দুই বড় উৎসবে চরম অনিশ্চয়তায় দেশীয় ফ্যাশনশিল্প

করোনার কারণে বন্ধ থাকায় সব শিল্প খাতের মতো বাংলাদেশের দেশীয় ফ্যাশনশিল্পও চরম অনিশ্চয়তায় পড়েছে। ছবি: আবদুস সালাম
করোনার কারণে বন্ধ থাকায় সব শিল্প খাতের মতো বাংলাদেশের দেশীয় ফ্যাশনশিল্পও চরম অনিশ্চয়তায় পড়েছে। ছবি: আবদুস সালাম

পয়লা বৈশাখ ও ঈদ এবার প্রায় পিঠাপিঠি। বছরের অন্যতম বড় দুটি উৎসবকে করোনাভাইরাস গিলে ফেলেছে। কারণ, উদ্‌যাপনের সম্ভাবনা ক্ষীণ। ফলে, অবরুদ্ধ পরিস্থিতিতে অন্য সব শিল্প খাতের মতো বাংলাদেশের দেশীয় ফ্যাশনশিল্পও চরম অনিশ্চয়তায় পড়েছে।

এ অবস্থা অব্যাহত থাকলে ছয় হাজার কোটি টাকারও বেশি ক্ষতির সম্মুখীন হবে বাংলাদেশের দেশীয় ফ্যাশনশিল্প খাত। তীব্র সংকটে পড়বে পাঁচ হাজার উদ্যোক্তা এবং এই শিল্প খাতের ওপর নির্ভরশীল প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে পাঁচ লাখের বেশি মানুষ।

বিলীয়মান বৈশাখ
অন্য বছরের মতো এ বছরও বৈশাখের প্রস্তুতি উল্লেখযোগ্য ছিল বলে মন্তব্য করে ফ্যাশন এন্ট্রাপ্রেনিউরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (এফইএবি) সভাপতি এবং অঞ্জন’স-এর শীর্ষ নির্বাহী শাহীন আহম্মেদের ব্যাখ্যা, এর দুটো কারণ: এক. এ বছর ঈদ আর বৈশাখের মধ্যে এক মাসের কিছু বেশি ব্যবধান। দুই. বসন্ত, বিজয় দিবস ও একুশে ফেব্রুয়ারির বিক্রি সন্তোষজনক। ফলে বৈশাখ আয়োজনে কেউ কার্পণ্য করেনি।

অন্য বছরে এপ্রিলের এই সময়ে মানুষ মুখিয়ে থাকে পয়লা বৈশাখ উদ্‌যাপনের জন্য, যেখানে নতুন পোশাকের আয়োজন থাকে সবিশেষ গুরুত্বে। ফ্যাশন হাউসগুলোরও তাই ছিল প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি। এমনকি অনেক হাউস মার্চের প্রথম সপ্তাহেই বৈশাখ সংগ্রহ শাখাগুলোয় সাজানো শুরু করে। কিন্তু ৮ মার্চ করোনা রোগী শনাক্তের পর উদ্বেগ ছড়াতে থাকে। ২০ মার্চের মধ্যে বিক্রি নামে গতবারের তুলনায় অর্ধেকে। এর পরের পাঁচ দিনে একেবারে শূন্যে পরিণত হয়। এরপর ২৬ মার্চ থেকে সব শপিং মল, ব্র্যান্ড স্টোর বন্ধ। এ কারণে মার্চেই অন্তত ১২৫ কোটি টাকার ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয়েছে বলে জানিয়েছে এফইএবি। এবারের অবরুদ্ধ বৈশাখের উদ্‌যাপনে পোশাক কেনার অবকাশ থাকছে না।

বৈশাখ উপলক্ষে ৩ ও ৪ এপ্রিল ফ্যাশন শো এবং প্রদর্শনীর পরিকল্পনা করে ফ্যাশন ডিজাইন কাউন্সিল অব বাংলাদেশ (এফডিসিবি)। সংস্থার নির্বাহী সদস্য লিপি খন্দকার জানালেন, এফডিসিবির ৪০ জন সদস্যের সবার আউটলেট নেই। কিন্তু প্রত্যেকেরই ছিল প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি। এ কারণে আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন প্রত্যেকেই। চট্টগ্রামেও ডিজাইনার ও ফ্যাশন হাউসগুলো মহাসংকটে রয়েছে বলে চট্টগ্রাম ডিজাইনারস কাউন্সিলের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে।

বন্ধ আছে দেশীয় সব ফ্যাশনশিল্পের দোকান। ছবি: আবদুস সালাম
বন্ধ আছে দেশীয় সব ফ্যাশনশিল্পের দোকান। ছবি: আবদুস সালাম


অনিশ্চয়তার ঈদ
অন্যদিকে অবস্থার নিরিখে ঈদ বাজারের কি হাল হবে তা নিয়ে সংগত কারণেই উদ্বিগ্ন উদ্যোক্তারা। কারণ, দুটো উৎসবের ব্যবধান মাত্র দেড় মাসের। ফলে বৈশাখের আয় ঈদের পণ্য উৎপাদনে ব্যবহারের সুযোগ এ বছর এমনিতেই ছিল না। উপরন্তু, নিজেদের সঞ্চয়ের পাশাপাশি ব্যাংক থেকে নেওয়া অর্থ, এমনকি নানাভাবে সংগৃহীত পুঁজির সবটাই বিনিয়োগ করেন উদ্যোক্তারা। এখন অসমাপ্ত কাজ যেমন থেকে গেছে, তেমনি আটকেছে সম্পূর্ণ পুঁজি।

