কাজ হারাচ্ছেন দেশের ফ্রিল্যান্সাররা, সংকটে গিগ অর্থনীতি

প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগ থেকে স্নাতকোত্তর করার পর চাকরি-বাকরি না খুঁজে ফ্রিল্যান্স অনুবাদের কাজ শুরু করেন তোয়াসিন অফি। প্রথমে বাসায় বসে ব্যক্তিগত পরিসরে শুরু। এরপর একসময় নিজেই একটি এজেন্সি প্রতিষ্ঠা করেন। তাতে ভালোই চলছিল তাঁর, ছিল সচ্ছলতা, স্বপ্ন ছিল আরও বড় হওয়ার। কিন্তু কোভিড-১৯-এর প্রাদুর্ভাব শুরু হওয়ার পর সব বদলে গেছে। অফিস তো বন্ধই, প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়েও কাজ চালানো সম্ভব হচ্ছে না, যা করছেন ব্যক্তিগত পরিসরে। 

ফ্রিল্যান্সিংসহ গিগ অর্থনীতির চিত্রটা এখন সারা বিশ্বেই এমন। কোভিড-১৯–এর প্রভাবে ক্রমবর্ধমান এই গিগ অর্থনীতি অনেকটাই জৌলুস হারাবে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকেরা। অর্থনীতির ভালো সময়ে এই ধরনের স্বাধীন ও ঠিকা কাজের বাড়বাড়ন্ত থাকে, কিন্তু সারা বিশ্বে লকডাউন শুরু হওয়ায় স্বাভাবিকভাবেই কাজের চাহিদা কমে গেছে। এই পরিস্থিতিতে বিপাকে পড়েছেন দেশের রাইড শেয়ারিংয়ের কর্মী, ফ্রিল্যান্সারসহ বিভিন্ন খাতের এই গিগ কর্মীরা।

কয়েক বছর ধরেই গিগ অর্থনীতি শব্দটি বিভিন্ন পরিসরে উচ্চারিত হচ্ছে। বলা হচ্ছে, মানুষ এখন আর দীর্ঘ মেয়াদে এক কাজ করবে না, একসঙ্গে একাধিক স্বল্পমেয়াদি কাজ করবে। প্রতিষ্ঠানগুলো পূর্ণকালীন কর্মীদের চেয়ে ফ্রিল্যান্সারদের গুরুত্ব বেশি দেবে এবং বেশির ভাগ কাজ এদের দিয়েই করাবে। এই ধারার সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলার ক্ষমতাকে বা এই রকম ফ্রিল্যান্স দক্ষতাগুলোকে বলা হচ্ছে ‘গিগ ক্যাপাসিটি’। যেই দেশ বা শহর যত বেশি প্রযুক্তিগতভাবে উন্নত ও গতিশীল, সেই দেশে বা শহরে এই ‘গিগ ক্যাপাসিটিসম্পন্ন’ লোকবলের দরকার বেশি হবে।

তোয়াসিন অফি বলেন, ‘অফিস তো বন্ধ এক মাস ধরে, কাজও অনেক কমে গেছে, এই পরিস্থিতিতে ঘরে বসে টুকটাক ফ্রিল্যান্সিংয়ের কাজ করছি, সেটাও আবার ব্যক্তিগত পর্যায়ে।’

তবে ফ্রিল্যান্সিংয়ের কাজ নির্ভর করছে এখানকার প্রতিষ্ঠানগুলো কোন দেশের প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে কাজ করছে, তার ওপর। আইটিভিত্তিক ফ্রিল্যান্স এজেন্সি ভিসের এক্সের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ফয়সাল মোস্তফা বলেন, যেসব দেশ খুব একটা আক্রান্ত হয়নি, তারা টুকটাক কাজ চালিয়ে যাচ্ছে, যেমন কানাডা। তাই কিছু কিছু প্রতিষ্ঠান এখনো কাজ চালিয়ে নিতে পারছে। আবার কাজের ধরনের ওপরও এই সময় কাজ প্রাপ্তি নির্ভর করছে বলে জানান তাঁরা। অনেকে আবার কম রেটে কাজ করছেন। তবে অনেক প্রকল্পই বাতিল হয়েছে। এই খাতের অনেক কর্মী কাজ হারাচ্ছেন। এই চিত্র ফ্রিল্যান্সিংয়ের প্রায় সব ক্ষেত্রের । কর্মীদের বেতন দিতে পারছেন কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে আরেক আইটিভিত্তিক ফ্রিল্যান্সিং এজেন্সির কর্ণধার নাম প্রকাশে অনিচ্ছা জানিয়ে বলেন, ‘এখনো দিতে পারছি। তবে এই পরিস্থিতি আরও দীর্ঘায়িত হলে কী হবে বলা যায় না। আমরা শঙ্কিত।’

