সরবরাহে ১৩ সমস্যা, দাম বাড়ছে পণ্যের'

সাধারণ ছুটির শুরুতে দেশে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য সরবরাহে যে বিঘ্নের শুরু হয়েছিল, তা এখনও কাটেনি। বরং ব্যবসায়ীরা এখন আমদানিতেও নানা সমস্যার কথা বলছেন। বাজারে কিছু কিছু পণ্যের দাম বেড়েছে। 

চট্টগ্রামভিত্তিক বড় নিত্যপণ্য আমদানিকারক বিএসএম বিএসএম গ্রুপ বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে চিঠি দিয়ে পাঁচটি সমস্যার কথা জানিয়েছে। যা হলো, ঘাটে পণ্য খালাসে বাধা, গুদামে শ্রমিকদের কাজ করতে বাধা, পরিবহন সমস্যা, ব্যাংকিং সেবায় ঘাটতি ও কিছু কিছু ক্ষেত্রে ব্যাংকে ডলারের অভাব।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে চিঠিটি পাওয়ার পর বিএসএম গ্রুপের চেয়ারম্যান আবুল বশর চৌধুরীর কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, জাহাজ থেকে খালাস করে পণ্য ক্রেতার কাছে পৌঁছানো এখন একটা চ্যালেঞ্জ। কিছু কিছু ক্ষেত্রে সমস্যা হচ্ছে না, আবার কিছু কিছু ক্ষেত্রে হচ্ছে। ব্যাংকেও নথি ছাড় ও অন্যান্য ক্ষেত্রে কিছু কিছু ক্ষেত্রে আমরা অসুবিধার মুখে পড়ছি। তিনি বলেন, করোনাভাইরাস ঠেকাতে হবে। আবার মানুষের জন্য নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের সরবরাহ নিশ্চিত করা জরুরি।
দেশে গত ২৬ মার্চ থেকে সাধারণ ছুটি শুরু হয়। তখন পণ্য উৎপাদন ও সরবরাহে জনবল সংকট শুরু হয়। পরিবহনের অভাবও দেখা দেয়। ট্রাক ও কাভার্ড ভ্যান মালিকেরা রাস্তায় যানবাহন নামাতে অস্বীকৃতি জানান। চালকেরাও বাড়ি চলে যান। ব্যবসায়ীরা বলছেন, বিভিন্ন জায়গায় পরিবহন চালক ও শ্রমিকদের মারধর করার ঘটনা ঘটেছে। এতে আতঙ্ক আরও বেড়েছে।
ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো এসব সমস্যার কথা বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনকে জানিয়েছে। কমিশন এ বিষয়ে একটি প্রতিবেদন তৈরি করে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে দিয়েছে, যেখানে পণ্য সরবরাহ ব্যবস্থায় মোট ১৩টি সমস্যা চিহ্নিত করা হয়েছে।
সমস্যাগুলো হলো পর্যাপ্ত ডলারের অভাবে কিছু কিছু ব্যাংকে ঋণপত্র বা এলসি খুলতে অনীহা, আমদানি নথির স্ক্যান করা অনুলিপি গ্রহণ না করায় পণ্য খালাসে সমস্যা, পণ্য খালাসে বাধ্যতামূলক পরীক্ষার ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট সরকারি সংস্থা অনেক সময় খোলা না পাওয়া, পণ্য ওঠানো-নামানোয় শ্রমিকের অভাব, ছুটির মধ্যে উৎপাদনরত কারখানায় শ্রমিক-কর্মচারীর আসা-যাওয়ায় বাধা, কিছু জায়গায় প্রশাসনের অনুমতিহীন লকডাউনে পণ্য পরিবহনে বাধা, নিত্যপণ্য উৎপাদনে জরুরি বিভিন্ন পণ্যবাহী যানবাহন চলাচলে বাধা, খুচরা যন্ত্রাংশের সরবরাহ না থাকা, অত্যাবশকীয় পণ্যের মোড়কজাত করার কারখানায় উৎপাদন ও বিপণনের সমস্যা, চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জের নিতাইগঞ্জ ও যশোরের নওয়াড়াপাড়ায় পণ্য উঠানো-নামানোর শ্রমিক সংকট, পরিবেশক পর্যায়ে শ্রমিকের অভাব, সরবরাহ আদেশ সংগ্রহ, বিপণন ও অর্থ সংগ্রহ ঠিকমতো করতে না পারা এবং বিভিন্ন এলাকায় ব্যাংক বন্ধে লেনদেন বাধাগ্রস্ত।
এসব সমস্যা সমাধানে ট্যারিফ কমিশন বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করেছে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, ইতিমধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে আলোচনা করে কিছু কিছু সমস্যার সমাধান করা হয়েছে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের তদারকি দল বিষয়গুলো দেখছে।
