প্রকাশিত সংবাদের প্রতিবাদ ও প্রথম আলোর বক্তব্য

প্রথম আলোর ১ম পৃষ্ঠায় গতকাল প্রকাশিত ‌‌‌‘বিদেশে এত সম্পদ সিকদার পরিবারের’ শীর্ষক সংবাদের প্রতিবাদ পাঠিয়েছে সিকদার গ্রুপ। তবে তারা প্রতিবাদপত্রে উল্লেখ করেছে ৯ জুন অনলাইনে প্রকাশিত ‘লাস ভেগাসসহ বড় বড় শহরে সিকদার পরিবারের বিপুল সম্পদ’ শীর্ষক শিরোনামের কথা।

গ্রুপটির ভাইস প্রেসিডেন্ট মাহফুজুর রহমান স্বাক্ষরিত প্রতিবাদপত্রে বলা হয়েছে, ‘প্রকাশিত সংবাদে বিভ্রান্তিমূলক ও কিছু অবিবেচিত মন্তব্য করা হয়েছে, যাতে জনমনে গ্রুপটির সুনাম নিয়ে প্রশ্ন ওঠার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে।’ প্রতিবাদে প্রথমেই বলা হয়েছে, ‘প্রথম আলো ও সংশ্লিষ্ট সকলের জানা থাকা প্রয়োজন যে সিকদার পরিবার যা এখন সিকদার গ্রুপ নামে প্রতিষ্ঠিত, ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু পরিবারের হত্যাকাণ্ডের পর এ দেশ থেকে ভারত, পরবর্তীতে ১৯৮০ সালে যুক্তরাষ্ট্রে ব্যবসার উদ্দেশে বাংলাদেশ ত্যাগ করে। ১৯৮১ সালে সিকদার হলক/ নামে করপোরেট কোম্পানি করে যুক্তরাষ্ট্রে দীর্ঘ সময় ধরে সিকদার গ্রুপ রিয়েল এস্টেটসহ বিভিন্ন ব্যবসা পরিচালনা করে আসছে। যে সকল ব্যবসা হতে প্রাপ্ত মুনাফা থেকে বিদেশে বিনিয়োগ ও সম্পদ সৃষ্টি হয়েছে। দেশ থেকে অর্থ পাচার করে বিদেশে কোনো সম্পদ গড়ে তোলা হয়নি। দেশের অভ্যন্তরে বিভিন্ন ব্যবসা থেকে আহরিত মুনাফা থেকে দেশে গ্রুপটির ব্যবসা থাকাই স্বাভাবিক। উল্লেখিত যে, প্রতিবেদনটিতে সিএনএন মানি সুইজারল্যান্ড–এর টেলিভিশন চ্যানেলের মালিকানার কথা বলা হলেও তা একেবারে সত্যি নয়। সিএনএন মানি সুইজারল্যান্ডের কোনো টিভি চ্যানেল নয় বরং এটি একটি ওয়েবভিত্তিক বিজনেস নিউজ পোর্টাল মাত্র, সেখানে সিকদার গ্রুপের অংশীদারিত্ব রয়েছে।’

প্রতিবাদে আরও বলা হয়েছে, ‘বিদেশে কথিত অর্থ পাচারে ন্যাশনাল ব্যাংককে ব্যবহারের যে সম্ভাবনার কথা বলা হয়েছে, তা কল্পনাপ্রসূত। কারণ, ন্যাশনাল ব্যাংক সৃষ্টির আগেই সিকদার গ্রুপ যুক্তরাষ্ট্রে প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী হিসেবে পরিচিত। বিদেশে পাচার তো দূরের কথা বরং গ্রুপটি সময় সময় দেশে বৈদেশিক মুদ্রা এনেছে। সংবাদে সেন্ট কিটস নেভিস-এ যে কই রিসোর্টের কথা বলা হয়েছে, তা মূলত বিদেশে অংশীদারত্বভিত্তিক একটি ব্যবসা, যা সে দেশের সরকারের বিশেষ আনুকূল্যে প্রতিষ্ঠিত।’