সমান্তরালে জমছে নানা ব্যয়। বাড়িভাড়া, ইউটিলিটি বিল, ব্যাংকঋণের কিস্তি, কর্মীদের বেতন, প্রোডিউসারদের মজুরি, ভ্যাট–ট্যাক্স; এর সঙ্গে আরও যোগ হবে ঈদের বোনাস। অথচ বিপরীতে আয় শূন্য। পক্ষান্তরে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার পর উৎসব উদ্‌যাপন করার মতো মানসিক অবস্থায় সবাই থাকবে কি না, সে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে।

পয়লা বৈশাখ ও ঈদে এবার বন্ধ থাকবে ফ্যাশনশিল্পের দোকান। ছবি: আবদুস সালাম
পয়লা বৈশাখ ও ঈদে এবার বন্ধ থাকবে ফ্যাশনশিল্পের দোকান। ছবি: আবদুস সালাম

অমিলের অঙ্ক
বাংলাদেশের ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রি বৈশিষ্ট্যগতভাবে বিশ্বের অন্যান্য দেশের চেয়ে আলাদা। পৃথিবীর অন্য দেশ মৌসুমনির্ভর হলেও এখানে তা মূলত উৎসব আর উপলক্ষ্যভিত্তিক। তা ছাড়া এত বেশি কারুশিল্প এবং লোকশিল্পের পৃষ্ঠপোষণা বিশ্বের অন্য দেশগুলোর দেশীয় ফ্যাশনশিল্প খাতে হয় না। এখানে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী সব কটি বয়নশিল্প (টাঙ্গাইল, সিরাজগঞ্জ, পাবনা, জামদানি, বেনারসি, মণিপুরি, নৃগোষ্ঠীর বয়ন), সূচিশিল্প (নানা ধরনের হ্যান্ড এমব্রয়ডারি), রঞ্জকশিল্প (প্রাকৃতিক ও রাসায়নিক রঙের শিল্পী কারিগর), ছাপাইশিল্প (স্ক্রিন প্রিন্ট, ব্লক প্রিন্ট)। এই শিল্প খাতের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে আরও যুক্ত রয়েছে মৃৎশিল্প, চামড়াশিল্প, ধাতবশিল্প, অলংকারশিল্প, পাটশিল্পসহ বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী অন্যান্য কারুশিল্প।

এ ছাড়া আছে মেশিন এমব্রয়ডারি এবং ক্ষুদ্র ও মাঝারি তৈরি পোশাকশিল্প। কোনো সন্দেহ নেই, বাংলাদেশের দেশীয় ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রির সংকট মানে এই শিল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সব খাতের সার্বিকভাবে ক্ষতির সম্মুখীন হওয়া। ফলে, ক্ষতির পরিমাণ শেষ পর্যন্ত কোথায় গিয়ে ঠেকবে, তা ভাবলে শিউরে উঠতে হয় বলেই মন্তব্য করেন কে ক্র্যাফটের পরিচালক খালিদ মাহমুদ খান।

দেশের সবচেয়ে বড় লাইফস্টাইল ব্র্যান্ড আড়ংয়ের হেড অব মার্কেটিং তানভীর হোসেন জানালেন, প্রতিষ্ঠানের গত বছরের টার্নওভার ছিল এক হাজার কোটি টাকা। বৈশাখের বিক্রি থেকে আসে ১০ ভাগ অর্থ; আর ঈদে আসে ৩০ থেকে ৩৫ ভাগ। অর্থাৎ দুটো উৎসব থেকে আড়ংয়ের আয় অন্তত ৪৫০ কোটি। স্বাভাবিকভাবে এবার এই অঙ্ক আরও বাড়ারই কথা। তবে পরিস্থিতি কিছুটা সহনীয় হলে তাঁরা অনলাইনে বিক্রিতে জোর দিতে চান। সেই পরিকল্পনা চলছে। এমনকি তানভীর জানালেন, সব বন্ধ হয়ে যাওয়ার আগে তাঁদের অনলাইনে বিক্রি আগের তুলনায় অন্তত ১০০ ভাগের বেশি বেড়েছিল।

আড়ংয়ের মোট ৬৫০ জন স্বাধীন প্রোডিউসারের অধীনে অন্তত ৩০ হাজার কর্মী কাজ করেন। এ ছাড়া আয়েশা আবেদ ফাউন্ডেশনের ১৪টি শাখায় আছে আরও ২৫ হাজার কর্মী। পাশাপাশি ঢাকা ও ঢাকার বাইরের সব শাখা আর হেড অফিসের কর্মকর্তা-কর্মচারী মিলিয়ে ৫ হাজার ২০০ জন। নানাভাবেই পরিস্থিতি উতরানোর চেষ্টা করছে এই প্রতিষ্ঠান। এমনকি কারুশিল্পীদের জন্য বিশেষ প্রণোদনা প্যাকেজের পরিকল্পনা করছেন বলে জানিয়েছেন তানভীর।

