পোশাক রপ্তানিতে বড় ধসের শঙ্কা

ফাইল ছবি
ফাইল ছবি
>*৩১৫ কোটি ডলারের পোশাক রপ্তানি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার দাবি বিজিএমইএর
* এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে পোশাক রপ্তানি কমে গেছে ৭৭ দশমিক ৭৬ শতাংশ

করোনাভাইরাসের কারণে বড় ধরনের ঝাঁকুনি খেয়েছে দেশের রপ্তানিমুখী তৈরি পোশাকশিল্প। ইউরোপ, যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের দেশে দেশে করোনা ছড়িয়ে পড়ায় গত মাসে বিপুলসংখ্যক ক্রয়াদেশ বাতিল ও স্থগিত করেছে বিদেশি ব্র্যান্ড ও ক্রেতা প্রতিষ্ঠান। এরপর ভাইরাসটির সংক্রমণ কমাতে কারখানা বন্ধ করা হয়েছে। এর ফলে ইতিমধ্যে পোশাক রপ্তানি ব্যাপকভাবে কমে গেছে।

চলতি এপ্রিল মাসের প্রথম সাত দিনে ১২ কোটি ৯৪ লাখ ডলারের পোশাক রপ্তানি হয়েছে। অথচ গত বছরের এপ্রিলের প্রথম সাত দিনে রপ্তানি হয়েছিল ৫৮ কোটি ১৯ লাখ ডলারের ডলারের পোশাক। সেই হিসাবে চলতি এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে পোশাক রপ্তানি কমে গেছে ৭৭ দশমিক ৭৬ শতাংশ। অবশ্য পোশাক রপ্তানিতে বড় ধাক্কার আভাস গত মাসেই মিলেছিল। গত মার্চে ১৯৭ কোটি ডলারের পোশাক রপ্তানি হয়েছে, যা গত বছরের মার্চের চেয়ে ৩০ শতাংশ কম। ২০১৯ সালের মার্চে রপ্তানি হয়েছিল ২৮২ কোটি ডলারের পোশাক।

জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) ও রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) বরাত দিয়ে এসব তথ্য জানিয়েছে তৈরি পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ। এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহের রপ্তানি, পোশাকের ক্রয়াদেশ বাতিল ও স্থগিত পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করে সংগঠনটির পূর্বাভাষ হচ্ছে, শেষ পর্যন্ত চলতি এপ্রিলে সব মিলিয়ে ৭৬ কোটি ডলারের পোশাক রপ্তানি হতে পারে। সেটি হলে গত বছরের এপ্রিলের চেয়ে রপ্তানি কম হবে প্রায় ৭০ শতাংশ। মে মাসেও পোশাক রপ্তানি শত কোটি ডলারে পৌঁছাবে না বলেই আশঙ্কা করছে বিজিএমইএ।

জানতে চাইলে বিজিএমইএর সভাপতি রুবানা হক বলেন, ‘করোনাভাইরাসের কারণে বর্তমান পরিস্থিতিতে আমরা আশঙ্কা করছি, গত বছরের মার্চ-মে মাসের তুলনায় চলতি বছরের একই সময়ে অর্থাৎ মার্চ থেকে মে পর্যন্ত তিন মাসে ৪৯০ কোটি ডলারের পোশাক রপ্তানি কম হবে।’

ইপিবির তথ্যানুযায়ী, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৩ হাজার ৪১৩ কোটি ডলারের পোশাক রপ্তানি হয়। তখন প্রবৃদ্ধি ছিল সাড়ে ১১ শতাংশ। ২০১৯-২০ অর্থবছরের প্রথম আট মাসে (জুলাই-ফেব্রুয়ারি) ২ হাজার ১৮৪ কোটি ডলারের পোশাক রপ্তানি হয়েছে। এই আয় গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে সাড়ে ৫ শতাংশ কম।

