'মার্শাল পরিকল্পনা' দরকার

অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় ও এস্থার দুফলো।
অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় ও এস্থার দুফলো।

কোভিড-১৯-এর প্রভাবে সারা পৃথিবী একধরনের কোমায় চলে গেছে। তাই এটা ভাবাই স্বাভাবিক যে বিদ্যমান অস্থিতিশীলতা চিরস্থায়ী রূপ নেবে। তবে ইতিহাস বলে, প্রতিষেধক টিকা বা চিকিৎসাপদ্ধতি উদ্ভাবিত হলে পৃথিবীর পুনরায় আগের জায়গায় ফেরার সম্ভাবনা আছে। সে জন্য জনস্বাস্থ্য ও অর্থনৈতিক নীতিতে প্রজ্ঞার পরিচয় দিতে হবে। কারণ, বাজার অর্থনীতি দ্রুতই স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে যেতে চায়।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর জার্মানি, জাপান ও ফ্রান্স যে গতিতে অর্থনীতি পুনরুদ্ধার করেছিল, তাতেই প্রমাণ মেলে যে স্বাভাবিক পরিস্থিতি ফিরে এলে অর্থনীতি দ্রুত আগের অবস্থায় ফিরে যায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপানের ৬৬টি শহর বোমা মেরে একদম ধূলিসাৎ করা হয়েছিল। এতে প্রায় সাড়ে তিন লাখ মানুষের মৃত্যু হয়। তা সত্ত্বেও ১৫ বছরের মধ্যে শহরগুলো একদম আগের অবস্থায় ফিরে যায়। জার্মানিতেও একই ধারা দেখা গেছে। অর্থনীতির এই ফিরে আসা ভিয়েতনামেও দেখা গেছে। ইতিহাসের অন্যতম বীভৎস এক যুদ্ধের মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে দেশটিকে। দেশটিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যে পরিমাণ বোমা ফেলেছে, তার তুলনাও ইতিহাসে মেলা ভার। বিপুল প্রাণহানি ও অর্থনৈতিক ক্ষতির পরও ২০০০ সালে দেখা যায়, দেশটির যেসব অংশে বোমা ফেলা হয়েছিল এবং যেসব জায়গায় ফেলা হয়নি, সেই দুই জায়গার মধ্যে দারিদ্র্য, অবকাঠামো, মানবিক ও ভৌত পুঁজির দিক থেকে বিশেষ পার্থক্য নেই।

অর্থনীতিবিদেরা মনে করেন, দ্রুতগতিতে আঞ্চলিক সংযুক্তি ঘটাই হচ্ছে পুঁজিবাদের যৌক্তিকতা। ব্যবসায়ীরা বিনিয়োগ করবেন, মানুষও আগের জায়গায় দ্রুত ফিরে যেতে চাইবে। মহামারি অনেকটা যুদ্ধের মতো। অর্থাৎ যুদ্ধের সময় অর্থনীতি যেমন বাহ্যিক কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়, মহামারিতেও তা-ই হয়। এবারও আমরা সে রকম কিছু প্রত্যাশা করতে পারি (তবে নিকট ভবিষ্যতে টিকা বা চিকিৎসাব্যবস্থা না এলে পরিস্থিতি রীতিমতো আরও জটিল হবে)।

এটাও মনে রাখা দরকার, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর মার্শাল প্ল্যান ইউরোপকে অর্থায়ন করেছে। যুক্তরাষ্ট্রের এই অর্থায়ন তাদের জন্য খুব জরুরি ছিল। আরেকটি বিষয় হলো, যুদ্ধের পর এসব দেশে শক্তিশালী সরকার গঠিত হয়। রাজনৈতিক ব্যবস্থা এক রকম না হলেও তাদের জনসমর্থন ছিল। সর্বোপরি, এসব দেশে অসমতা অত তীব্র ছিল না। ফলে সেখানে যৌথ উদ্যোগ ও তৎপরতার ভিত্তি রচিত হয়। আবার কঙ্গো, সোমালিয়া ও আফগানিস্তানের মতো দেশে একই রকম যুদ্ধের সময় অর্থনীতি ও প্রতিষ্ঠান ধসে পড়ার কারণে যুদ্ধের পর অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি। বরং যুদ্ধের পর তারা আরও বিশৃঙ্খলায় পড়েছে। একদিকে জনস্বাস্থ্য-সংকটের কারণে বহু মানুষের মৃত্যু, অন্যদিকে লকডাউনের কারণে সৃষ্ট অর্থনৈতিক সংকট—এ দুটি ব্যাপার একত্রে ঘটলে রাষ্ট্রের বৈধতা খাটো হবে এবং আগের সমস্যাগুলো আরও ঘনীভূত হবে। এসব কারণে কমবেশি স্থিতিশীল পরিবেশে ফেরত যাওয়া কঠিন।