কে ক্র্যাফট, অঞ্জনস, সাদাকালো, সেইলর, লা রিভ, রঙ বাংলাদেশ, নিপুণ, বিবিয়ানা, বিশ্বরঙ, দেশাল, বাংলার মেলা, ক্যাটস আইসহ আড়ংয়ের পরের সারির ফ্যাশন হাউসের সংখ্যা ২০ থেকে ২৫। এদের প্রত্যেকের বেতনভুক্ত কর্মকর্তা-কর্মচারী আছেন অন্তত ৪০০ জন। এ ছাড়া প্রত্যেকেরই আছে ২০০ থেকে ২৫০ প্রোডিউসার ও তাদের চার হাজার কর্মী বাহিনী। এমনকি মাঝারি ও ছোট হাউসগুলোরও আছে প্রয়োজন অনুসারে জনশক্তি।

এবার বৈশাখ উদ্‌যাপনে পোশাক কেনার অবকাশ থাকছে না। ছবি: আবদুস সালাম
এবার বৈশাখ উদ্‌যাপনে পোশাক কেনার অবকাশ থাকছে না। ছবি: আবদুস সালাম

ওদের সর্বনাশ
একটা বড় শিল্প খাতের সঙ্গে ছোট ছোট সহযোগী শিল্প জড়িত থাকে। বাংলাদেশের ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রিও এর বাইরে না। এ বিষয় নিয়ে চমৎকার পর্যবেক্ষণ দিয়েছেন সেইলরের প্রধান পরিচালন কর্মকর্তা (সিওও) মো. রেজাউল কবির।

বৈশাখ আর ঈদের জন্য প্রতিটি ফ্যাশন হাউস তাদের ব্যয়ের তালিকায় ওপরের দিকেই রাখে ব্র্যান্ড মার্কেটিং। সারা বছরের প্রচারে বাজেটের ৭০ ভাগ ব্যয় হয় পয়লা বৈশাখ ও রোজার ঈদকে ঘিরে। ব্র্যান্ড মার্কেটিংয়ের সঙ্গে জড়িত ফটোগ্রাফি, ভিডিওগ্রাফি, ডিজিটাল কনটেন্ট, সোশ্যাল মিডিয়া ম্যানেজমেন্ট, মডেলিং, কোরিওগ্রাফি, মেকআপ, লাইট, সাউন্ড ইত্যাদি ছোট ছোট পেশাজীবী। আবার ফটো ও ভিডিও শুটের আয়োজনে সেট ডিজাইনার, টি-বয় থেকে ক্যাটারিং সার্ভিসের সদস্যরাও এই বিশাল কর্মপ্রক্রিয়ার অংশ। ব্র্যান্ড মার্কেটিং ও রিটেইলিংয়ের সঙ্গে আরও রয়েছে প্রেস ও প্রিপ্রেসের লোকজন।

বর্তমানে ব্র্যান্ড মার্কেটিংয়ে অনেকেই অনেক বেশি খরচ করে থাকেন। কোনো কোনো প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে এর পরিমাণ কোটি ছাড়ায়। অথচ করোনা সংকটে সবই বন্ধ। যদিও আড়ং তাদের বৈশাখের প্রচারে প্রায় ৫০ ভাগ কাজ শেষ করে ফেলেছিল।

রেজাউল কবির বললেন, এই সময়ের জন্য অন্তত পাঁচ লাখ ব্যাগের অর্ডার ছিল সেইলরের। সব হাউসের ক্ষেত্রেও বিষয়টা প্রযোজ্য। অথচ ব্যাগ এখন আর লাগছে না। এ কারণে সংকটে পড়ে গেলেন সরবরাহকারী ও তার সঙ্গে জড়িত সবাই।

এ সময়ে প্রতিটি ফ্যাশন হাউস অতিরিক্ত কর্মী নিয়োগ দিয়ে থাকে। বিশেষত, তাঁরা এক বা দুই মাসের জন্য খণ্ডকালীন কাজ করেন। গত বছর কেবল ঈদের জন্য, অর্থাৎ রোজার মাসের জন্য আড়ং খণ্ডকালীন নিয়োগ দিয়েছিল ১ হাজার ৭০০। অন্যদিকে, সেইলর এ বছর দুই মাসের জন্য অন্তত ১ হাজার ২০০ জনের খণ্ডকালীন নিয়োগ চূড়ান্ত করে। হয়তো তাঁরা প্রত্যেকে দুই মাসে ২৫ হাজার থেকে ৩০ হাজার টাকা পেতেন। এমনকি তাঁদের জন্য প্রতিদিন খাবার দেওয়ার জন্য নির্দিষ্ট ছিল একটি খাবার সরবরাহকারী। খণ্ডকালীন কর্মীদের জন্য ইউনিফর্ম, জুতা সরবরাহকারী এবং তাদের আনা-নেওয়ার জন্য ব্যবস্থা ছিল। অথচ সারা বছর অপেক্ষায় থাকা ছোট প্রতিষ্ঠানগুলো হারাচ্ছে মৌসুমি ব্যবসা।

দোকান বন্ধ থাকলেও বাড়িভাড়া, ইউটিলিটি বিল, ব্যাংকঋণের কিস্তি, কর্মীদের বেতন, প্রোডিউসারদের মজুরি, ভ্যাট, ট্যাক্সসহ দিতে হবে। ছবি: আবদুস সালাম
দোকান বন্ধ থাকলেও বাড়িভাড়া, ইউটিলিটি বিল, ব্যাংকঋণের কিস্তি, কর্মীদের বেতন, প্রোডিউসারদের মজুরি, ভ্যাট, ট্যাক্সসহ দিতে হবে। ছবি: আবদুস সালাম

