জাতীয় সংকট মোকাবিলায় সমন্বিত প্রচেষ্টা দরকার

>পুরো বিশ্বই এখন করোনাযুদ্ধে লিপ্ত। মানুষের প্রাণ বাঁচাতে হিমশিম খাওয়া রাষ্ট্রগুলোর সামনে আরও আছে বিপর্যস্ত অর্থনীতি। বাংলাদেশও এর বাইরে নয়। করোনায় তছনছ হয়ে যাওয়া অর্থনীতি ফিরবে তো আগের অবস্থায়? কর্মহীন বিপুল মানুষের কর্মসংস্থান হবে তো? স্বাস্থ্য, শিক্ষাসহ মানুষের মৌলিক চাহিদাগুলো নিশ্চিতে কোনো উন্নতি হবে কি? প্রশ্নগুলো এখন ঘুরপাক খাচ্ছে জনমনে। যদিও অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে এরই মধ্যে লাখ কোটি টাকার প্রণোদনা ঘোষণা করা হয়েছে। তবু দেশজুড়ে ক্ষুধার্ত ও কর্মহীন মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। করোনা-পরবর্তী অর্থনীতি, রাজনীতি, রাষ্ট্রব্যবস্থা ও সামাজিক খাতে কী ধরনের পরিবর্তন আসতে পারে, তা নিয়েই এই আয়োজন।
রওনক জাহান
রওনক জাহান

দুই মাস ধরে কোভিড-১৯-এর হুমকির মুখে জীবন যাপন করছি। এই অনিশ্চয়তা, জীবনের আরেক অনিশ্চিত সময় ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের কথা মনে করিয়ে দিচ্ছে। তখন অবশ্য শত্রুকে দেখা যেত। ফলে তার বিরুদ্ধে আমরা যেমন ঐক্যবদ্ধ ছিলাম, তেমনি সক্রিয় ছিলাম। জানতাম, কী করতে হবে। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতি অনেক বেশি অনিশ্চিত। শত্রু দৃশ্যমান নয়। আমরা যেমন জানি না তার বিরুদ্ধে কী করতে হবে, তেমনি আমরা ঐক্যবদ্ধও নই। চীন, ইতালি, স্পেন, যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রে যে ভয়াবহতা দেখছি, তাতে শিউরে উঠছি। হতাশ হচ্ছি ভবিষ্যৎ নিয়ে, ভাবছি, এ রকম ধনী দেশই যেখানে এই শত্রুকে সামলাতে পারছে না, সেখানে আমরা কী করব?

তবে এটাও মনে রাখা উচিত, ভিয়েতনাম খুব ধনী দেশ না হলেও পরিস্থিতি সামলে নিয়েছে। ভারতের কেরালা রাজ্যও অনেক ভালো করেছে। তারা যথাসময়ে রাষ্ট্র ও সমাজের সব শক্তিকে ব্যবহার করে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে পেরেছে বলে এই মহামারি সামলাতে সক্ষম হয়েছে।

দেরিতে হলেও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশনার আলোকে আমরা বেশ কিছু ব্যবস্থা নিয়েছি। কিন্তু বাস্তবায়নপ্রক্রিয়া দুর্বল হওয়ায় কাঙ্ক্ষিত ফল আসেনি। আমাদের শাসনব্যবস্থার দুর্বলতা দৃশ্যমান। সরকারের বিভিন্ন সংস্থার পাশাপাশি সরকারি ও বেসরকারি খাতের মধ্যেও সমন্বয়হীনতা দেখা গেছে। কিছু কিছু বেসরকারি সংস্থা (এনজিও) ও ব্যক্তিবর্গ ত্রাণ, পরীক্ষার কিট, ভেন্টিলেটর ও পিপিই বিতরণ করেছেন, কিন্তু এত সব তৎপরতা কীভাবে সমন্বয় করা হবে, তা কেউ জানে না। ফলে আমরা উদ্যোগগুলোর সর্বোচ্চ ব্যবহার করতে পারছি না।

