করোনাকালের অর্থনীতি নিয়ে চার বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানের প্রধানের অভিমত

>বেসরকারি খাতের পাশাপাশি বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানগুলোও দেশের অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ অংশ। করোনা মহামারির সময়ে কেমন আছে তারা, কী তাদের কৌশল, ভবিষ্যৎ নিয়েই–বা কী ভাবছে তারা। এসব নিয়েই চার খাতের প্রধান চার বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানের প্রধানের সঙ্গে কথা বলেছেন সুজয় মহাজন, রাজীব আহমেদ ও শুভঙ্কর কর্মকার
রূপালী চৌধুরী
রূপালী চৌধুরী

খরচ কমিয়ে টিকে থাকাটাই বড় লক্ষ্য
রূপালী চৌধুরী

করোনাভাইরাসের কারণে একেক ব্যবসার একেকভাবে ক্ষতি হয়েছে। তবে যাঁরা নিত্যপণ্যের ব্যবসা করেন, তাঁরা কিছুটা ভালো করেছেন। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে নির্মাণসমাগ্রী নিত্যপ্রয়োজনীয় হলেও আমাদের দেশে তা নয়। ফলে রং, সিমেন্ট, রডসহ নির্মাণ খাতের প্রতিষ্ঠানগুলো বড় সমস্যার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। 

করোনার কারণে গত বছরের প্রথম প্রান্তিকের তুলনায় বার্জারের বিক্রি ৫০ শতাংশ কমেছে। এপ্রিলে তো কোনো বিক্রি হয়নি। দোকানপাট খুলে দেওয়া হলেও সামগ্রিকভাবে চাহিদা কম। খুচরা পর্যায়ে বিক্রি কম থাকায় বর্তমানে আমরা বি টু বি (বিজনেস টু বিজনেস) ব্যবসায় মনোযোগী হওয়ার চেষ্টা করছি। আপাতত আমাদের মনে হচ্ছে, সেপ্টেম্বর পর্যন্ত খুচরা পর্যায়ে চাহিদা ততটা বাড়বে না।

অন্যান্য বছর ব্যবসায় প্রবৃদ্ধি ও মুনাফা নিয়ে ব্যস্ত থেকেছি। তবে বর্তমান পরিস্থিতিতে খরচ কমিয়ে টিকে থাকাটাই বড় লক্ষ্য হওয়া উচিত। তার সঙ্গে সহযোগী ব্যবসার চিন্তাভাবনা করা যেতে পারে। মূলধন নিবিড় বিনিয়োগে যাওয়া বুদ্ধিমানের কাজ হবে না। আমরাও এ মুহূর্তে যাব না। তবে করোনার আগে যৌথ উদ্যোগে কনস্ট্রাকশন ক্যামিকেলের কারখানা স্থাপনের উদ্যোগ নিয়েছিলাম। সেটি আমরা শুরু করব। আগামী বছর পণ্যটি বাজারে আসবে।

দেশে করোনা শনাক্তে পরীক্ষার সংখ্যা এখন পর্যন্ত তুলনামূলক কম। অন্যদিকে সরকারি হাসপাতালগুলো চাহিদা অনুযায়ী সেবা দিতে না পারায় মানুষের মধ্যে ভয় ঢুকে গেছে। পরীক্ষার সংখ্যা ও হাসপাতালের প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম নিশ্চিত করে সেবার মান বাড়িয়ে কোনোমতে ভয়টি কাটানো গেলে মানুষ আবার স্বাভাবিক কাজ শুরু করবে। অন্যদিকে প্রতিষ্ঠানগুলোর উচিত হবে বেতন কিছুটা কমিয়ে হলেও কর্মীদের ধরে রাখা। তাদের ছাঁটাই না করা। কারণ, কর্মজীবীরাই আমাদের বড় ভোক্তা শ্রেণি। তাদের কর্মসংস্থান থাকলে পণ্যের চাহিদা বাড়বে, ধীরে ধীরে অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াবে।