বিপাকে বয়নশিল্প
বাংলাদেশের দেশীয় ফ্যাশনশিল্প খাতের সঙ্গে সবচেয়ে বেশি সম্পৃক্ততা বয়নশিল্পের। হস্ত ও যন্ত্রচালিত উভয় ধরনের তাঁতের কাপড় ব্যবহার করে থাকে ফ্যাশন হাউসগুলো এবং এককভাবে কাজ করা ডিজাইনাররা। তবে বংশপরম্পরায় সুদীর্ঘ ঐতিহ্য টিকিয়ে রাখা বয়নশিল্পী এবং তাঁদের বৈচিত্র্যময় সৃজনকর্ম পৃষ্ঠপোষণা পেয়ে থাকে এই দেশীয় ফ্যাশনশিল্পে।

চলমান দুর্যোগ বয়নশিল্পী এবং বয়ন–উদ্যোক্তা উভয়ের সংকটকেই প্রলম্বিত করেছে। টাঙ্গাইলের বয়ন–উদ্যোক্তা নীলকমল বসাক জানালেন, টাঙ্গাইলে বয়নশিল্পের সঙ্গে সম্পৃক্ত লাখ খানেক মানুষ এখন কর্মহীন। তাঁরা কাপড় বোনা থেকে সুতা রং করা, জ্যাকার্ড তাঁতের জন্য নকশা করাসহ নানা প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত। বৈশাখ, ঈদ, পূজার মতো বড় উৎসবগুলোই তাঁদের আয়ের মূল উৎস। অথচ এই শিল্পীদের পক্ষে কারও কাছে সাহায্য চাওয়া সম্ভব না। সে জন্য তাঁর সঙ্গে যাঁরা কাজ করেন, তাঁদের নিয়মিত সহায়তা দিয়ে টিকিয়ে রাখছেন তিনি। কিন্তু তা করতে গিয়ে তাঁকে হিমশিম খেতে হচ্ছে।

জানা গেল, এই সময়ে প্রতিদিন এক হাজার থেকে দেড় হাজার পিছ শাড়ি তৈরি হয়ে থাকে। আর ঈদ এগিয়ে আসরে প্রোডাকশন দ্বিগুণ হওয়ার কথা। বর্তমান পরিস্থিতিতে তাঁরই আটকে গেছে অন্তত দেড় কোটি টাকা। কেবল স্থানীয় বাজার নয়, রয়েছে রপ্তানি বাজারও। ভারতীয় বাজারে বাংলাদেশের মধ্যমানের শাড়ির বেশ চাহিদা রয়েছে। প্রতি সপ্তাহে টাঙ্গাইল থেকে রপ্তানি হয় অন্তত দেড় কোটি টাকার শাড়ি। একইভাবে করোটিয়া আর বাজিতপুর হাট বন্ধ থাকায় উভয় হাট থেকে ক্ষতি হচ্ছে প্রতি সপ্তাহে অন্তত পাঁচ কোটি টাকা।

পরিস্থিতি এমনই দাঁড়িয়েছে যে জমি বিক্রি করে হলেও বয়নশিল্পীদের টিকিয়ে রাখতে হবে বলে আক্ষেপ করলেন নীলকমল। একই মনোভাব ব্যক্ত করে দেশের শীর্ষ একটি ফ্যাশন হাউসের স্বত্বাধিকারী বললেন, এখন জমি কেনার মানুষও নেই।

অন্যদিকে, শাহজাদপুরের বয়ন–উদ্যোক্তা আজমল কবিরও তুলে ধরেন তাঁর অসহায়তা। অন্তত আট লাখ মানুষ সিরাজগঞ্জে বয়নশিল্পের সঙ্গে জড়িত। এই প্রাদুর্ভাবের কারণে বর্তমানে সপ্তাহে অন্তত ৪০০ কোটি টাকা ক্ষতি হচ্ছে বলেই তাঁর অভিমত। তিনি আরও জানালেন, এখন ছিল রপ্তানির ভরা মৌসুম। এই সময়ে রপ্তানি বন্ধ থাকায় সমূহ ক্ষতির সম্মুখীন অন্তত ২৫ থেকে ৩০ জন উদ্যোক্তা। শাহজাদপুরের দুটি হাট থেকে প্রতি সপ্তাহে সাধারণ সময়ে রপ্তানি হয়ে থাকে প্রায় এক কোটি টাকার শাড়ি।

অন্যদিকে, আমাদের সিরাজগঞ্জ প্রতিনিধি আরিফুল গণি জানাচ্ছেন, জেলার তাড়াশ ছাড়া বাকি আটটি উপজেলাতেই রয়েছে তাঁত। বর্তমানে যন্ত্রচালিত তাঁতের সংখ্যাই বেশি। পাশাপাশি আছে টুইস্টিং মিলসহ অন্যান্য কারখানা। এসব কারখানায় গত ২০ বছরে বেড়েছে রংপুর, কুড়িগ্রাম থেকে আসা বয়নশ্রমিক। তাঁদের সংখ্যা কমপক্ষে ২০ হাজার। পাওয়ার লুমে একজন দুটি মেশিন চালাতে সক্ষম। এ কারণে দক্ষ শ্রমিকেরা সপ্তাহে অন্তত তিন হাজার থেকে চার হাজার টাকা উপার্জন করে থাকেন।

