বিশ্বায়ন ও স্বনির্ভরতার মধ্যে আরও ভারসাম্য দরকার

>করোনার কারণে বিশ্ব আজ বলতে গেলে অবরুদ্ধ। বাড়ছে মৃত্যুর মিছিল। ভেঙে পড়েছে সরবরাহ ব্যবস্থা, স্থবির অর্থনীতির চাকা। জলে-স্থলে-অন্তরীক্ষে পরিবহন-যোগাযাগ বন্ধ। এক দেশের মানুষ অন্য দেশে যায় না, যেতে পারেও না। এমনকি পাশের বাড়ি কিংবা পার্শ্ববর্তী এলাকাতেও আসা-যাওয়া নিষেধ। সব মিলিয়ে চরম অনিশ্চয়তায় বিশ্বজুড়ে থমকে গেছে মানবজীবন। তবে এটিই শেষ কথা নয়। করোনার এই পরিস্থিতি থেকে একদিন মুক্তি পাবে পৃথিবী। তখন কেমন হবে বৈশ্বিক অর্থনীতির চালচিত্র? অর্থনীতির বিশ্বখ্যাত বিশ্লেষক শুনিয়েছেন আশার কথা, ভয়াবহ এই মহামারি বিশ্ব অর্থনীতিকে চিরতরে বদলে দেবে। স্থায়ী পরিবর্তন ঘটবে রাজনীতিরও। অভিমতগুলো নিয়েছে ফরেন পলিসি ডটকম।
জোসেফ স্টিগলিৎজ
জোসেফ স্টিগলিৎজ

কোনো দেশের খাদ্য ও জ্বালানি নিরাপত্তাসংক্রান্ত নীতিমালার কথা উঠলে সেটাকে অর্থনীতিবিদেরা সাধারণত উপহাস বা হাসি-ঠাট্টার দৃষ্টিতে দেখে থাকেন। বিশ্বায়িত এই পৃথিবীতে বর্ডার বা দেশের সীমানা কোনো ব্যাপার নয়। এই অবস্থায় তাঁদের যুক্তি হলো, ‌‘আমাদের নিজেদের দেশে ‌যদি কোনো সমস্যা দেখা দেয়, তাহলে আমরা সব সময়ই অন্য যেকোনো দেশে চলে যেতে পারি।’ কিন্তু তাঁরা অবাধে নিজ দেশের সীমান্ত ছাড়িয়ে অন্য দেশে যাওয়ার যে কথা বলেছেন, তা হঠাৎ বন্ধ হয়ে গেছে। চাইলেই এখন অন্য দেশে যাওয়া যায় না। কারণ, সব দেশই ইতিমধ্যে তাদের নিজ নিজ সীমান্ত বন্ধ বা সেখানে কড়াকড়ি আরোপ করেছে। তারা সবার জন্য মাস্কসহ মেডিকেল ইকুইপমেন্ট বা চিকিৎসা সরঞ্জাম ব্যবহারে বেশ জোর দিয়েছে। এ ছাড়া তারা সবাই সরবরাহ ব্যবস্থা স্বাভাবিক করার সংগ্রামে অবতীর্ণ রয়েছে। করোনাভাইরাস সংকট আমাদের জাতি-রাষ্ট্রের মৌলিক রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিষয়গুলোই জোরালোভাবে মনে করিয়ে দিয়েছে।

একটি কার্যকর সাপ্লাই চেইন বা সরবরাহ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে আমরা সর্বনিম্ন দামে পণ্য দিতে পারে এমন সব উৎপাদককে বিশ্বব্যাপী খুঁজেছি। কিন্তু এ ক্ষেত্রে আমরা ছিলাম ক্ষীণদৃষ্টিসম্পন্ন মানে অদূরদর্শী। যে কারণে সরবরাহ ব্যবস্থাটি টেকসই হয়নি, তাতে বৈচিত্র্যের অভাব ছিল এবং বাধা-বিঘ্নের কারণে তা হয়ে গেছে ঝুঁকিপূর্ণ। যথাসময়ে পণ্য উৎপাদন ও সরবরাহ এবং ছোটখাটো সমস্যা সামলে নেওয়ার ওপর জোর দিলেও আমরা এখন দেখছি, অপ্রত্যাশিত ও আকস্মিকভাবে উদ্ভূত এক প্রতিবন্ধকতার কারণে সেই ব্যবস্থা ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে।

২০০৮ সালের বিশ্ব অর্থনৈতিক সংকট কাটিয়ে ঘুরে দাঁড়ানোর যে নজির তখন তৈরি হয়েছে, তা থেকে আমাদের শিক্ষা নেওয়া উচিত ছিল। তখন আমরা আন্তসংযুক্ত বা পরস্পরসংযুক্ত একটি আর্থিক ব্যবস্থা গড়ে তুলেছিলাম, যেটাকে আপাতদৃষ্টিতে কার্যকর এবং সম্ভবত ছোটখাটো ধাক্কা বা অভিঘাত মোকাবিলায় সক্ষম বলে মনে হয়েছিল। কিন্তু এটি আসলে পদ্ধতিগতভাবেই ছিল ভঙ্গুর প্রকৃতির। রিয়েল এস্টেট বা আবাসন খাত যেভাবে ফুলে–ফেঁপে উঠেছিল তাতে সরকারের সর্বাত্মক বেইলআউট বা পুনরুদ্ধার কর্মসূচি না থাকলে গোটা ব্যবস্থাটিই মুখ থুবড়ে পড়ত। অথচ সেই সময়কার শিক্ষা ঠিক আমাদের মাথার ওপর দিয়েই চলে গেছে।

বর্তমান মহামারি পরিস্থিতির পরে আমরা যে অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গড়তে চলেছি, সেটি হবে মোটামুটি দূরদর্শী, অধিকতর সহনক্ষমতাসম্পন্ন ও সংবেদনশীল। ফলে অর্থনৈতিক বিশ্বায়ন রাজনৈতিক বিশ্বায়নকে ছাপিয়ে বড় হয়ে উঠবে। এই যখন হবে বৈশ্বিক পরিস্থিতি তখন দেশগুলোকে প্রাণপণে বিশ্বায়ন ও স্বনির্ভরতার মধ্যে সুসম ভারসাম্য নিশ্চিত করে সুযোগগুলো কাজে লাগানোর চেষ্টা করতে হবে।

জোসেফ স্টিগলিৎজ: অর্থনীতির অধ্যাপক, কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়, ২০০১ সালে অর্থনীতিতে নোবেলজয়ী।