টাকার সংস্থান হবে ব্যাংক থেকেই

ফাইল ছবি
ফাইল ছবি
>ক্ষতি পোষাতে সরকার ৭২ হাজার ৭৫০ কোটি টাকা প্রণোদনা দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে, যার প্রায় পুরো ভারই গিয়ে পড়বে ব্যাংক খাতের ওপর

ব্যাংক খাতে তারল্যসংকট আছে। আট মাসে সরকারের রাজস্ব আয়ে ঘাটতি ৪৫ হাজার কোটি টাকা। আমদানি-রপ্তানি দুটোই কমছে। কমছে প্রবাসী আয়ও (রেমিট্যান্স)। সামনে আসছে নতুন বাজেট। এসবের মাঝখানেই অর্থনীতিতে যুক্ত হয়েছে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব।

ক্ষতি পোষাতে সরকার ৭২ হাজার ৭৫০ কোটি টাকা প্রণোদনা দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে, যার প্রায় পুরো ভারই গিয়ে পড়বে ব্যাংক খাতের ওপর। কিন্তু বিপুল পরিমাণ এই টাকার সংস্থান হবে কীভাবে, ব্যাংকগুলো কি এত টাকা দিতে এখন সক্ষম—এসব প্রশ্ন এখন বড় করে দেখা দিয়েছে।

আবার নগদ অর্থের সংকটের কারণে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে এবার নেওয়া সরকারের ঋণও এযাবৎকালের সর্বোচ্চ। জুলাই-ডিসেম্বর অর্থাৎ মাত্র ছয় মাসে এই ঋণের পরিমাণ ৫৩ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। পরিস্থিতি সামাল দিতে অর্থনীতিবিদ ও গবেষকদের কেউ কেউ টাকা ছাপানোরও পরামর্শ দিচ্ছেন। আবার এর বিরুদ্ধে মতও রয়েছে।

সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এ বি মির্জ্জা মো. আজিজুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, প্রণোদনার পদক্ষেপ ভালো দিক। তবে ব্যাংকগুলোতে তারল্যসংকট আছে। তা দূর করতে বাংলাদেশ ব্যাংককে বড় আকারে পুনঃ অর্থায়ন কর্মসূচি চালু করতে হবে, যে কর্মসূচি থেকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ২ থেকে ৩ শতাংশ সুদে ব্যাংকগুলোকে ধার দেবে। এ ছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছ থেকে অর্থ ধার নিতে পারে সরকার। সরকারের ধার নেওয়া মানেই হলো টাকা ছাপানো।

এদিকে গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর প্রথম আলোকে বলেন, বোঝা যাচ্ছে যে ব্যাংক খাতের মাধ্যমেই এই প্রণোদনা বাস্তবায়ন করা হবে। কিন্তু ব্যাংক খাতের তারল্য পরিস্থিতি ভালো নেই এবং নিজস্ব তহবিল দিয়ে এই উদ্যোগ বাস্তবায়ন করা ব্যাংকগুলোর পক্ষে কঠিন। আবার সতর্ক থাকতে হবে যে রাঘববোয়ালেরা যেন প্রণোদনার এই টাকা খেয়ে না ফেলে। কারণ, সরকারের উদ্যোগটি ব্যবসায়ীদের জন্য সত্যিই লোভনীয়।

তবে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল টাকা ছাপানোর পক্ষে নন। তিনি বলেন, ব্যাংক খাতে তারল্যসংকট নেই। আর অর্থনীতির অবস্থা এখনো সেই পর্যায়ে যায়নি যে টাকা ছাপাতে হবে। ব্যাংক ব্যবস্থার মাধ্যমেই পরিস্থিতি মোকাবিলা করা সম্ভব হবে।

এ ছাড়া টাকা ছাপানোর পথে গেলে দাতা সংস্থাগুলোর কাছ থেকে সহায়তা পাওয়া কঠিন হয়ে পড়বে বলেও মনে করছে অর্থ মন্ত্রণালয়। সরকারের আশা বিশ্বব্যাংক, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ), এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের কাছ থেকে সহায়তা পাওয়া যাবে।
প্রণোদনা প্যাকেজের ঘোষণা আসার পর শিল্পপতি ও ব্যবসায়ীরা সরকারকে অভিনন্দনও জানিয়েছেন। পুরো প্রণোদনা প্যাকেজের মধ্যে ৫ হাজার কোটি টাকা দেওয়া হচ্ছে সরকারের বাজেট থেকে। প্রশ্ন হচ্ছে, বাকি টাকার সংস্থান নিয়ে। জানা গেছে, শুধু রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংক নয়, বেসরকারি ব্যাংকগুলোও এর মধ্যে যুক্ত থাকবে।
ব্যাংকের প্রধান নির্বাহীদের সংগঠন এবিবির সভাপতি আলী রেজা ইফতেখার প্রথম আলোকে বলেন, ‘পুরো ব্যাংক খাতকে ধরে নিয়েই প্রণোদনা প্যাকেজের ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। তবে তারল্য নিয়ে আমরা একটু চিন্তিত। আশা করছি কেন্দ্রীয় ব্যাংক নিশ্চয়ই একটা উপায় বের করবে।’

