করোনার কারণে এবারের মন্দা আরও বড় হবে, নিতে হবে প্রস্তুতি

করোনাভাইরাস পুরো বিশ্ব অর্থনীতিকেই উল্টেপাল্টে দিচ্ছে। ছবি: রয়টার্স
করোনাভাইরাস পুরো বিশ্ব অর্থনীতিকেই উল্টেপাল্টে দিচ্ছে। ছবি: রয়টার্স
>ডব্লিউটিও বলেছে, মহামারির কারণে লাখ লাখ মানুষের জীবনই শুধু ঝুঁকির মুখে পড়ছে না, বিশ্ব অর্থনীতিতে পড়তে যাচ্ছে বড় আকারের নেতিবাচক প্রভাব।

অর্থনীতিতে এর আগের বিশ্বমন্দা ছিল ২০০৮ সালের। সেই মন্দায় খুব বেশি আক্রান্ত হয়নি বাংলাদেশ। ফলে ২০০৯ সালে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বে এসে আওয়ামী লীগ সরকারকে তেমন সমস্যায় পড়তে হয়নি। তারপরেও সেবার পোশাক খাতে সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা প্রণোদনা দিতে হয়েছিল। আর এবার পোশাকসহ রপ্তানিমুখী খাতের জন্য ৫ হাজার কোটি টাকার তহবিল গঠনের ঘোষণা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

কিন্তু আর্থিক খাতের বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এবারের ঘটনা সম্পূর্ণ অন্য রকম। করোনাভাইরাস পুরো বিশ্ব অর্থনীতিকেই উল্টেপাল্টে দিচ্ছে, যে ধাক্কা থেকে মুক্ত থাকার কোনো সুযোগ নেই বাংলাদেশেরও। বাংলাদেশের রপ্তানি কমছিল, করোনার কারণে তা আরও কমবে। কারণ, বিদেশি ক্রেতারা প্রায় প্রতিদিনই রপ্তানি আদেশ স্থগিত করছেন। আমদানিও কমছে। রাজস্ব সংগ্রহের হার যা এমনিতেই কম ছিল, করোনাভাইরাসের কারণে তা আরও কমার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের পাশাপাশি অভ্যন্তরীণ বাজারও এখন স্থবির। কারণ, নিত্যপণ্যের বাজার ছাড়া সবকিছু বন্ধ। পরিস্থিতি সামাল দিতে অর্থমন্ত্রী আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) ও বিশ্বব্যাংকের কাছে ১০০ কোটি ডলার চেয়েছেন।

মন্দা হবে ভয়াবহ

এদিকে করোনাভাইরাসের কারণে ২০২০ সালের বিশ্ব অর্থনীতি এক যুগ আগের অর্থাৎ ২০০৮ সালের মন্দার চেয়েও বড় ও ভয়াবহ হতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) অর্থনীতিবিদেরা। ডব্লিউটিওর মহাপরিচালক (ডিজি) রবার্তো অ্যাজেভেদো ২৫ মার্চ রাতে নিজের ঘরে বসে এক ভিডিও বার্তায় এ কথা বলেছেন। 

 রবার্তো অ্যাজেভেদো বলেন, করোনাভাইরাস মহামারি হিসেবে এসেছে। এতে লাখ লাখ মানুষের জীবনই শুধু ঝুঁকির মুখে পড়ছে না, বিশ্ব অর্থনীতিতে পড়তে যাচ্ছে বড় আকারের নেতিবাচক প্রভাব। এতে ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষতির পাশাপাশি বেকার হবে অসংখ্য মানুষ। করোনাভাইরাস যেহেতু এক বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ, তাই একে বৈশ্বিকভাবেই মোকাবিলা করতে হবে। এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে ব্যর্থ হলে ইতিহাস আমাদের ভুলবে না, ক্ষমাও করবে না। 

অর্থনৈতিক ক্ষতি মোকাবিলায় সব দেশকে সমন্বিত উদ্যোগ নেওয়ার আহ্বান জানান রবার্তো অ্যাজেভেদো। বলেন, অর্থনৈতিক ক্ষতির পূর্বাভাস এখনই পাওয়া যাবে না, তবে ক্ষতির আকার যে অনেক বড়, আমাদের নিজস্ব অর্থনীতিবিদেরা সেই ধারণা করছেন। ক্ষতি কমিয়ে আনতে ডব্লিউটিওর সদস্যদেশগুলোকে একত্রে এবং নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করতে হবে। সমন্বিত প্রচেষ্টা মন্দা মোকাবিলার জন্য সহায়ক হয়—এমন মন্তব্য করে ডিজি বলেন, বিভিন্ন দেশের সরকার এরই মধ্যে যে আর্থিক ও রাজস্ব খাতে পরিবর্তন এনে প্রণোদনামূলক পদক্ষেপ নিয়েছে, তা খুবই ইতিবাচক। তবে এই মহামারি চলাকালে দেশগুলোকে আরও স্বচ্ছভাবে তথ্য বিনিময় করতে হবে।

