করোনা নতুন কী পথ দেখাচ্ছে বিশ্বকে

বিশ্বের ৭৭০ কোটি মানুষের মধ্যে এমন মানুষ খুব কমই খুঁজে পাওয়া যাবে, যার ওপর কোভিড–১৯ রোগের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ প্রভাব পড়েনি। এ এক উত্তপ্ত হাওয়া যেন ছুঁয়ে যাচ্ছে বিশ্বের সব প্রান্ত। মৃত্যু, অসুস্থতা তো রয়েছেই। একই সঙ্গে কাজ হারিয়েছেন অনেকে, হারানোর আশঙ্কায় আছেন। হঠাৎ করে দরিদ্র হয়ে গেছেন বহু মানুষ। বাচ্চাদের স্কুল বন্ধ, বাড়িতে থেকে অদ্ভুত এক সময় পার করছে তারা। মহামারি ঠেকাতে দেশে দেশে লকডাউন জারি করা হয়। সব বন্ধ তবে কতদিন এভাবে চলবে?

করোনায় বৈশ্বিক ক্ষয়ক্ষতির যে আশঙ্কা , তা কয়েক ট্রিলিয়ন ডলার ছাড়াচ্ছে। তাই অনেক দেশই ধীরে ধীরে অর্থনৈতিক কার্যক্রম শুরু করেছে। বিশ্বজুড়ে সরকার ও সংস্থাগুলো পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়ার দিকে তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করছে। এবার তাদের একটু আলাদাভাবেই অর্থনৈতিক পুনগঠনের সুযোগ রয়েছে। এক. এই বিশ্বকে সবার জন্যই একটা অধিক বাসযোগ্য করে তোলা, দুই. জলবায়ু পরিবর্তনের মতো সংকটকে মাথায় নিয়ে কাজ করা। বলা যায়, কোভিড–১৯ এর ঝুঁকির কারণে অর্থনৈতিক পরিণতি এসেছে, এই উপলব্ধি থেকে এখন আরও টেকসই, স্থিতিশীল একটি বিশ্বের তৈরির একটি বিরল সুযোগের সৃষ্টি হয়েছে। ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম এই পুনগর্ঠন নিয়ে কাজ করছে। এ সম্পর্কে সম্প্রতি তারা বিশেষজ্ঞদের মতামত নিয়েছে। বিষেষজ্ঞরা মনে করছেন, কোভিড–১৯ থেকে অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের শিক্ষা ও সঠিক সুযোগ নেওয়া উচিত আমাদের। নিচে সেই মতামত তুলে ধরা হলো।

জেনিফার মরগ্যান। ছবি: রযটার্স
জেনিফার মরগ্যান। ছবি: রযটার্স

১. পুনর্গঠনে সবুজ অর্থনীতি– জেনিফার মরগ্যান
গ্রিনপিস ইন্টারন্যাশনালের জেনিফার মরগ্যান বলেন, কোভিড -১৯ আমাদের পেছনে ফিরে থাকানোর এবং আমরা কেমন পৃথিবীতে বাস করতে চাই, তা পুনর্বিবেচনা করার একটি সুযোগ দিয়েছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আমরা একটা নতুন বৈশ্বিক অবস্থা তৈরি করেছি। আমরা তখন যেমন ছিলাম, তা থেকে এখন একদম আলাদা। নিজেকেই প্রশ্ন করতে হবে, আমরা আলাদা কী করতে পারি। ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের এতে একটা বড় দায়িত্ব রয়েছে, পুনগর্ঠন নামের বোতামে চাপ দিতে হবে এবং কীভাবে মানুষ ও এই বিশ্বের জন্য কিছু করা যায়, এর সন্ধান করতে হবে।

মরগান সবুজ অর্থনীতি পুনর্নির্মাণের যৌথ উদ্যোগের সম্ভাবনা সম্পর্কে ইতিবাচক মত পোষণ করেন। যেমন–সরকারি সংস্থা ও যুব আন্দোলনের সহযোগিতায় গড়ে ওঠা ইউরোপীয় গ্রিন ডিল। তিনি বলেন, 'সংস্থাগুলো অতীত থেকে শিখেছে। এখন মুনাফা ও মানুষের জন্য আরও কার্বনবিহীন অর্থনীতি তৈরি করার সুযোগ তাদের নেওয়া উচিত।' জনগণের দীর্ঘমেয়াদী কাজের জন্য সরকারি তহবিল থেকে বিনিয়োগ করা প্রয়োজন। আমাদের কাছে কয়লা খনিতে বা এ ধরনের জায়গায় যাঁরা কাজ করছেন, তাঁদের অন্য কাজে স্থানান্তর করার সুযোগ রয়েছে। এসব নিয়ে আমাদের সবার একসঙ্গে ভাবতে হবে।'

মরগ্যান মনে করেন, মহামারির প্রতিক্রিয়ায় বিশ্ব যা শিখল, তা হলো— যে ঐক্য ও গতি এ ক্ষেত্রে দেখানো হয়েছে, তা জলবায়ু পরিবর্তনের প্রতিক্রিয়ায়ও দেখানো যায়।