বাণিজ্যিক ব্যাংকের ৫০,০০০ কোটি টাকা
অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, ক্ষতিগ্রস্ত শিল্প ও সেবা খাতের প্রতিষ্ঠানগুলোকে ৩০ হাজার কোটি টাকার মতো চলতি মূলধন দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। ব্যাংক ব্যবস্থার মাধ্যমে স্বল্প সুদে এ টাকা ঋণ দেওয়া হবে। অর্থাৎ বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো নিজস্ব তহবিল থেকে এ মূলধনের জোগান দেবে।
তবে ঢালাওভাবে সবাই ঋণ পাবে না। ব্যাংক-গ্রাহক সম্পর্কের ভিত্তিতে অর্থাৎ ব্যাংক যেসব গ্রাহককে ভালো মনে করবে, তাদেরই দেবে এই ঋণ। এই ঋণের সুদের হার হবে ৯ শতাংশ। এর মধ্যে সুদের অর্ধেক অর্থাৎ ৪ দশমিক ৫০ শতাংশ বহন করবে ঋণগ্রহীতা শিল্প বা ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান। বাকি অর্ধেক সরকার ভর্তুকি হিসেবে সংশ্লিষ্ট ব্যাংককে দেবে।
হিসাব করে দেখা যায়, ৯ শতাংশে ৩০ হাজার কোটি টাকার সুদ হয় ২ হাজার ৭০০ কোটি টাকা। এর অর্ধেক অর্থাৎ ১ হাজার ৩৫০ কোটি টাকা সরকার বহন করবে।
একইভাবে ক্ষুদ্র (কুটির শিল্পসহ) ও মাঝারি শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোকে ২০ হাজার কোটি টাকা চলতি মূলধন দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। এই টাকাও দেওয়া হবে ব্যাংক ব্যবস্থার মাধ্যমেই। অর্থাৎ গ্রাহকের সঙ্গে সম্পর্কের ভিত্তিতে ব্যাংকগুলো ঋণ দেবে। এই ঋণেরও সুদের হার ৯ শতাংশ। তবে ঋণের ৪ শতাংশ সুদ বহন করবে ঋণগ্রহীতা শিল্পপ্রতিষ্ঠান। বাকি ৫ শতাংশ সরকার ভর্তুকি দেবে।

গাণিতিক হিসাব অনুযায়ী, ২০ হাজার কোটি টাকার সুদ ১ হাজার ৮০০ কোটি টাকা। তবে ৫ শতাংশ হিসাবে ১ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দেবে সরকার। দুটি মিলিয়ে সরকারকে ২ হাজার ৩৫০ কোটি টাকা বাজেট থেকে দিতে হবে সরকারকে।
অগ্রণী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ শামস-উল-ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘তারল্যের একটি চাপ আছে। ভাবছি, গ্রাহকদের ঋণের চাহিদা পূরণ করতে পারব তো? তবে এই উদ্যোগে ব্যাংকগুলোর লোকসান হওয়ার কোনো আশঙ্কা নেই।’
তারল্য চাপ মেটাবেন কীভাবে—এমন প্রশ্নের জবাবে শামস-উল-ইসলাম বলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংক দশমিক ৫ শতাংশ নগদ জমার হার (সিআরআর) কমানোয় কিছুটা তারল্য সাশ্রয় হয়েছে। পর্যায়ক্রমে আরও কমানো যেতে পারে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ১৭,৭৫০ কোটি টাকা
বাংলাদেশ ব্যাংকের রপ্তানি উন্নয়ন তহবিল (ইডিএফ) নামে বর্তমানে ৩৫০ কোটি মার্কিন ডলারের একটি তহবিল রয়েছে। ‘ব্যাক টু ব্যাক’ ঋণপত্রের আওতায় কাঁচামাল আমদানির জন্য এ তহবিল থেকে স্বল্প সুদে ঋণ নিয়ে থাকেন রপ্তানিকারকেরা।
প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা অনুযায়ী, ইডিএফের আকার ১৫০ কোটি ডলার বাড়িয়ে করা হবে ৫০০ কোটি ডলার, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় হবে ৪২ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। ১৫০ কোটি ডলার বৃদ্ধির কারণে তহবিলে নতুন করে যুক্ত হবে ১২ হাজার ৭৫০ কোটি টাকা।

ইডিএফের বর্তমান সুদের হার হচ্ছে লন্ডন আন্তব্যাংক সুদের হার (এলআইবিওআর) এবং ১ দশমিক ৫ শতাংশের যোগফল, যা প্রকৃতপক্ষে দাঁড়ায় ২ দশমিক ৭৩ শতাংশ। এটি কমিয়ে এখন ২ শতাংশ করা হবে। অর্থাৎ পুরো ঋণ দেওয়া হলে রপ্তানিকারকদের আগের চেয়ে সুদ কম দিতে হবে অন্তত ৪০০ কোটি টাকা।
প্রণোদনা প্যাকেজের আওতায় প্রাক্জাহাজীকরণ পুনঃ অর্থায়ন কর্মসূচি ঋণ (প্রি-শিপমেন্ট ক্রেডিট রিফাইন্যান্স স্কিম) নামে বাংলাদেশ ব্যাংক ৫ হাজার কোটি টাকার একটি নতুন ঋণ কর্মসূচিও চালু করবে। এর সুদের হার হবে ৭ শতাংশ।

যোগাযোগ করলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক সিরাজুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘প্রণোদনার পুরো বিষয়টি নিয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ের একটি নির্দেশনার অপেক্ষায় আছি আমরা।’
বাংলাদেশ ব্যাংকের এই নির্দেশনার অপেক্ষার থাকার বিষয়টি জানালে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল প্রথম আলোকে বলেন, মূল কাজটি এখন বাংলাদেশ ব্যাংকই করবে। এ জন্য তাদের একটি আলাদা শাখাকে নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করতে হবে। আর নির্দেশনাটি এক থেকে দুই দিনের মধ্যেই বাংলাদেশ ব্যাংক পেয়ে যাবে।