জ্বালানি তেল: কৌশলী হলে বিপিসির বাঁচবে কয়েক হাজার কোটি টাকা

বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি)।
বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি)।

চীন এক বছর, ভারত ছয় মাসের জ্বালানি তেল মজুত রাখতে পারে। আর বাংলাদেশ পারে মাত্র ৪২ দিনের। ফলে পর্যাপ্ত মজুত না রাখতে পারার কারণে বিশ্বব্যাপী তেলের দাম কমে যাওয়ায় সুযোগ হারাচ্ছে রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি)। প্রতিষ্ঠানটি বিকল্প উপায়ে মজুত বাড়ানোর পরিকল্পনা করলেও এখন পর্যন্ত তা বাস্তবায়ন করতে পারেনি।

এই বিকল্প হলো বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের ট্যাংকার ভাড়া নেওয়া। এর বাইরেও সরকারি-বেসরকারি তেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর ট্যাংকার। এভাবে অন্তত ২৫ লাখ টন তেল মজুত রাখা সম্ভব। এটি করা গেলে বিপিসির ৪২ দিনের মজুতের সঙ্গে আরও অন্তত সাত মাসের মজুত যুক্ত হবে। অর্থাৎ আট মাসের বেশি সময়ের তেল কম দামে কিনে রাখতে পারবে বিপিসি।

গত অর্থবছরে ৪১ হাজার কোটি টাকার তেল কিনেছে বিপিসি। বর্তমান দাম সে তুলনায় অর্ধেকেরও কম। সে হিসাবে আট মাসে ১৩ হাজার কোটি টাকার বেশি সাশ্রয়ের সুযোগ তৈরি হয়েছে। তবে এই সাশ্রয় নির্ভর করবে বিপিসি কী দামে তেল কিনবে এবং ভবিষ্যতে আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম কত থাকবে, তার ওপর। তবে যা–ই হোক, কম দামে কিনে জ্বালানি তেলের মজুত বাড়াতে পারলে বিপিসি লাভবান হবে। কারণ, দেশের বাজারে তেলের দাম কমানো হচ্ছে না।

এ বিষয়ে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ প্রথম আলোকে বলেছেন, তেলের দাম কমে যাওয়ার সুযোগ তাঁরা নিতে চান। সে কারণে সম্ভাব্য সব পথ খুঁজছেন। তেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর স্টোরেজ ট্যাংক খালি করার জন্য ওই বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো চালু করতে বলা হয়েছে। কিন্তু এখন বিদ্যুতের চাহিদাও পড়ে গেছে। বেসরকারি ট্যাংকার, তেলভিত্তিক কেন্দ্রের ট্যাংকার, ছোট লাইটার জাহাজের ট্যাংকারে তেল রাখার চিন্তা করা হচ্ছে বলে তিনি জানান।

গতকাল মঙ্গলবার সিঙ্গাপুরে অপরিশোধিত প্রতি ব্যারেল তেল ২৬ দশমিক ৩৮ ডলারে বিক্রি হয়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এ বছরে ৩৪ ডলারের ওপরে উঠবে না তেলের দাম। আগামী বছর এটির দাম ৪১ ডলার হতে পারে। দেশে তেল রাখার বিষয়ে বেসরকারি ট্যাংকার মালিকদের সঙ্গে চুক্তি করা এবং বিদ্যুৎকেন্দ্রের ট্যাংকারগুলোতে নিরাপত্তা ও তেলের মান রক্ষা করে আদৌ মজুত রাখা সম্ভব কি না, তা খতিয়ে দেখতে সময় লাগবে।

বিপিসির চেয়ারম্যান শামছুর রহমান অবশ্য বলেছেন, তাঁরা ইতিমধ্যে ইউনাইটেড গ্রুপের ট্যাংকার ভাড়া করার বিষয়টি চূড়ান্ত করেছেন। অন্য সম্ভাব্য উপায়গুলো বিবেচনা করছেন। তাঁদের লক্ষ্য যত বেশি সম্ভব তেল মজুত করা। যদি দেশের বাজারে তেলের দাম না কমানো হয়, তাহলে সরকার অনেক মুনাফা করবে এ খাত থেকে।

আন্তর্জাতিক বাজার থেকে ভাসমান তেলের ট্যাংকার ভাড়া নেওয়া যায়। সংবাদ সংস্থা রয়টার্স জানিয়েছে, ভাসমান জাহাজে এক ব্যারেল তেল ছয় মাস মজুত রাখতে ব্যয় হবে ৫ দশমিক ৪০ ডলারের মতো। সে ক্ষেত্রে বাংলাদেশে তেলের ট্যাংকারে তেল ভাড়া নেওয়াটা অধিক লাভজনক। কারণ ইউনাইটেড গ্রুপের ট্যাংকার কর্তৃপক্ষ ইতিমধ্যে প্রতি টন তেলের জন্য মাসে আড়াই শ টাকা প্রস্তাব করেছে বিপিসির কাছে। আন্তর্জাতিক বাজারে বর্তমান দাম অনুযায়ী প্রতি টন (এক টন সমান সাত ব্যারেলের কিছু বেশি) তেল মজুত রাখতে ছয় মাসে খরচ হবে ৩ হাজার ২০০ টাকার কিছু বেশি। আর দেশি ট্যাংকারে রাখতে পারলে ভাড়া পড়বে দেড় হাজার টাকা।