বেসিস সভাপতি সৈয়দ আলমাস কবীর বলেন, ‘উন্নত দেশে লক ডাউন চলছে বলে ফ্রিল্যান্সারদের কাজ কমে গেছে। আবার ফ্রিল্যান্সারদের ট্রেড লাইসেন্স বা আইনি সত্তা না থাকায় সরকারের প্রণোদনার আওতার বাইরে থেকে যাচ্ছেন তাঁরা। বেসিসের পক্ষ থেকে আমরা চেয়েছিলাম, ফ্রিল্যান্সারেরা একটা কাঠামোর মধ্যে আসুক। কিন্তু সেটা পুরোপুরি বাস্তবায়িত হয়নি। অন্যদিকে মূল প্রতিষ্ঠানগুলো যে তাদের ক্ষতিপূরণ দেবে, তাও বোধ হয় সম্ভব নয়। এ জন্য কাঠামো থাকলে সুবিধা হতো। তবে যারা এখনো কিছু কাজ দিচ্ছে, তারা অনেকেই কাজের জন্য বেশি মূল্য দিচ্ছে।’

এই পরিস্থিতিতে আলমাস কবীরের পরামর্শ হচ্ছে, ফ্রিল্যান্সাররা যেন তাদের কাজের পরিসর বৃদ্ধি করে, শুধু বৈশ্বিক বাজারের দিকে তাকিয়ে না থেকে স্থানীয় বাজারের সম্ভাবনাও যেন তারা খুঁজে দেখে।

ব্যাপারটা হলো, স্বাস্থ্য সেবা সুবিধা বা আপৎকালীন সুবিধা না থাকলে এই কর্মীরা মহামারির মতো সময় মহাবিপাকে পড়েন। উন্নত দেশগুলোতেও এই বিতর্ক ইতিমধ্যে শুরু হয়েছে। সেসব দেশে অবশ্য বেকার ভাতা আছে, গিগ কর্মীদের অনেকেই বেকার ভাতার আবেদন করেছেন। সেখানেও এই ভাতা পেতে নানা বিপত্তির মুখে পড়ছেন এই কর্মীরা। কিন্তু বাংলাদেশ তো সেই সুযোগ নেই, এই দুর্যোগে নিজেদের ব্যবস্থা নিজেদেরই করতে হচ্ছে তাঁদের।

অর্থনীতিবিদ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান সানেমের নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান বলেন, ‘গিগ অর্থনীতিতে নতুন কাজের সংস্থান হয়েছে। কাজের নতুন ধারণা নিয়ে এসেছে এই খাত। আমি মনে করি, দেশের জিডিপিতে এদের অবদান কতটা, তা পরিমাপ করা উচিত। অন্যান্য খাত যেমন সরকারের সহায়তা পাচ্ছে, তেমনি তাদেরও পাওয়া উচিত। বৈশ্বিক ব্যান্ডগুলোকেও এখন দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে হবে। এরা এত দিন তাদের হয়ে কাজ করেছে, তা-ই এই মুহূর্তে ফ্রিল্যান্সারদের কিছু ক্ষতিপূরণ দেওয়া উচিত তাদের।’

গিগ অর্থনীতির অন্যান্য খাতের মধ্যে রাইড শেয়ারিংয়ের কর্মীরা একেবারে বেকার হয়ে পড়েছেন। সরকারের নির্দেশে রাইড শেয়ারিং সেবা বন্ধ আছে। রাইড শেয়ারিং কোম্পানিগুলোর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এই পরিস্থিতিতে রাইডারদের সহায়তা করার পথ খুঁজছে তারা। ইতিমধ্যে কিছু সহায়তা করাও হচ্ছে।

এসব খাতে কাজ হারালেও গিগ অর্থনীতিতে আবার কিছু নতুন কাজের সুযোগ সৃষ্টি হচ্ছে। সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে মানুষ ঘর থেকে কম বেরোচ্ছে। অনেকে অনলাইন মার্কেট প্লেসগুলো থেকে নিত্যপ্রয়োজনীয় খাবারসহ অন্যান্য সামগ্রী কিনছেন। সে কারণে চাল-ডাল-সবজি সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানগুলো এখন নতুন কর্মীও নিয়োগ দিচ্ছে। তবে এই খাতের নিয়মিত কর্মীদের মধ্যে অনেকে বাড়ি চলে গেছেন।