 প্রতিবাদপত্র অনুযায়ী, ‘গ্রুপের বিপুল সম্পদ ঘাঁটাঘাঁটি করতে গিয়ে এক্সিম ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালককে (এমডি) গুলি করে হুমকির ঘটনা টেনে আনা হয়েছে, যা অপ্রাসঙ্গিক এবং অনভিপ্রেত। বিষয়টি তদন্তাধীন এবং এ পর্যায়ে জাজমেন্টাল মন্তব্য দেওয়া আইনবহির্ভূত বটে। গ্রুপের এমডি রন হক সিকদার ও তাঁর ভাই দিপু হক সিকদারের রোগী সেজে দেশত্যাগের বিষয়টি একেবারেই অসত্য। রন হক সিকদার অসুস্থ থাকায় প্রয়োজনীয় সকল অনুমোদন গ্রহণের পর বৈধভাবে এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে থাইল্যান্ডে গিয়ে জীবন রক্ষা করেন। তিনি এখনো হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন। কোনো অনুসন্ধান না করে এমন সংবাদ প্রকাশ ব্যক্তিবিশেষের বিরুদ্ধে কুৎসা রটানোর শামিল। প্রসঙ্গত, গ্রুপের চেয়ারম্যান জয়নুল হক সিকদারের কন্যা পারভীন হক সিকদারের সংসদ সদস্য পদ নিয়ে প্রশ্ন উত্থাপন করে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কর্তৃত্বকে প্রশ্নবিদ্ধ করা হয়েছে। আর দেশের স্বাভাবিক আন্দোলন থেকে মহান স্বাধীনতাযুদ্ধে সিকদার পরিবারের অবদান তথা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মজিবুর (আসলে হবে মুজিবুর) রহমানের সাথে গ্রুপের চেয়ারম্যান জয়নুল হক সিকদারের রাজনৈতিক সম্পর্কের কথা এ প্রজন্মের তরুণ সাংবাদিকদের হয়তো জানা নেই।’

প্রতিবাদে আরও বলা হয়েছে, ‘ইব্রাহিম খালেদ (আসলে হবে খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ) দেশের প্রথিতযশা ব্যাংকার, তিনি সিকদার গ্রুপের তথা সিকদার পরিবারের পটভূমি না জেনেই বিদেশে কীভাবে টাকা গেল সে বিষয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন, যা কেবলই দুঃখজনক। পরবর্তীতে এর প্রেক্ষিতে ইব্রাহিম খালেদ তাঁর মামা সুলাইমান খান মজলিসের কাছে ফোনের মাধ্যমে বিভ্রান্তিমূলক তথ্য দেওয়ার কারণে ক্ষমা প্রার্থনা করেছেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর (আসলে সাবেক গভর্নর) সালাউদ্দিন সাহেবও (আসলে হবে সালেহউদ্দিন আহমেদ) একই ধাঁচের মন্তব্য করেছেন, যা সুচিন্তিত নয় বলে মনে করি। আগেই বলা হয়েছে, বিদেশে বিনিয়োগ তথা বিদেশে গ্রুপের সম্পদ সেই ১৯৮১ সাল থেকে বিদেশ ব্যবসা থেকে সৃষ্ট। ভবিষ্যতে এ ধরনের সংবাদ পরিবেশনের পূর্বে প্রথম আলোর ন্যায় দায়িত্বশীল একটি পত্রিকা যথাযথ অনুসন্ধান করবে বলে আমাদের বিশ্বাস।’

প্রথম আলোর বক্তব্য
প্রথম আলোয় প্রকাশিত প্রতিবেদনে সব বিনিয়োগের তথ্য সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর কোম্পানি নিবন্ধনের নথিপত্র থেকে নেওয়া। এসব তথ্য নিয়ে কোনো আপত্তি তোলেনি সিকদার গ্রুপ। গ্রুপটি দাবি করছে, ১৯৮১ সাল থেকে যুক্তরাষ্ট্রে ব্যবসা করে আসছে, যে ব্যবসা থেকেই অন্য দেশে বিনিয়োগ ও সম্পদ সৃষ্টি হয়েছে। তবে গ্রুপের ওয়েবসাইটে কেবল বিভিন্ন দেশে ব্যবসা থাকার কথা বলা আছে, বিনিয়োগ ও সম্পদ সৃষ্টির কোনো তথ্য নেই। এ ছাড়া ন্যাশনাল ব্যাংকের ওয়েবসাইটে সিকদার গ্রুপের চেয়ারম্যান জয়নুল হক সিকদারের একটি জীবনীগ্রন্থ রয়েছে। জয়নুল হক সিকদার: ব্যতিক্রমী ব্যক্তিত্ব নামের বইটির লেখক বৃহত্তর ফরিদপুর ইতিহাস ঐতিহ্য পরিষদের সভাপতি বদিউজ্জামান চৌধুরী। সেখানে সিকদার পরিবারের ব্যবসা সম্প্রসারণের পেছনে অসংখ্য অলৌকিক ঘটনার বিবরণ আছে। যে ট্রাক ব্যবসায় লোকসান যাচ্ছিল, পুরোনো টায়ার বারবার নষ্ট হচ্ছিল, কোনো এক অলৌকিক কারণে সেই পুরোনো চাকা দিব্যি চলেছে। আর সেখান থেকেই সম্পদের উৎস শুরু। আবার যে ঠিকাদারি ব্যবসা থেকে বিপুল আয় হয়েছে, তার পেছনেও রয়েছে আরেক অলৌকিক ঘটনা। আবার যুক্তরাষ্ট্রে গিয়েই পথ চলতে একটি বড় বাড়ি দেখে সেটি প্রায় দুই লাখ ডলার দিয়ে কিনে ফেলা এবং নতুন নতুন ব্যবসা শুরুর ঘটনার বিবরণও আছে। সদ্য যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়া ব্যক্তিটি এই পরিমাণ অর্থ কীভাবে অর্জন করেছিলেন, বা যাওয়ার সময় দেশ থেকে অর্থ নিয়ে গিয়েছিলেন কি না, তার কোনো বিবরণ বইটিতে নেই। বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছেও এ ধরনের কোনো তথ্য নেই।