বর্তমান বিশ্বব্যবস্থায় কেউই স্বয়ংসম্পূর্ণ নয় এবং কেউ অত শক্তিশালীও নয়। এক দেশ বিপদে পড়লে তাই আরেক দেশকে এগিয়ে আসতে হয়। এসব কথা উল্লেখ করে ডব্লিউটিওর ডিজি বলেন, ‘বাণিজ্য অনেক বড় বিষয়। কারণ, আমাদের মৌলিক পণ্য উৎপাদন, পণ্য সরবরাহ, আমাদের চিকিৎসাসেবা—সবই হয় বাণিজ্যের মাধ্যমে।’ 

বাংলাদেশ কী করবে

ডব্লিউটিওর ডিজির ভিডিও বার্তার কথা বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুরকে জানালে তিনি বলেন, করোনাভাইরাস নিঃসন্দেহে অর্থনীতির জন্য স্মরণকালের বড় আঘাত। এ আঘাতের প্রভাব কত দিন চলবে, এখনই বলা মুশকিল। তবে আশার কথা যে আঘাত প্রশমনে পোশাক খাতের জন্য ৫ হাজার কোটি টাকার একটি তহবিল গঠনের ঘোষণা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। কিন্তু এ তহবিল আরও বড় হওয়া দরকার।

আহসান মনসুর মনে করেন, বন্ধ হয়ে গেছে সব খাত। বিশেষ করে অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের কার্যক্রম পুরোপুরিই বন্ধ। নিম্ন আয়ের মানুষ কষ্টে আছে। এসব ক্ষতি পোষানোর চিন্তাও করতে হবে। এ জন্য তহবিলের আকার ২০ থেকে ২৫ হাজার কোটি টাকায় উন্নীত করা দরকার বলে তিনি মনে করেন।

করোনাভাইরাসের কারণে বাংলাদেশের আর্থিক ক্ষতির পরিমাণটা কত হতে পারে—এ বিষয়ে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) একটি বিশ্লেষণ করেছে। এতে বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) হার ১ দশমিক ১ শতাংশ কমবে বলে প্রাক্কলন করা হয়। চলতি ২০১৯-২০ অর্থবছরের জিডিপির আকার ধরা হয়েছে ২৮ লাখ ৮৫ হাজার ৮৭২ কোটি টাকা আর প্রবৃদ্ধির হার ধরা হয়েছে ৮ দশমিক ২ শতাংশ।

সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে বাংলাদেশ শিল্প ও বণিক সমিতি ফেডারেশনের (এফবিসিসিআই) সভাপতি শেখ ফজলে ফাহিম গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ৫ হাজার কোটি টাকার তহবিল ঘোষণাসহ করোনাভাইরাসের কারণে সম্ভাব্য ক্ষতি কমিয়ে আনতে সরকার এখন পর্যন্ত যথাযথ পদক্ষেপই নিয়েছে। ক্ষতির পরিমাণ যেহেতু এখনো নিরূপিত হয়নি, তাই সুনির্দিষ্ট করে কিছু দাবি করা যাচ্ছে না। তবে ভবিষ্যতে ক্ষুদ্র থেকে বড়—সব খাতের জন্যই দীর্ঘ মেয়াদে শূন্য সুদে ঋণসুবিধা চাইতে হতে পারে। 

শেখ ফজলে ফাহিম আরও বলেন, ‘নীতি সহায়তার মাধ্যমে প্রভাব কতটা কমিয়ে রাখা যায়, সেটাই হচ্ছে এখন বড় বিষয়। অযৌক্তিক কোনো দাবি আমরা তুলব না। আমাদের আস্থা রয়েছে যে দেশের সব ক্ষতিগ্রস্ত খাত থেকেই করোনার নেতিবাচক প্রভাব কমিয়ে আনতে প্রয়োজনীয় সব পদক্ষেপই সরকার নেবে।’