ভারতে বৈদেশিক আয়ের নতুন সম্ভাবনা কাঁঠাল

কেরালার ত্রিশূরে কাঁঠালের স্তূপ। ছবি: এএফপি
কেরালার ত্রিশূরে কাঁঠালের স্তূপ। ছবি: এএফপি

ভারতের দক্ষিণ উপকূলীয় অঞ্চলে বেশ জন্মে কাঁঠাল। ম ম সৌরভ ছোটানো পাকা কাঁঠাল সুমিষ্ট রসালো ফল হিসেবে বেশ সমাদৃত হলেও কাঁচা কাঠালের কদর সেভাবে নেই। তবে আমিষের গুণে ভরপুর কাঁচা কাঁঠালের বিষয়ে এখন বেশ আগ্রহ তৈরি হয়েছে পশ্চিমা নিরামিষভোজী মানুষের। মাংসের বিকল্প হিসেবে একেবারে জুতসই এই কাঁঠাল। এমনকি কদর বুঝে চাকরি ছেড়ে কাঁঠালের ব্যবসা শুরু করেছেন মাইক্রোসফটের এক পরিচালক। এএফপির প্রতিবেদনে এ তথ্য জানানো হয়।

কয়েক শতাব্দী ধরে দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন দেশে অন্যতম প্রধান ফলের তালিকায় রয়েছে কাঠাঁল।তবে এর ফলন এতটাই বেশি যে চাহিদা মেটার পরও প্রতিবছর টনকে টন কাঁঠাল পচে যায়।

এবার এই ফলটিকে বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহার করতে চাইছে ভারত। বিশ্বে কাঁঠালের সবচেয়ে বেশি উৎপাদন ভারতে। কাঁচা কাঁঠালকে মাংসের বিকল্প খাবার বা 'সুপারফুড' হিসেবে বাণিজ্যিকিকরণ করতে চাইছে তারা। কাঁচা কাঁঠাল রান্না করা শিখছেন সান ফ্রান্সিসকো, লন্ডনের মতো শহরের প্রসিদ্ধ রন্ধনশিল্পীরা।

কেরালার ভারগেস থারাক্কান আগে রাবার চাষ করতেন। বেশ কয়েক বছর হলো কাঁঠাল উৎপাদন করছেন। এর পর তাঁকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। এএফপিকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, 'বাইরের দেশের মানুষের কাঁঠাল নিয়ে অনেক প্রশ্ন রয়েছে। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে এই ফলের প্রতি মানুষের আগ্রহ বহু গুণ বেড়েছে।' তিনি বলেন, 'আমি যখন রাবার গাছ সরিয়ে কাঁঠালের চাষ শুরু করলাম, মানুষ আমাকে পাগল ঠাওরেছিল। এখন তারাই এসে আমার সাফল্যের চাবিকাঠি সম্পর্কে জানতে চায়।'

কেরালায় গড়ে একটি কাঁঠালের ওজন হয় পাঁচ কেজি। ফল হিসেবে খাওয়া ছাড়া জুস, কেক, চিপস ও আইসক্রিম তৈরিতেও ব্যবহৃত হয় কাঁঠাল। কাঁচা কাঠাল খাওয়া যায় রান্না করে বা ভেজে। মজার বিষয় হচ্ছে, পশ্চিমে কাঁচা কাঁঠাল পর্কের বিকল্প হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। এমনকি পিজার উপরিভাগের স্তরের জন্যও ব্যবহার করা হচ্ছে কাঁঠাল।

যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতে একটি চেইন রেস্তোরাঁ চালান আনু ভামরি। তিনি বলেন, 'মানুষ কাঁঠাল খুব পছন্দ করে। কাঁঠালের বিভিন্ন পদ নানা জায়গায় খুব জনপ্রিয়তা পাচ্ছে। কাঁচা কাঁঠালের কাটলেটের চাহিদা অনেক। আমার নিজেরও খুব পছন্দ।'