করোনার কারণে রেস্তোরাঁ, বুটিকশপ, পারলারসহ ছোট ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানগুলো বেশি ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে। তাদের টিকিয়ে রাখাই বর্তমানে বড় চ্যালেঞ্জ। বিক্রি না থাকায় দোকানভাড়া ও কর্মীদের বেতন দিতে পারছে না অনেক প্রতিষ্ঠান। তারা যেন আবার ব্যবসা চালু করতে পারে, সে জন্য লোকসানের ভাগটি সংশ্লিষ্ট সবাইকে নিতে হবে। প্রয়োজনে তাদের ব্যাংকের মাধ্যমে এককালীন সহযোগিতা করা যেতে পারে। যদিও ৬৫ শতাংশ ছোট ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে ব্যাংকের কোনো যোগাযোগ নেই। তবে তাদের ভ্যাট, আয়কর কিংবা ট্রেড লাইসেন্স আছে। সেটির ভিত্তিতে সহযোগিতা করা সম্ভব। বেসরকারি সংস্থা (এনজিও), এসএমই ফাউন্ডেশন নাকি কোনো প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে কাজটি করা যায়, সেটি চিন্তাভাবনা করা যেতে পারে।

সরকারের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা বেহাল হওয়ার কারণে করোনায় সাধারণ মানুষের দুর্ভোগ বেড়েছে। ফলে সংকট মোকাবিলায় কেবল বরাদ্দ বাড়ালেই হবে না। কারণ, সরকারের অর্থ ব্যয়ে প্রায়শই দুর্নীতির অভিযোগ পাওয়া যায়। তাই সরকারি অর্থের অপচয় বন্ধে যথাযথ নিরীক্ষা (অডিট) করাতে হবে। তবে সেই নিরীক্ষা আন্তর্জাতিক মানের হতে হবে। অন্যদিকে ভ্যাট, আয়করসহ সরকারের অন্যান্য সেবাকে ডিজিটাল করতে হবে। সেটি সম্ভব হলেই কর্মকর্তাদের সঙ্গে মানুষের দেখা-সাক্ষাৎ কমবে। দুর্নীতিতে লাগাম টানা যাবে।

রূপালী চৌধুরী, ব্যবস্থাপনা পরিচালক, বার্জার

নাসের এজাজ বিজয়
নাসের এজাজ বিজয়

কর্মসংস্থানের মাধ্যমে মানুষের হাতে টাকা পৌঁছে দিতে হবে
নাসের এজাজ বিজয়

করোনা মহামারি আমাদের রাষ্ট্রীয়, প্রাতিষ্ঠানিক ও ব্যক্তিগত দুর্বলতা এবং ঘাটতিকে সামনে তুলে ধরেছে। মানুষের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যেরও প্রকাশ ঘটিয়েছে। এসব দুর্বলতা ও ঘাটতি দূর করতে না পারলে করোনার ক্ষতি কাটিয়ে ওঠা কঠিন হবে।

সারা পৃথিবী এবং আমাদের সামনে যে অপ্রত্যাশিত চ্যালেঞ্জ তৈরি হয়েছে, সেটি কারও একার পক্ষে মোকাবিলা করা সম্ভব নয়। সবার সম্মিলিত চেষ্টায় এই ভয়াবহ দুঃসময় কাটিয়ে উঠতে হবে। করোনার সংক্রমণ রোধ করাই আমাদের জন্য এখন বড় চ্যালেঞ্জ। সংক্রমণ ঠেকাতে না পারলে আমাদের অনেক বেশি মূল্য দিতে হবে।

আমি মনে করি, করোনার কারণে দেশে বৈষম্য আরও বেড়ে যাবে। দেশের মধ্যে অনেকে যেমন চাকরি হারাবেন, তেমনি বিভিন্ন দেশ থেকে ফেরত আসবেন প্রবাসী বাংলাদেশিরা। তাই কর্মসংস্থানে সবচেয়ে বেশি জোর দিতে হবে। বিদ্যমান কর্মসংস্থান যতটা সম্ভব ধরে রাখার পাশাপাশি নতুন কর্মসংস্থান তৈরির চেষ্টা করতে হবে। যত বেশি কর্মসংস্থান হবে, তত বেশি মানুষের হাতে টাকা পৌঁছে যাবে। এ জন্য ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প (এসএমই) খাতকে বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে। এ ছাড়া বৈষ্যম কমানোর দিকেও সরকারকে বিশেষ নজর দিতে হবে। তাই স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও কর্মসংস্থান—তিনটি বিষয় সামনে রেখেই এবারের বাজেট হওয়া উচিত বলে মনে করি। পাশাপাশি সুশাসনের উন্নতি ঘটাতে হবে। কারণ, সুশাসন না থাকলে কোনো পদক্ষেপেরই সুফল পাওয়া যাবে না।