যেসব দেশে সামাজিক সাম্যাবস্থা আগে থেকেই ভঙ্গুর, সেসব দেশে ঝুঁকি স্বাভাবিকভাবেই বেশি, বিশেষ করে অধিকাংশ উন্নয়নশীল দেশে। তবে ইতালি, ফ্রান্স, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রভৃতি দেশে যেখানে অসমতা ক্ষয়িষ্ণু জায়গায় চলে গেছে এবং সেই পরিস্থিতিজনিত অসহিষ্ণুতা রাজনীতির বড় অংশকে প্রভাবিত করে, সেই সব দেশ সামাজিক অস্থিরতার দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে আছে। ভবিষ্যৎ সুরক্ষিত করতে এই সব অরক্ষিত রাষ্ট্রের উচিত নিজেদের বৈধতা ধরে রাখা বা পুনর্গঠনে জোর দেওয়া। কাজটা জটিল, সন্দেহ নেই। ন্যূনতম কিছু করতে হলেও কোভিড-১৯-এর পরিপ্রেক্ষিতে তাদের দক্ষ ব্যবস্থাপনায় জোর দিতে হবে। এই পরিস্থিতিতে দেশগুলোর কী করা উচিত, সে ব্যাপারে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে অর্থনীতিবিদদের মোটাদাগে ঐকমত্য আছে। প্রথমত, মহামারির চূড়ান্ত পর্যায়ে জনস্বাস্থ্যব্যবস্থার ধস ঠেকাতে হবে। দ্বিতীয়ত, লকডাউন সহনীয় করতে অরক্ষিত জনগোষ্ঠীকে সর্বজনীন নগদ সহায়তা দিতে হবে। তৃতীয়ত, সুনির্দিষ্টভাবে বিপুলসংখ্যক মানুষকে পরীক্ষা করাতে হবে। এর ভিত্তিতে ঠিক করতে হবে কখন সবকিছু খুলে দেওয়া হবে।

সন্দেহ নেই, কোভিড-১৯-এ ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হবে। ধনী দেশগুলোর জন্য এটা সমস্যা নয়, তবে এটা করতে ব্যর্থ হওয়ার অর্থ হলো, নিজের পায়ে কুড়াল মারা। ঋণমান না কমিয়েও তারা অনেক কম সুদে ঋণ নিতে পারে। আশা করি, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপ ২০০৮ সালের সংকট থেকে শিক্ষা নেবে এবং অতি দ্রুত রাজস্ব শৃঙ্খলার জমানায় ফিরতে চাইবে না। দরিদ্র দেশগুলোর রাজস্ব খাত বিশৃঙ্খল হলে ঋণমান নিয়ে দুশ্চিন্তা বাড়ে। এমনকি ভারতের মতো মধ্যম আয়ের দেশও ভয়ে থাকে, পাছে সামষ্টিক অর্থনীতির রক্ষণশীলতা থেকে সরে গেলে কী হয়। আফ্রিকার দেশগুলো আর্থিকভাবে সহায়তা না পেলে বা তাদের ঋণ পরিশোধ না হলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে পারে। এ ছাড়া ওষুধ ও সম্ভাব্য টিকার দাম পরিশোধে তাদের এখন অনেক টাকা দরকার। তাহলে দেখা যাচ্ছে, এসব দেশ নিজে নিজে সবকিছু করতে পারবে না। তাই এখন দরিদ্র দেশগুলোর কোভিড-১৯ মার্শাল পরিকল্পনা দরকার। তাহলেই কেবল করোনার পর আমরা মহামন্দা ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তরকালের সেই গৌরবময় ৩০ বছরের দেখা পাব।

দ্য ইকোনমিস্ট থেকে নেওয়া, অনুবাদ: প্রতীক বর্ধন