সারা দিন যেখানে তাঁতের শব্দে কান পাতা দায় ছিল, সেখানে পুরো এলাকা এখন নীরব। ফিরে গেছেন উত্তরবঙ্গের শ্রমিকেরা। পড়ে আছে তাঁত। জমছে ধুলো।

পরিস্থিতি অভিন্ন জামদানি এলাকাগুলোতেও। সোনারগাঁ, রূপগঞ্জ, সিদ্ধিরগঞ্জেও তাঁতিরা হাত গুটিয়ে বসে থাকতে বাধ্য হয়েছেন। একই সঙ্গে কর্মহীন হয়েছেন বয়নশিল্পের সঙ্গে জড়িত অন্যরাও। ডেমরা আর নোয়াপাড়া হাট বন্ধ থাকায় দুটি হাট থেকে সপ্তাহে ক্ষতি হচ্ছে অন্তত ৫০ লাখ টাকা। এর সঙ্গে ফ্যাশন হাউসনির্ভর ব্যক্তিগত উদ্যোক্তা। এদের প্রতি সপ্তাহের সামষ্টিক ক্ষতি আরও ৫০ লাখ। এদের তাঁতপ্রতি দাদন রয়েছে অন্তত এক লাখ করে। এ ছাড়া সুতা এবং অন্যান্য সামগ্রী মিলিয়ে একেকজন বয়ন–উদ্যোক্তার লগ্নি আছে কমপক্ষে দুই লাখ থেকে আড়াই লাখ টাকা। এ ছাড়া প্রতি তাঁতে প্রতিদিনের ক্ষতি অন্তত ৫০০ থেকে ১০০০ টাকা। দেশীয় বাজার ছাড়াও এসব উদ্যোক্তা দামি শাড়ি ভারতে রপ্তানি করে থাকেন। অথচ সেই বাজারও এখন বন্ধ।

রাঙামাটি থেকে ফ্যাশন ডিজাইনার তেনজিং চাকমা জানাচ্ছেন, সেখানে অন্তত ৮০০ তাঁত বন্ধ হয়ে গেছে। ভরা মৌসুম সত্ত্বেও তাঁদের হাত গুটিয়ে বসে থাকা ছাড়া গত্যন্তর নেই।

মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ থেকে আমাদের প্রতিনিধি মুজিবুর রহমানও দিয়েছেন মন খারাপ করা তথ্য। কমলগঞ্জের আদমপুর, মাধবপুর ও ইসলামপুর ইউনিয়নে তিন সম্প্রদায়ের (মৈতৈ, বিষ্ণুপ্রিয়া ও পাঙাল) মণিপুরি ও বাঙালি বয়নশিল্পী আছেন দেড় সহস্রাধিক। এখানে দুই ধরনের তাঁতে কাপড় বোনা হয়। সাধারণ তাঁতের পাশাপাশি আছে কোমরতাঁত। করোনা সংক্রমণের কারণে এখানে গত ২৪ মার্চ থেকে বন্ধ রয়েছে কাপড় বোনা। আদমপুর মণিপুরি কমপ্লেক্সে প্রধান বয়ন প্রশিক্ষক সৌদামনি সিনহার বরাত দিয়ে জানানো হয়েছে, এই সংকটের মধ্যে ১ হাজার ৪০০ টাকার শাড়ি ৯০০ টাকা থেকে ১ হাজার টাকায় বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন তাঁরা। অথচ মহাজনের কাছ থেকে সময়মতো টাকাও পাচ্ছেন না। এদিকে আদমপুর ও ইসলামপুরের কমপক্ষে ৫০০ বাঙালি বয়নশিল্পী এই বন্দী সময়ে কাজ করলেও বিক্রি করতে পারছেন না; নির্ভর করতে হচ্ছে মহাজনের ওপর। ক্ষুদ্র ঋণ সহায়তা উভয় সম্প্রদায়ের বয়নশিল্পীদের বয়ন ঐতিহ্য টিকিয়ে রাখবে বলে মন্তব্য করেছেন কমলগঞ্জ ক্ষুদ্র শিল্প উদ্যোক্তা সমিতির উপদেষ্টা, লেখক ও গবেষক আহমদ সিরাজ।

প্রতিটি বয়ন অঞ্চলই এখন ভয়াবহ দুর্দিনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। পাশাপাশি সংকটকাল অতিক্রম করছেন সুতা ব্যবসায়ীরাও। কারণ, বিভিন্ন বয়ন অঞ্চলের বয়ন–উদ্যোক্তারা সুতা কিনে থাকেন নারায়ণগঞ্জের টানবাজারের সুতার বাজার থেকে। বাংলাদেশ ইয়ার্ন মার্চেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি লিটন সাহার তথ্যানুযায়ী, স্বাভাবিক সময়ে প্রতি মাসে তাঁদের বিক্রির পরিমাণ ছিল ২৫০ কোটি টাকা। সেখানে এখন পুরোটাই বন্ধ। তিনি জানলেন, নরসিংদী, মাধবদী আর কালীবাড়ি এলাকায় প্রতি সপ্তাহে সুতা যায় ৩০ থেকে ৩৫ কোটি টাকা। অন্যদিকে, টাঙ্গাইল আর সিরাজগঞ্জে এই পরিমাণ যথাক্রমে দেড় কোটি ও আড়াই কোটি।