বর্তমান বাস্তবতায় অর্থনীতিতে চাহিদা তৈরি করতে হলে মানুষের হাতে টাকা পৌঁছে দিতে হবে। সরকার যে প্রণোদনা ঘোষণা করেছে, তার সুফল যাতে শ্রমিকদের পর্যন্ত পৌঁছায়, সেই ব্যবস্থা করতে হবে। পাশাপাশি বিদেশফেরত এবং দেশের মধ্যে যাঁরা কর্মহীন হবেন, তাঁদের জন্য কারিগরি প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। আমি মনে করি, যেসব প্রবাসী বাংলাদেশি এরই মধ্যে দেশে ফেরত এসেছেন, পরিকল্পনা করে তাঁদের উদ্যোক্তা হিসেবে গড়ে তোলা সম্ভব। এ ক্ষেত্রে ছোট ছোট গ্রুপ করে নিজস্ব কিছু মূলধন ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে স্বল্প সুদে ঋণের ব্যবস্থা করা যায়। এ ছাড়া করোনার বর্তমান বাস্তবতায় উদ্যোক্তাদেরও কিছুটা মানবিক হতে হবে। সবাই ক্ষতি পোষাতে কর্মী ছাঁটাইয়ের পথে হাঁটলে তাতে সমাজে নতুন অস্থিরতা তৈরি হতে পারে। 

আমি যেহেতু ব্যাংকিং খাতের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট, তাই মনে করি, এ খাতের ক্ষতি পোষাতে হলে অপ্রয়োজনীয় খরচ কমাতে হবে। মানবসম্পদের সর্বোচ্চ ব্যবহার বাড়ানোর পাশাপাশি নগদ লেনদেন কমিয়ে (লেস ক্যাশ) আনার পথে যেতে হবে। গত মার্চের মাঝামাঝি সময় থেকে আমাদের ব্যাংকে হোম অফিস চালু করি। পরিকল্পনা করেছি যে সবকিছু স্বাভাবিক হলেও আমরা ৩০ শতাংশ কর্মীকে সব সময় বাসায় রেখে কাজ করাব। ব্যাংকের পক্ষ থেকে তাঁদের বাসায় কাজ করার সব ধরনের সমর্থন দেওয়া হবে। শাখার কার্যক্রমও ধীরে ধীরে কমিয়ে আনার পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছি। তবে এরই মধ্যে আমরা ঘোষণা দিয়েছি, করোনার ক্ষতির কারণে এ বছর আমাদের কোনো কর্মী ছাঁটাই করা হবে না।

আমরা দেখছি, বিশ্বের উন্নত দেশগুলোতে সংক্রমণ কমে এসেছে। ধীরে ধীরে তারা আগের অবস্থায় ফিরতে শুরু করেছে। ওই সব দেশে আমাদের পণ্যের বড় রপ্তানি বাজার। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ ইউরোপের দেশগুলো স্বাভাবিক হয়ে গেলে সেখান থেকে পণ্যের রপ্তানি আদেশ বাড়তে পারে। 

আমরা যদি সংক্রমণ রোধ করতে না পারি, তাহলে বিদেশি ক্রেতারা এ দেশ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতে পারে। সেটি যাতে না হয়, সে জন্য এখনই আমাদের সংক্রমণ রোধে সব ধরনের পদক্ষেপ নিতে হবে।

 নাসের এজাজ বিজয়, প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা, স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক, বাংলাদেশ