২০১৯ সালে বিপিসি পরিশোধিত-অপরিশোধিত মিলিয়ে ৫৩ লাখ ৯৪ হাজার ৬২৮ মেট্রিক টন জ্বালানি তেল আমদানি করে। এ তেল কিনতে বিপিসির খরচ হয়েছে ৪১ হাজার কোটি টাকা। এবার করোনার কারণে তেলের ব্যবহার কিছুটা হলেও কমে আসবে। আমদানি করা জ্বালানি তেলের সিংহভাগই ডিজেল।

বেসরকারি দুই ট্যাংকারে ধারণক্ষমতা
দেশে দুটি বড় ট্যাংকার রয়েছে, যার প্রতিটির ধারণক্ষমতা এক লাখ টন। এটির একটি ইউনাইটেড গ্রুপের, অন্যটি ওমেরার। চট্টগ্রামের আনোয়ারাতে ইউনাইটেড গ্রুপের ১০ ট্যাংকারের মজুত করা যাবে এক লাখ টন, প্রতিটিতে ১০ হাজার টন ধারণক্ষমতা রয়েছে। ওমেরার ট্যাংকারটি চট্টগ্রামের পতেঙ্গায়। এ ছাড়া ইউনাইটেড গ্রুপের আরও দুটি ট্যাংকার রয়েছে মোংলায়, সেখানে ১১ হাজার টন রাখা যাবে। ওমেরা ও ইউনাইটেডের ট্যাংকারটি আন্তর্জাতিক নিয়ম মেনেই তৈরি করা। তবে দেশের একমাত্র এপিই (আমেরিকান পেট্রোলিয়াম ইনস্টিটিউট) ৬৫০ মানের ট্যাংকার হলো ইউনাইটেডের, যেখানে ডিজেল ও ফারনেস তেল মজুত রাখা যায়। ইউনাইটেড গ্রুপ চট্টগ্রামের ১০টি ট্যাংকারের মধ্যে ছয়টি ভাড়া দিতে চায় সরকারের কাছে। এ ছাড়া মোংলার দুটি ট্যাংকার, যার ধারণক্ষমতা ১১ হাজার টনের, সেটাও ভাড়া দিতে চায়। সব মিলিয়ে ইউনাইটের আনোয়ারা ও মোংলা মিলিয়ে ৭১ হাজার টন ডিজেল রাখা যাবে।

প্রতীকী ছবি। ছবি: রয়টার্স
প্রতীকী ছবি। ছবি: রয়টার্স

ইউনাইটেড ট্যাংক টার্মিনাল লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক নাসিরুদ্দিন আকতার রশীদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘করোনার এ সময় ব্যবসা করার উদ্দেশ্যে নয়, বরং আমরা চেয়েছি সরকার তেল মজুত করে ভবিষ্যতে তা থেকে ভালো মুনাফা করতে পারে, সে জন্যই আমরা বাজারে যে মূল্য ভাড়া হয়, তার অনেক কম দামে সরকারকে প্রস্তাব দিয়েছি। বিপিসির একটি প্রতিনিধিদল আমাদের ট্যাংকার ঘুরে দেখে গেছে। এ বিষয়ে আলোচনা শেষের পথে। সরকার চাইলে আমরা মোংলার দুটি ট্যাংকও ছেড়ে দিতে পারি। মোংলা ও চট্টগ্রামের ট্যাংকার যেভাবে আন্তর্জাতিক নিয়ম অনুসরণ করে নির্মাণ করা হয়েছে, সেখানে ডিজেল মজুত রাখা যাবে।’