করোনার কারণে বন্ধ থাকায় সব শিল্প খাতের মতো বাংলাদেশের দেশীয় ফ্যাশনশিল্পও চরম অনিশ্চয়তায় পড়েছে। ছবি: আবদুস সালাম
করোনার কারণে বন্ধ থাকায় সব শিল্প খাতের মতো বাংলাদেশের দেশীয় ফ্যাশনশিল্পও চরম অনিশ্চয়তায় পড়েছে। ছবি: আবদুস সালাম

তাঁত বোর্ডের তৎপরতা
তাঁত বোর্ডের সচিব মো. আহসান হাবিবের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, তাঁরা প্রান্তিক বয়নশিল্পীদের জন্য বিশেষ সহায়তার উদ্যোগ নিয়েছেন। প্রতিটি বয়ন এলাকায় তাঁত বোর্ডের লিয়াজোঁ অফিসাররা আছেন। তাঁদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে প্রান্তিক তাঁতিদের তালিকা তৈরি করে দ্রুত জেলা ও উপজেলা প্রশাসনকে দিতে। সেই তালিকা অনুযায়ী প্রশাসনের পক্ষ থেকে ত্রাণ সহায়তা নিশ্চিত করার জন্য তাঁত বোর্ডের পক্ষ থেকে জেলা ও উপজেলা প্রশাসনকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

প্রকট হবে দক্ষ কর্মীর অভাব
করোনা সংকট থেকে উত্তরণের বলি কত মানুষ হবে, তা বলা যাচ্ছে না। তবে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা বা আইএলওর হিসাবে, বিশ্বজুড়ে বেকার হবে অন্তত আড়াই কোটি। সেই তালিকায় বাংলাদেশের না থাকার কোনো কারণ নেই; বরং অন্য শিল্প খাতের মতো ফ্যাশনশিল্পেও এর ব্যত্যয় ঘটবে বলে মনে হয় না।

উদ্যোক্তাদের আশঙ্কা, আগের অবস্থা ফেরাতে হলে ব্যয় সংকোচনের বিকল্প থাকবে না। সে ক্ষেত্রে কর্মী ছাঁটাই হয়তো অবশ্যম্ভাবী হয়ে দাঁড়াবে। এটা যেমন একটা দিক; আবার অন্য দিকও আছে। মানুষ সবার আগে চায় বাঁচার নিশ্চয়তা। তাই প্রতিকূল সময়ে যা পাবে, খড়কুটোর মতো সেটাই আঁকড়ে ধরার চেষ্টা করবে। অতএব শখের পেশা, পছন্দের পেশা বা পারিবারিক পেশা তখন গৌণ হয়ে যাবে। একইভাবে ফ্যাশন হাউসগুলো প্রশিক্ষিত কর্মী হারাবে। বয়ন–উদ্যোক্তাও হারাবেন দক্ষ বয়নশিল্পী; ফলে অবস্থা স্বাভাবিক হলে তাঁদের পাওয়া যাবে না। তাই প্রশিক্ষিত জনবল টিকিয়ে রাখা একান্ত জরুরি হয়ে দাঁড়াবে।

একই বিষয় প্রযোজ্য কারুশিল্পের ক্ষেত্রে; পরম্পরার পেশা ছেড়ে গেলে পুনরায় তাঁদের ফিরিয়ে আনা যেমন কষ্টকর, তেমনি নতুন শিল্পী তৈরির প্রক্রিয়া কেবল কষ্টসাধ্য নয়, সময়সাধ্যও বটে। উভয় ক্ষেত্রের নেতিবাচক প্রভাব পড়বে দেশীয় ফ্যাশনশিল্প খাতে।

এবার বৈশাখ ও ঈদে পোশাক কেনার অবকাশ থাকছে না বললেই চলে। ছবি: আবদুস সালাম
এবার বৈশাখ ও ঈদে পোশাক কেনার অবকাশ থাকছে না বললেই চলে। ছবি: আবদুস সালাম

এফইএবির প্রত্যাশা
চলমান সংকট মোচনের জন্য প্রয়োজনীয় আর্থিক সাহায্যের আবেদন সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রীর কাছে করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন এফইএবির সাবেক সভাপতি এবং সাদাকালোর ম্যানেজিং পার্টনার আজহারুল হক। তিনি বলেন, প্রতিষ্ঠানগুলোর কর্মীদের আগামী তিন মাসের বেতন, ভাতা, বোনাস এবং প্রান্তিক কারুশিল্পী ও বয়নশিল্পীদের কাজের মজুরি প্রদানের জন্য প্রয়োজন ১ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। এ জন্য বিনা সুদে এক বছরের জন্য ৫০০ কোটি টাকা বরাদ্দের ব্যবস্থা করার জন্য আবেদন করা হয়েছে। এই আবেদনপত্রে উদ্যোক্তাদের ব্যাংকঋণের কিস্তি কমপক্ষে ছয় মাস স্থগিত করা, এর ওপর আরোপিত সুদ ছয় মাস স্থগিত করা এবং চক্রবৃদ্ধিহারে তা পরবর্তী সময়ে ধার্য না করা, বাণিজ্যিক স্থাপনার ভাড়া হ্রাস ও ভাড়ার ওপর ভ্যাট মওকুফ, ইউটিলিটি বিল ছয় মাসের জন্য মওকুফ করা, মহামারি–পরবর্তী পুনরায় কাজ শুরু করার জন্য খুব সহজ শর্তে চলতি মূলধন জোগানের জন্য ব্যাংকগুলো নির্দেশনা দেওয়া এবং দেশীয় ও কারুশিল্পের পোশাক ব্যবহারের নির্দেশনার দাবি জানানো হয়েছে।