মহামারি করোনাভাইরাসের কারণে বিশ্বব্যাপী মৃত মানুষের সংখ্যা গতকাল রোববার রাত নয়টা পর্যন্ত ১ লাখ ১০ হাজার ছাড়িয়ে গেছে। ভাইরাসটির সংক্রমণ ঠেকাতে বিশ্বের অনেক দেশই লকডাউন অবস্থায় রয়েছে। দোকানপাট বন্ধ থাকায় ক্রেতা প্রতিষ্ঠান ও ব্র্যান্ড গত মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে পোশাকের ক্রয়াদেশ বাতিল ও স্থগিত করতে শুরু করে। গতকাল রোববার সকাল ১০টা পর্যন্ত ১ হাজার ১৩৪ কারখানার ৯৭ কোটি ৫২ লাখ পিছ পোশাকের ক্রয়াদেশ স্থগিত ও বাতিল হয়েছে। তাতে ৩১৫ কোটি ডলারের পোশাক রপ্তানি ক্ষতিগ্রস্ত হবে, এমনটাই দাবি বিজিএমইএর।

অবশ্য সুইডেনভিত্তিক খুচরা বিক্রেতা প্রতিষ্ঠান এইচঅ্যান্ডএম তাদের মনোনীত কারখানায় ইতিমধ্যে যেসব পোশাক তৈরি হয়েছে, সেগুলো নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। অনেকটা সেই পথেই হাঁটবে বলে পোশাক রপ্তানিকারকদের ইতিমধ্যে জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের পিভিএইচ, টার্গেট, গ্যাপ ও ভিএফ করপোরেশন, স্পেনের ইন্ডিটেক্স, যুক্তরাজ্যের মার্কস অ্যান্ড স্পেনসার (এমঅ্যান্ডএস) ও টেসকো, ফ্রান্সের কিয়াবি, পোল্যান্ডের এলপিপিসহ কয়েকটি ক্রেতা প্রতিষ্ঠান ও ব্র্যান্ড। তার মধ্যে গ্যাপ বসন্ত ও গ্রীষ্মের জন্য সরবরাহ করা পোশাকে ১২ শতাংশ মূল্যছাড় দাবি করেছে। তা ছাড়া কয়েকটি ব্র্যান্ড জানিয়েছে, পোশাকের মূল্য পরিশোধে বিলম্ব হবে।

এদিকে করোনার কারণে পোশাক রপ্তানিতে সমস্যা হতে পারে—সেই ভাবনা থেকে গত মাসেই প্রধানমন্ত্রী পোশাকসহ রপ্তানিমুখী প্রতিষ্ঠানের শ্রমিকদের মজুরি পরিশোধের সুবিধার্থে পাঁচ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেন। সেই তহবিল থেকে পোশাকশিল্পের মালিকেরা এপ্রিল, মে ও জুন মাসের মজুরি পরিশোধে ঋণ নিতে পারবেন। সে জন্য মাত্র ২ শতাংশ মাশুল দিলেই চলবে মালিকদের।

এদিকে শ্রমিকের মার্চ মাসের মজুরিই পরিশোধ করতে পারছেন না অনেক কারখানা মালিক। এ কারণে গতকাল ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর, সাভার-আশুলিয়ার অন্তত দুই ডজন কারখানার শ্রমিক মজুরির জন্য বিক্ষোভ করেছেন।

জানতে চাইলে নিট পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএর প্রথম সহসভাপতি মোহাম্মদ হাতেম প্রথম আলোকে বলেন, ‘করোনার কারণে ২৫ মার্চের পর অধিকাংশ কারখানার উৎপাদন বন্ধ হয়ে যায়। তবে মার্চের শেষ দিন পর্যন্ত কিছু কারখানা উৎপাদন চালিয়েছে। মূলত তাদের পণ্যই রপ্তানি হয়েছে। ফলে রপ্তানিতে ধস নামবে সেটিই স্বাভাবিক। ক্রেতাদের কাছ থেকে যেসব তথ্য পাচ্ছি তাতে মনে হচ্ছে, পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলেও খুব শিগগির কারখানাগুলো পূর্ণ সক্ষমতা অনুযায়ী কাজ পাবে না। তাতে শেষ পর্যন্ত কত কারখানা টিকে থাকতে পারবে, সেটিই এখন বড় প্রশ্ন।’