গীতা গোপীনাথ। ছবি: রয়টাসৃ
গীতা গোপীনাথ। ছবি: রয়টাসৃ

২. এটি মোকাবেলায় বিশ্বব্যাপী সহযোগিতা– গীতা গোপীনাথ
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) প্রধান অর্থনীতিবিদ গীতা গোপীনাথ বলেছেন, কোভিড -১৯ সংকটের প্রকৃতি এবং কর্মসংস্থানের ক্ষতির যে গতি, তা ২০০৮ সালের আর্থিক সঙ্কটের তুলনায় এটিকে স্পষ্টতই আলাদা করে তুলেছে। সুতরাং সমাধানগুলোও আলাদা করার দরকার। স্বল্পমেয়াদে, স্বাস্থ্যের উপরে সরকারী ব্যয় বৃদ্দি অগ্রাধিকার পাবে কেবল স্বাস্থ্যের সমস্যা হ্রাস করার জন্য নয়, বরং আমরা যখন এই স্বাস্থ্য সঙ্কট থেকে বেরিয়ে আসব তখন একটি সুস্থ পুনরুদ্ধার নিশ্চিত করার জন্য।

গোপীনাথ বলেন,'বেশি ব্যয়ের অর্থ হয় আরও ঋণ হবে, সুতরাং যে দেশগুলি ইতিমধ্যে ঋণ সঙ্কটের মুখোমুখি হয়েছে, তাদের জন্য অর্থায়ন ছাড় এবং ঋণসেবা ত্রাণ আইএমএফ অনুমোদন করেছে। আবার অন্য দেশের ক্ষেত্রে ঋণ সঙ্কট এড়াতে তারল্য সুবিধার প্রয়োজন হবে।'

গীতা গোপীনাথ বলেন, 'উন্নত অর্থনীতির ক্ষেত্রে একবার যখন আমরা প্রবৃদ্ধির পুনরুদ্ধার দেখতে শুরু করব, তখন তা ঋণের মাত্রা কমাতে সহায়তা করবে। অন্যান্য দেশগুলো, বিশেষ করে দরিদ্র দেশগুলোর জন্য, আমি মনে করি যে ঋণ পুনর্গঠন, ঋণ ত্রাণ, চালিয়ে যেতে হবে। দেশগুলোকে রাজস্ব আদায়ে উপায় খুঁজে বের করতে হবে। প্রগতিশীল কর একটি উপায় হতে পারে।' তিনি বলেন, 'আমি মনে করি, প্রয়োজনীয় পরিষেবা, যেমন স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা, সুশাসন এবং একটি সামাজিক সুরক্ষার ক্ষেত্রে কোনো বিষয়ে যে আপস করা যায় না, দেশগুলোর জন্য তা বিশ্বাস করাটা জরুরি। এটি এমন একটি ভাইরাস, যা সীমানাকে সম্মান করে না, এটি সীমানা অতিক্রম করে। যতক্ষণ পর্যন্ত এটি বিশ্বের কোনো প্রান্তে পুরোপুরি শক্তিতে রয়েছে, ততক্ষণ এটি অন্য সবাইকে প্রভাবিত করে। কাজেই এটি মোকাবিলায় বিশ্বব্যাপী সহযোগিতা দরকার।'

শ্যারন বুরো। ছবি: রয়টার্স
শ্যারন বুরো। ছবি: রয়টার্স

৩. সর্বজনীন সামাজিক সুরক্ষা–শ্যারন বুরো

ইন্টারন্যাশনাল ট্রেড ইউনিয়ন কনফেডারেশনের (আইটিইউসি) মহাসচিব শ্যারন বুরো বলেন, 'আমরা কীভাবে এই সুযোগটি আরও উন্নত বিশ্বের নকশায় ব্যবহার করতে পারি, তা দেখতে পাচ্ছি। তবে এটি কার্যকরে আমাদের জাতীয় ও বহুপাক্ষিক প্রতিষ্ঠানগুলোর একসঙ্গে কাজ করা প্রয়োজন। সংহতি, ভাগ করে নেওয়া এবং আপনি কীভাবে মানুষদের দেশ বা বিশ্বব্যাপী রক্ষা করেন , এই মুহূর্তে এটিই সবচেয়ে জটিল বিষয়।'

আইটিইউসির এক জরিপে দেখা গেছে, এর ২১ শতাংশ সদস্য দেশ শ্রমিকদের অসুস্থকালীন ছুটি প্রদান করছে। তাই পুনর্গঠন প্রক্রিয়ার জন্য শ্রমিকদের সুরক্ষার কথা মাথায় রেখে সামাজিক সংলাপের প্রয়োজন বলে মনে করেন শ্যারন বুরো। তিনি বলেন, 'আমাদের অবশ্যই নিশ্চিত করতে হবে যে পুনর্গঠনে যেন সর্বজনীন সামাজিক সুরক্ষা অন্তর্ভুক্ত হয়। বিশ্ব এখনই এটি তহবিল করতে পারে এবং এখনো বিশ্বের ৭০ শতাংশ জনসংখ্যার কোনো সামাজিক সুরক্ষা নেই।'