বিদ্যুৎকেন্দ্রের ট্যাংক
বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) দুই ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা প্রথম আলোকে জানিয়েছেন, দেশে সরকারি ও বেসরকারি (তেলভিত্তিক রেন্টাল, কুইক রেন্টাল ও আইপিপি) বিদ্যুৎকেন্দ্র রয়েছে ৬৭টি। এর সম্মিলিত বিদ্যুতের উৎপাদনের ক্ষমতা ৭ হাজার মেগাওয়াটের কিছু বেশি। এর মধ্যে সরকারি মালিকানায় প্রায় ১ হাজার মেগাওয়াট তেলভিত্তিক কেন্দ্র রয়েছে, বাকি ৬ হাজার মেগাওয়াট বেসরকারি মালিকানায়। একটি তেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে ন্যূনতম তিন মাসের তেলের মজুত রাখা বাধ্যতামূলক, এভাবেই তৈরি করা হয় বিদ্যুৎকেন্দ্রের তেলের ট্যাংকার। দেশের ৭ হাজার মেগাওয়াট তেলভিত্তিক কেন্দ্রের ট্যাংকারের ধারণাক্ষমতা রয়েছে ৩০ লাখ টনের বেশি। তেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোতে যাতে সহজেই তেল নেওয়া যায়, সে জন্য কেন্দ্রগুলো নদীর তীরে নির্মাণ করা হয়েছে, কিছু কেন্দ্র ট্রেনের ওয়াগানের মাধ্যমে তেল পরিবহনের সুযোগ রয়েছে, এমন স্থানে স্থাপন করা হয়েছে। ফলে বিদ্যুৎকেন্দ্রের ট্যাংকারে তেল মজুত করতে বাড়তি ঝামেলা বহন করতে হবে না বলে সংশ্লিষ্টদের মত।

পিডিবির ওয়েবসাইটে দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, দেশে এখন ১৯ হাজার ৬৩১ মেগাওয়াট ক্ষমতার (স্থাপিত) বিদ্যুৎকেন্দ্র রয়েছে (এর মধ্যে ১১০০ মেগাওয়াট ভারত থেকে আসে, বাকি সাড়ে ১৮ হাজার মেগাওয়াট ক্ষমতার কেন্দ্র দেশে রয়েছে)। এর মধ্যে গড়ে ছয় হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন হচ্ছে। বেশির ভাগ তেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র সারা বছর বন্ধ রাখা হয় খরচ বেশি হওয়ার কারণে। বিদেশ থেকে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানি শুরুর পর থেকে গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র বেশি সচল রাখা হচ্ছে। গত দুই বছর তেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের মোট ক্ষমতার গড়ে ২০ শতাংশও ব্যবহার হয় না। এ হিসাবে তেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের ট্যাংকার ৮০ ভাগই ফাঁকা থাকে। সে হিসাবে ২৩ লাখ টন তেল রাখা সম্ভব বিদ্যুৎকেন্দ্রের এসব ট্যাংকারে। এ তেল দিয়ে ডিজেল চাহিদার সারা বছরের ছয় মাস চালানো সম্ভব।

আইপিপি ও রেন্টাল-কুইক রেন্টাল কেন্দ্রের মালিকেরা বিদ্যুৎ উৎপাদন ছাড়াও বেশ কয়েকটি খাতে ভাড়া পেয়ে থাকেন। এগুলোর সম্মিলিত নাম ক্যাপাসিটি চার্জ বা কেন্দ্র ভাড়া, এ ছাড়া কেন্দ্রের রক্ষণাবেক্ষণের জন্যও তাঁরা প্রতি মাসে বিলের সঙ্গে ইউনিট–প্রতি একটা অর্থ পান। এ ছাড়া জ্বালানি বা তেলের দামও দেওয়া হয়।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিদ্যুৎ না নিলেও চুক্তির কারণে রেন্টাল-কুইক রেন্টাল ও আইপিপি কেন্দ্রের কেন্দ্র ভাড়া, রক্ষণাবেক্ষণের অর্থ প্রতি মাসে বিলের সঙ্গে দেওয়া হয়। ফলে কেন্দ্রটি সরকার ব্যবহার না করলেও ওই কেন্দ্রের সবকিছুই সরকারের ভাড়া নেওয়া। সে কারণে আলাদা করে তেলের ট্যাংকার ভাড়া দেওয়া দরকার নেই। কারণ ওই কেন্দ্রের প্রতি মাসের ভাড়া সরকার দিয়ে থাকে।

কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্বালানি উপদেষ্টা অধ্যাপক এম শামসুল আলম বলেন, যতখানি পারা যায় তেল কিনে রাখতে হবে। এ জন্য দেশীয় কোম্পানিগুলোর ট্যাংকার ভাড়া নিতে হবে। আন্তর্জাতিক বাজারদরেই দেশে ট্যাংকার ভাড়া পাওয়া সম্ভব। এ ছাড়া বিদ্যুৎকেন্দ্রের ট্যাংকারগুলোতে ৩০ লাখ টন তেলের মজুত রাখা সম্ভব। বেসরকারি কেন্দ্রগুলোকে সরকার ভাড়া নিয়েছে। ফলে বেসরকারি কেন্দ্রের সব মালামাল ও ট্যাংকার এই ভাড়ার মধ্যে পড়ে। তাদের আলাদা করে তেলের জন্য ভাড়ার টাকা দিতে হবে না। কারণ প্রতি মাসে ক্যাপাসিটি চার্জ নামে যে অর্থ দেওয়া হয়, সেখানে ট্যাংকারের ভাড়াও রয়েছে। এভাবে যদি ২৫ থেকে ৩০ লাখ টন তেল মজুত রাখা যায়, তাহলে কয়েক হাজার কোটি টাকা মুনাফা করা সম্ভব।