জেসম জোসেফ ছিলেন মাইক্রোসফটের একজন পরিচালক। পশ্চিমাদের মধ্যে কাঁঠাল প্রীতি দেখে তিনি চাকরি ছেড়ে দিয়েছেন। মাংসের বিকল্প হিসেবে কাঁঠাল থেকে নতুন ব্যবসার পথ খুঁজে নিয়েছেন তিনি। জোসেফ মনে করেন, কোভিড–১৯ মহামারির এই দুঃসময়ে মানুষের আগ্রহ দুই বিষয়ে খুব বেড়েছে। তিনি বলেন, করোনাভাইরাস মানুষের মুরগি নিয়ে কিছুটা ভয় তৈরি করেছে। এতে মানুষের আগ্রহ বেড়েছে কাঁচা কাঠালের প্রতি। কেরালায় দেখা গেছে, লকডাউনের কারণে শাকসবজির ঘাটতি তৈরি হওয়ায় পরিপক্ক সবুজ কাঁঠাল এবং কাঁঁঠালের বিচির চাহিদা অনেক বেড়েছে।এর মানে উপকূলীয় রাজ্য কেরালায় আরও বেশি কাঁঠালের উৎপাদন হবে।

মহামারির আগেই বিশ্বে শাকসবজির প্রতি মানুষের চাহিদা অনেক বেড়েছে। এক নিরামিষভোজী মাছ–মাংস বাদেও প্রাণিজাত অন্য খাবার খান না। যেমন দুধ ও মধু। ২০১৯ সালে জাতিসংঘের এক প্রতিবেদনে বেশি বেশি উদ্ভিদ জাতীয় খাবার গ্রহণের পরামর্শ দেওয়া হয়। যা জলবায়ু পরিবর্তনকে প্রশমিত করতে সহায়তা করতে পারে। তবে মাংস–মাছের বিকল্প আমিষ মানুষের সামনে খুব বেশি নেই। যদিও এশিয়ায় দীর্ঘকাল ধরেই খাবার হিসেবে সয়াভিত্তিক টফু, গমের সিটেন ও কাঁঠালের প্রচলন রয়েছে।

জোসেফ বলেন, 'এটার স্বাদ অনেকটা মাংসের মতো। খেতে মাংসের মতোই মনে হয়।' জোসেফের খামারে কাঁঠাল দিয়ে আটা তৈরি করা হয়। ওই আটা—এমনকি বার্গার তৈরিতেও ব্যবহার করা হয়। এসব খাবারের স্বাস্থ্য সুবিধা নির্ণয়ে সিডনির একদল গবেষকের সঙ্গেও কাজ করছেন জোসেফ।

জোসেফ বলেন, আমরা যখন এর পুষ্টিগুণ বিশ্লেষণ করলাম, দেখতে পেলাম যে কেউ যদি রক্তে শর্করার পরিমাণ নিয়ন্ত্রণে রাখতে চান, তাহলে তাঁর জন্য খাবার হিসেবে ভাত বা রুটির চেয়ে কাঁঠাল ভালো।

বিশ্বে সবচেয়ে বেশি ডায়াবেটিকে আক্রান্ত মানুষ ভারতে। চিকিৎসা সাময়িকী ল্যানসেট–এর এক গবেষণায় বলা হয়েছে, ২০৩০ সাল নাগাদ ভারতের ১০ কোটি মানুষ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হবে। বৈশ্বিক উষ্ণায়নের ফলে কৃষিক্ষেত্রের যে ক্ষতি হচ্ছে, সে ক্ষেত্রে কাঁঠাল ভালো বিকল্প হতে পারে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। কারণ কাঁঠাল খরা-প্রতিরোধী এবং এটি চাষের জন্য খুব কম রক্ষণাবেক্ষণের প্রয়োজন হয়।

গান্ধীগ্রাম রুরাল ইন্সটিটিউটের অর্থনীতিবিদ এস রাজেন্দ্র বলেন, কেবল তামিলনাড়ু আর কেরালায় মৌসুমে কাঁঠালের চাহিদা প্রতিদিন ১০০ মেট্রিক টন। এখানকার কাঁঠাল চাষিদের বছরে প্রায় ১ কোটি ৯৮ লাখ ডলার আয় হয়। বর্তমানে বাংলাদেশ ও থাইল্যান্ডেও কাঁঠালের ভালো উৎপাদন হয়।