উত্তরণকালের নিদান
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে ডিসেম্বর গড়িয়ে যাবে। মানুষ তখন জীবন বাঁচাতেই ব্যস্ত থাকবে। ফলে, অগ্রাধিকার পাবে নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যসামগ্রী আর ওষুধ। নিতান্ত প্রয়োজন না হলে চাহিদা থাকবে না অন্য কোনো পণ্যের। ফলে, পোশাক বা অনুষঙ্গ তখন একধরনের বাহুল্য হয়ে দাঁড়াবে। এই পরিস্থিতিতে স্টক পড়ে থাকবে ফ্যাশন হাউসগুলোর। এই অবস্থা সামাল দিতে তাদের প্রয়োজন হবে নগদ অর্থের।

এ জন্য এখনই করণীয় চিহ্নিত করে ব্যবস্থা গ্রহণই হবে সময়োপযোগী পদক্ষেপ। এ ক্ষেত্রে সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগ জরুরি বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। বিশেষত সরকার কীভাবে দীর্ঘ সময়ের জন্য ন্যূনতম সুদে ঋণ দিতে পারে, সেটা ভাবা দরকার। বিশেষজ্ঞ ও উদ্যোক্তাদের নিয়েই এ সমাধান খুঁজে বের করা যেতে পারে। এ ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা রাখতে পারে এসএমই ফাউন্ডেশনও।

বিদেশি মুদ্রা আয়ের কারণে তৈরি পোশাকশিল্প খাত নামমাত্র সুদে ঋণ সহায়তা পেয়েছে। এ ক্ষেত্রে স্থানীয় ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রিকে সমান অগ্রাধিকার দেওয়া উচিত; না হলে অনেক প্রতিষ্ঠানই দেউলিয়া হয়ে যেতে পারে বলে অভিমত দিয়েছেন বাজার বিশেষজ্ঞরা।

ব্যবসায়িক বিষয় ছাড়াও দেশের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে সমুন্নত রাখার পাশাপাশি লোকশিল্পকে টিকিয়ে রেখেছে বাংলাদেশের ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রি। সেই মূল্যবোধের দৃষ্টিকোণ থেকে নীতিনির্ধারকেরা নিশ্চয়ই এই শিল্প খাতের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের সংকটকে আমলে নেবেন বলেও মনে করেন তাঁরা।

বিপাকে পড়বে তাঁতশিল্পও। ছবি: নীলকমল বসাক
বিপাকে পড়বে তাঁতশিল্পও। ছবি: নীলকমল বসাক

আশা নিয়ে পথচলা
এখনই চরম আর্থিক সংকটে ফ্যাশন হাউসের উদ্যোক্তা, বয়ন–উদ্যোক্তাসহ প্রান্তিক কারুশিল্পীরাও। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে প্রত্যেকেই পড়বেন কার্যকর মূলধন সংকটে।

৫ এপ্রিল প্রধানমন্ত্রী তাঁর বক্তব্যে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের জন্য বিশেষ তহবিলের ঘোষণা দিয়েছেন। এই তহবিল থেকে প্রদত্ত ঋণের সুদের হার ৯ শতাংশ হলেও সরকার ৫ শতাংশ ভর্তুকি হিসেবে প্রদান করবে। বাকি ৪ শতাংশ দিতে হবে উদ্যোক্তাদের। তাঁর এই উদ্যোগ সবাইকে কোনো সন্দেহ নেই, আশাবাদী করেছে।

সম্প্রতি স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড তাদের ক্লায়েন্টদের চাহিদা অনুযায়ী বিস্তারিত সহায়তা স্কিম প্রদানের ঘোষণা দিয়েছে। এর আওতায় ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের জন্য পেমেন্ট হলিডে, ঋণ পরিশোধের মেয়াদ বৃদ্ধি, সাময়িক ওভারড্রাফট এবং কিছু ক্ষেত্রে ঋণের পরিমাণ বৃদ্ধির সুখবর এক সংক্ষিপ্ত ভিডিও বার্তায় দিয়েছেন প্রতিষ্ঠানের প্রধান নির্বাহী নাসের এজাজ।

বাংলাদেশের একাধিক শীর্ষ ফ্যাশন হাউসের সঙ্গে দীর্ঘ সম্পর্ক সিটি বাংকের। ফলে, এই দুঃসময়ে তাদের পাশে দাঁড়াচ্ছে বলে জানিয়েছেন ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী মাসরুর আরেফিন। ফ্যাশন–উদ্যোক্তা ক্লায়েন্টদের জন্য পেমেন্ট হলিডের ব্যবস্থা কীভাবে করা যায়, তা নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে আলোচনা করছেন বলে জানিয়ে তিনি বলেছেন, এ ছাড়া পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল দেওয়ার বিষয়টি বিশেষ বিবেচনায় রাখার পাশাপাশি সার্বিক সহায়তা পরিকল্পনাও তাঁদের রয়েছে।