বাংলাদেশ থেকে অনুমোদন ছাড়া বিনিয়োগের জন্য বিদেশে অর্থ নেওয়া যায় না। করদাতাদের তাদের কর নথিতে এ ধরনের বিনিয়োগ দেখানোর সুযোগও রাখা নেই। প্রতিবছর বার্ষিক আয়কর বিবরণী জমা দেওয়ার সময় ২৫ লাখ টাকার বেশি সম্পদ থাকলে সম্পদ বিবরণী দাখিল করতে হয়। সেই সম্পদ বিবরণী ফরমের কোথাও বিদেশে সম্পদ থাকলে তা দেখানোর সুযোগ রাখা হয়নি।

তবে এনবিআরের বর্তমান ও সাবেক একাধিক কর্মকর্তা প্রথম আলোকে জানান, বিদেশে সম্পদ থাকার বিষয়টি কর নথিতে দেখানোর জন্য একাধিকবার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু এই ধরনের বিনিয়োগে আইনি সুরক্ষা না থাকায় পিছিয়ে যায় এনবিআর। তা ছাড়া প্রভাবশালীদের চাপও ছিল। আবার অনেক বাংলাদেশি নাগরিকের ইউরোপ-আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়াসহ বিভিন্ন দেশের দ্বৈত নাগরিকত্ব আছে। সেখানো তাঁদের নানা ধরনের বিনিয়োগ আছে। যেহেতু বাংলাদেশের কর নথিতে বিদেশে থাকা সম্পদ দেখানোর বাধ্যবাধকতা নেই, তাই দ্বৈত নাগরিকেরা এ সুযোগটি নেন। তাঁরা এ দেশের কর নথিতে তা দেখান না।

এনবিআর কর্মকর্তারা আরও জানান, বহু করদাতা অবৈধভাবে উপার্জিত অর্থ পাচার করে বিদেশে নিয়ে গেছেন। স্বাভাবিকভাবেই তাঁরা এ ধরনের সম্পদ অর্জনের কথা কর নথিতে গোপন করেন। এ কারণে প্রথম আলোর প্রতিবেদনে বিশ্লেষকেরা অর্থ অবৈধভাবে নিয়ে যাওয়ার প্রবণতার কথা বলে এ নিয়ে সংশয় প্রকাশ ও প্রশ্ন উত্থাপন করেছিলেন।

ন্যাশনাল ব্যাংক বা এক্সিম ব্যাংকের এমডিকে গুলি করার কথা প্রতিবেদনে প্রাসঙ্গিকভাবেই এসেছে। কারণ, ঘটনার সময় ন্যাশনাল ব্যাংকের এমডি উপস্থিত ছিলেন, এ নিয়ে মামলা হয়েছে এবং মামলার পরে রোগী হয়ে ব্যাংকক চলে গেছেন দুই ভাই। আর ব্যাংকক কেন গেলেন এই অনুসন্ধান থেকেই বিভিন্ন দেশে বিনিয়োগের তথ্য জানা গেল। ফলে স্বাভাবিকভাবেই বিনিয়োগের উৎস এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের মতো যথাযথ কর্তৃপক্ষ তা জানে কি না, সেই প্রশ্ন তোলা হয়েছে। তা ছাড়া ন্যাশনাল ব্যাংক এখন সিকদার পরিবারের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। তাদের নিয়ন্ত্রণে থাকার সময়েই ন্যাশনাল ব্যাংক খারাপ হতে শুরু করে। এ নিয়ে অনুসন্ধান করেও নানা তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। সুতরাং এ বিষয়টিও প্রাসঙ্গিক।

দুই বিশ্লেষকের মতামত
সিকদার গ্রুপের মন্তব্যের বিষয়ে জানতে চাইলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘সুলাইমান খান মজলিস সাহেব নামে আমার কোনো মামা নেই। উনি একটি ব্যাংকের এমডি ছিলেন। তাঁর সঙ্গে কথা হয়েছে। আর মাফ চাওয়ার তো প্রশ্নই আসে না। আমার বক্তব্যের প্রতিটি শব্দ সত্য। এখনো সেই মন্তব্যে অটল আছি। আমার মনে হয়, সিকদার গ্রুপ আমাকে ব্ল্যাকমেল করতে চাইছে।’

একই বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন,‌‌‌‌‌‌‌‌ ‘আমি যা মন্তব্য করেছি, তা সুচিন্তিত। রাষ্ট্রের ব্যর্থতার কারণেই দেশের বাইরে বাংলাদেশিদের সম্পদ বাড়ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের বক্তব্যের মাধ্যমে তা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তাদের অনুমোদন ছাড়াই এসব বিনিয়োগ হয়েছে।’