলে আয় কমে যাওয়া নিম্ন আয়ের মানুষদের চাল কিনতে হচ্ছে বাজার থেকে প্রতি কেজি ৩৮ থেকে ৪০ টাকায়। অবশ্য সরকারি চালের দাম যে খুব কম, তা-ও নয়। খাদ্য অধিদপ্তরের সর্বশেষ মূল্য হলো প্রতি কেজি ৩০ টাকা।

খাদ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (সরবরাহ ও বিপণন) আমজাদ হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ওএমএস আবার শুরু করার বিষয়ে মন্ত্রণালয়কে চিঠি দেওয়া হয়েছে। সম্মতি দিলে আবার শুরু হবে। কিন্তু চাল কিনতে আসা মানুষেরা সমাগম করেন কি না, এর মাধ্যমে করোনাভাইরাস ছড়ায় কি না, সেটিও বিবেচনায় রাখতে হচ্ছে।

সার্বিক বিষয়ে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, চাল রপ্তানির বিষয়টি আলোচনায় এসেছিল গত বছর দাম কমে যাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে। ভর্তুকির সিদ্ধান্ত এসেছে এ বছরের জানুয়ারিতে। এটা সময়োচিত হয়নি। তিনি বলেন, এখন বাজারে চালের উচ্চ মূল্য আছে। চাহিদা আছে। মাসখানেক পর নতুন চাল উঠবে। এ সময়ে আরও মুনাফার আশায় ব্যবসায়ীরা মজুত ধরে রাখবেন বলে মনে হয় না। হয়তো সমস্যাটি সাময়িক।

গোলাম মোয়াজ্জেম এখন নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য পরিমাণ সুনির্দিষ্ট করে দিয়ে খোলাবাজারে চাল বিক্রির পরামর্শ দেন। করোনার কারণে আয় কমে যাওয়ায় দরিদ্রদের জন্য দাম আরেকটু কমিয়ে দেওয়া যেতে পারে বলেও মনে করেন তিনি।