অন্যান্য ব্যাংকও নিশ্চয়ই নিজেদের ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তা ক্লায়েন্টদের জন্য তাদের মতো করে পরিকল্পনা সাজাচ্ছে। তবে কীভাবে তাদের কাছে এই ঋণ পৌঁছাবে, সেটাই এখন মূল বিষয়। ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের সংকট মোচনে প্রয়োজনীয় ঋণ সহায়তা নিশ্চিত করতে ইতিমধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে আলোচনা চালাচ্ছে বলে এসএমই ফাউন্ডেশন সূত্রে জানা গেছে।

এবারের অবরুদ্ধ বৈশাখ উদ্‌যাপনে পোশাক কেনার অবকাশ থাকছে না। ছবি: নীলকমল বসাক
এবারের অবরুদ্ধ বৈশাখ উদ্‌যাপনে পোশাক কেনার অবকাশ থাকছে না। ছবি: নীলকমল বসাক

বদলে যাওয়া দিনের করণীয়
করোনা-পরবর্তী পৃথিবীর গতি-প্রকৃতি বদলে যাবে আমূল। বদলাবে মানুষের জীবনযাত্রা। ব্যবসা-বাণিজ্যের ধরন এবং চাহিদা ও জোগানের সমীকরণে আসবে ব্যাপক বৈশিষ্ট্যগত পরিবর্তন। ঘটমান বর্তমানের উদ্বেগ আর অনতি ভবিষ্যতের অনিশ্চয়তার সমান্তরালে আগামীর ভাবনায় অবশ্য প্রাধান্য থাকতে হবে বাস্তবানুগ কর্মপরিকল্পনার। কারণ অনেক কিছুরই মুখোমুখি হতে হবে বাংলাদেশের ফ্যাশনশিল্প খাতকে। এর সঙ্গে কেবল উদ্যোক্তাদের অস্তিত্ব জড়িয়ে নেই, বরং দেশের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য আর কারুশিল্পের অবলুপ্তির শঙ্কাও সবিশেষ সম্পৃক্ত। ভবিষ্যৎ সংকট নিরসনে অর্থসংস্থান নিশ্চিতের পাশাপাশি পুনর্গঠনকে সমান গুরুত্বে বিবেচনা না করলে সাময়িক স্থবিরতা কাটানো সম্ভব হলেও ভবিষ্যতের পথ সুগম করা আদৌ সম্ভব হবে না। এ জন্যই প্রয়োজন ঋণ সহায়তা নিশ্চিতের পাশাপাশি কিছু জরুরি উদ্যোগ গ্রহণ।

প্রথমত, সর্বপ্রথম এই শিল্পকে শিল্প খাত হিসেবে চিহ্নিত করে প্রয়োজনীয় নীতিমালা প্রণয়ন হবে সবচেয়ে সময়োপযোগী পদক্ষেপ। বাংলাদেশের ফ্যাশনশিল্পকে শিল্প খাত হিসেবে চিহ্নিত করে কার্যকর উদ্যোগ নেওয়ার আবেদন শিল্প মন্ত্রণালয়কে ২০১৫ সালে দিয়ে রেখেছে এফইএবি। মন্ত্রণালয়কে অতীব গুরুত্বে বিষয়টি বিবেচনার পাশাপাশি এর বাস্তবায়নে এফইএবিকেও পুনরায় কার্যকর ভূমিকা নিতে হবে।

দ্বিতীয়ত, এফইএবি, এফডিসিবিসহ নানা সংগঠন এবং এসএমই ফাউন্ডেশনসহ বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে সামষ্টিকভাবে প্রচারণা চালাতে হবে। যেখানে প্রাধান্য পাবে মূল্যবোধ, দেশপ্রেম, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য ও লোকশিল্প। কারণ, এগুলোই এই শিল্পের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে মিশে আছে।

তৃতীয়ত, সমস্ত সরকারি এবং বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সবাই যাতে দেশীয় পণ্য পরেন এবং উপহার দেন, সে জন্য সবার তরফে অনুরোধ রাখতে হবে। এ ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা সবিশেষ কার্যকর হবে বলেই বিশেষজ্ঞদের অভিমত।

চতুর্থত, এই শিল্প খাতের জন্য হুমকি হতে পারে—এমন সব বিদেশি পণ্যের আমদানি অন্তত দুই বছরের জন্য বন্ধের উদ্যোগ নিতে হবে। এ ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট সরকারি কর্তৃপক্ষ বিশেষ ভূমিকা রাখতে পারে। একেবারে বন্ধ করা না গেলে বিভিন্ন শুল্ক আর রাজস্ব বাড়াতে হবে।

করোনার প্রাদুর্ভাব উতরে নতুন সূর্য উদয়ের অপেক্ষায় বিশ্বগ্রামের বাসিন্দারা। নিশ্চয়ই এরই মধ্যে মুছে যাবে আবিশ্বের মলিন মর্ম। প্রতীক্ষা সেই সুদিনের।