এ বিষয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের বক্তব্য পাওয়া যায়নি। তবে বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রানীতি বিভাগের নির্বাহী পরিচালক হুমায়ুন কবির বলেন, আর কোনো সমস্যা থাকলে কাল (রোববার) ব্যাংকগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে সমাধান করা হবে।
অবশ্য সব সমস্যা বাংলাদেশ ব্যাংকের আওতায় নেই। যেমন, জীবাণুনাশক ও বিভিন্ন নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য উৎপাদনকারী একটি প্রতিষ্ঠান প্রথম আলোকে জানায়, নারায়ণগঞ্জে তাদের জীবাণুনাশকের কারখানায় উৎপাদন ৪০ শতাংশে নেমেছে। এ কারণ শ্রমিকের অভাব। লকডাউনের কারণে শ্রমিকদের অনেকেই কারখানায় যেতে পারছেন না।
সরবরাহ ব্যবস্থার বিঘ্নের কারণে পবিত্র রমজান মাসের আগে বাড়ছে পেঁয়াজের দাম। ঢাকার বাজারে দেশি পেঁয়াজের দাম কেজিপ্রতি ১০ টাকা বেড়ে ৪৫ থেকে ৫০ টাকায় উঠেছে বলে জানাচ্ছে সরকারি বিপণন সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি)। এ ছাড়া তারা মোটা চালের দাম কেজিতে ২ টাকা ও সরু চালের দাম ৩ থেকে ৫ টাকা, দেশি রসুনের দাম কেজিতে ২০ টাকা, আদার দাম ৩০ থেকে ৫০ টাকা বৃদ্ধির হিসাব দিয়েছে।
শ্যামবাজারের ব্যবসায়ী আবদুল মাজেদ বেশ কিছু সমস্যার কথা বলেন। তিনি জানান, শ্যামবাজারে যারা কিনতে যান, তারা যেতে পারছেন না। দোকান খোলা রেখে কেউ কেউ হয়রানির মুখে পড়ছেন। শ্রমিক নেই। ট্রাক আসছে না। তিনি বলেন, যে পেঁয়াজ ২৮ টাকা কেজি ছিল, সেটা এখন ৪০ টাকা হয়ে গেছে।
পুরান ঢাকার মৌলভীবাজারের ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক গোলাম মাওলা প্রথম আলোকে বলেন, ছুটির পর শুরুর থেকেই মৌলভীবাজারে পাইকারি তেল-চিনির দোকান বন্ধ। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছিল। ব্যবসায়ীরা খোলা রাখার অনুমতি দিয়ে একটি প্রজ্ঞাপন জারির অনুরোধ করেছিলেন। কিন্তু তা হয়নি। তিনি বলেন, স্থানীয় পর্যায়ের মজুত দিয়ে এখন হয়তো চলছে। কিন্তু মৌলভীবাজার না খুললে পরে সমস্যা হবে। বাজারে প্রতিযোগিতা না থাকলে দাম বেড়ে যেতে পারে।
কিছু ক্ষেত্রে রান্নার গ্যাসেও চড়া দাম দিতে হচ্ছে সরবরাহ সংকটের কারণে। ঢাকার কোনো কোনো এলাকায় ১২ কেজির এক সিলিন্ডার তরলীকৃত পেট্রোলিয়াম গ্যাসের দাম ৯৫০ টাকা, কোনো এলাকায় সেটা ১,১৫০ টাকা। ব্যবসায়ীরা বলছেন, দামের এই বড় হেরফেরের কারণ সরবরাহ ব্যবস্থায় বিঘ্ন।
বসুন্ধরা এলপিজিপির প্রধান বিপণন কর্মকর্তা জাকারিয়া জালাল বলেন, আমাদের কাছে প্রচুর গ্যাস রয়েছে। দামও কমেছে। কিন্তু সরবরাহ করা যাচ্ছে না। বিক্রি ৭০ শতাংশ কমে গেছে। তিনি বলেন, বড় সমস্যা সরবরাহের জন্য পরিবহনের অভাব। আর পরিবেশকেরাও নির্বিঘ্নে ব্যবসা করতে পারছে না।
কৃষিযন্ত্র সরবরাহকারী এসিআই জানিয়েছে, যন্ত্রপাতি সরবরাহ করা গেলেও তারা সেটা স্থাপন ও মেরামতে লোক পাঠাতে পারছে না। এসিআই মোটরসের নির্বাহী পরিচালক সুব্রত রঞ্জন দাস বলেন, মাঠে কোনো যন্ত্র নষ্ট হলে আমরা সেটা ৬ ঘণ্টার মধ্যে লোক পাঠিয়ে মেরামত করার ব্যবস্থা করি। আবার নতুন যন্ত্র লোক দিয়ে স্থাপন বা ইনস্টল করে দিয়ে আসে। এখন সেটা কঠিন হয়ে গেছে। তিনি বলেন, বোরো মৌসুম শুরু হচ্ছে। এখন ধান কাটার জন্য কৃষিযন্ত্রের ব্যবহার জরুরি হয়ে পড়ছে।
জানতে চাইলে ভোক্তা অধিকার সংগঠন কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, সরকার নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য পরিবহন ও বিক্রি বিধিনিষেধের আওতামুক্ত রেখেছে। এ নির্দেশনা যাতে মাঠ পর্যায়ে মেনে চলা হয়, তা নিশ্চিত করতে হবে। প্রয়োজনে সরকারি তদারকিতে পণ্যবাহী যানের বহর চলাচলের ব্যবস্থা করতে হবে।