আক্রান্ত মানুষের তথ্য-উপাত্ত দেখে মনে হচ্ছে, আমরা কেবল বরফখণ্ডের চূড়া দেখতে শুরু করেছি, বড় অংশ এখনো দেখা বাকি। কবে লকডাউন তোলা যাবে এ বিষয়ে স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা নিশ্চিত কিছু বলতে পারছেন না। সরকারের সামনে যেসব পথ খোলা আছে, তার সব কটিই ঝুঁকিপূর্ণ। যেমন তৈরি পোশাকসহ অন্যান্য কারখানা খুলে দেওয়া। পোশাক খাতের মালিকেরা বাজার হারানোর ঝুঁকির কথা বলেন। আবার কর্মজীবী মানুষ কাজ হারানোর ঝুঁকির কথা বলছেন। কথা হচ্ছে, কর্মজীবীদের স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তার কথা কে বলবে? কারখানা খোলার কারণে যদি আক্রান্তের সংখ্যা ব্যাপক হারে বাড়ে, তাহলে সেই দায় তো রাষ্ট্রকেই নিতে হবে। আবার শ্রমিকেরা বিক্ষোভ শুরু করলে রাষ্ট্রকেই তাঁদের ক্ষোভ আমলে নিতে হবে।

রাষ্ট্রের বিভিন্ন সংস্থা এখন প্রচণ্ড চাপের মুখে আছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ঝুঁকি নিয়ে নিজস্ব দায়িত্বের বাইরে গিয়ে অনেক ধরনের কাজ করছে। আমাদের অপ্রতুল স্বাস্থ্যব্যবস্থা এই মহামারি সামাল দিতে ব্যাপক চাপের মুখে পড়েছে। একদিকে ব্যক্তিগত স্বাস্থ্য সুরক্ষাসামগ্রীর অভাব, অন্যদিকে প্রশিক্ষিত জনবলের ব্যাপক ঘাটতি। তবে এই মহামারি আমাদের স্বাস্থ্যব্যবস্থায় বড় পরিবর্তন আনবে, এমন প্রত্যাশা করি। কারণ, এখন আমরা অন্তত বুঝতে পারছি, এই ধরনের মহামারি অপ্রতুল স্বাস্থ্যব্যবস্থা নিয়ে মোকাবিলা করা কতটা কঠিন। সরকারের যেসব সংস্থা ত্রাণ দিচ্ছে, তারাও ব্যাপক চাপের মুখে আছে। ত্রাণের উপকরণ নিয়ে দুর্নীতি হচ্ছে, এগুলোর অপব্যবহার হচ্ছে—এমন অভিযোগ আসছে।

রাষ্ট্রের পক্ষে সবকিছু একা সামাল দেওয়া সম্ভব নয়। রাষ্ট্র যখন সবাইকে একসূত্রে গাঁথতে পারবে অর্থাৎ বেসরকারি খাত, এনজিও, নাগরিক সমাজের সংগঠন (সিএসও), সামাজিক সংগঠন (সিবিও)—সবার মধ্যে সমন্বয় ঘটাতে পারবে, তখন এ ধরনের পরিস্থিতি আরও সফলভাবে মোকাবিলা করা যাবে। ভিয়েতনাম ও কেরালায় এটি হয়েছে। মহামারিতে পুরো জাতি আক্রান্ত হয়েছে, তাই সবাইকে নিয়ে কাজ করতে হবে। কোভিড-১৯ সেই বোধ জাগ্রত করুক। লকডাউন কত দিন চলবে, তা ভেবে দেখছে সরকার। কখন ও কীভাবে এটি তোলা হবে এবং তার সঙ্গে সম্পর্কিত ঝুঁকিগুলো কী—অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক—সেগুলো ভেবে দেখতে হবে।

একটি প্রসঙ্গ বারবার সামনে আসছে, জীবন আগে, না জীবিকা। বলা দরকার, যেসব দেশ জীবন বাঁচানোয় অগ্রাধিকার দিয়েছে এবং পূর্ণাঙ্গ ব্যবস্থা নিয়েছে, তারা কিন্তু পরবর্তী সময়ে জীবিকার প্রসঙ্গটি আমলে নিতে পেরেছে।

রওনক জাহান : রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান সিপিডির বিশেষ ফেলো