কেদার লেলে
কেদার লেলে

জীবন ও জীবিকা দুটিই সমান প্রয়োজন

কেদার লেলে 

জীবন না জীবিকা। কোভিড-১৯ মহামারির এই সময়ে এই বিতর্ক বারবার আলোচিত হচ্ছে এবং সরকার ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে চাপ সৃষ্টি করছে। কিন্তু যখন একজন ব্যক্তি ইউনিলিভারের মতো প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন, তখন তাঁর মধ্যে এই প্রশ্ন আর থাকে না। কারণ, আমরা বিশ্বাস করি ‘জীবন’ এবং ‘জীবিকা’ দুটিই আমাদের জন্য সমান প্রয়োজন।

কোম্পানি হিসেবে ইউনিলিভারের ইতিহাস ৯০ বছরের বেশি সময়ের। সুস্বাস্থ্যের বিষয়টিকে সবার মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়ার লক্ষ্যে এই কোম্পানির প্রতিষ্ঠাতা ইউলিয়াম লিভার ১৮৮৪ সালে ‘সানলাইট সোপ’ বাজারে আনেন। তাঁর এই লক্ষ্যই পরে নীতি হিসেবে দাঁড়িয়েছে যে ‘ভালো কাজের মাধ্যমে ভালো ব্যবসা করা’। সেই থেকেই একটি ‘টেকসই বাসভূমি’-গড়ার লক্ষ্যে বহু অংশীদার বা ‘মাল্টি স্টেকহোল্ডার’ ব্যবসায়িক মডেলকে কাজে লাগিয়ে পৃথিবীতে দায়িত্বশীল পুঁজির প্রসার ঘটাতে ইউনিলিভার ও তার কর্মীরা অবিরাম কাজ করে যাচ্ছেন। 

দেশে কোভিড–১৯ সংক্রমণের প্রকোপ বৃদ্ধির আগেই উৎপাদন থেকে শুরু করে বিক্রয় কার্যক্রম পর্যন্ত প্রতিটি পর্যায়ে সর্বোচ্চ স্বাস্থ্যসতর্কতা ও আচরণবিধি মেনে চলার বিষয়টি নিশ্চিত করার সিদ্ধান্ত নেয় ইউনিলিভার। স্বাস্থ্যসতর্কতা ও বিধির বিষয়ে কর্মীদের প্রশিক্ষণ প্রদান, প্রতিরক্ষামূলক সামগ্রী সরবরাহ, হাত ধোয়ার ব্যবস্থা করা, প্রয়োজনীয় স্থানে জীবাণুনাশক সরবরাহ এবং যেসব কর্মীর জন্য প্রয়োজন ও প্রযোজ্য, তাদের জন্য বাসায় বসে কাজ করার ব্যবস্থা করা হয়েছে। এমনকি আমাদের নিজস্ব কর্মী ছাড়াও ইউনিলিভারের সঙ্গে জড়িত যে ২০ হাজারের মতো মানুষ রয়েছেন, তাঁদের স্বাস্থ্য সুরক্ষা ও নিরাপত্তা সরাসরি নিশ্চিত করতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করেছি। 

ব্যবসা পরিচালনার পাশাপাশি প্রথম থেকেই আমাদের উদ্যোগ ছিল এই মহামারির হাত থেকে বাংলাদেশকে রক্ষা করতে সাধ্যমতো চেষ্টা করা এবং সরকার, উন্নয়ন সংস্থা ও অন্যদের নিয়ে একসঙ্গে কাজ করা। কোভিড-১৯ মহামারির এই সময়ে স্বাস্থ্য খাতের উন্নয়ন, সুরক্ষাসামগ্রী ও নিজস্ব পণ্য বিতরণ, আর্থিক সহযোগিতা, জনসচেতনতামূলক কার্যক্রম এবং জীবন ও জীবিকা নির্বাহ নিশ্চিত করতে আমাদের গৃহীত পদক্ষেপ পৌঁছেছে সাড়ে পাঁচ কোটির বেশি মানুষের কাছে।

এখন বিষয়টি অনেকটাই পরিষ্কার যে কোভিড-১৯–এর সঙ্গে আরও কিছুদিন আমাদের সহাবস্থান করতে হবে। বাংলাদেশে কর্মজীবীদের ৮০ শতাংশের বেশি অনানুষ্ঠানিক কর্মসংস্থানের ওপর নির্ভরশীল এবং তাঁরা বর্তমানে একটি কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি। আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে এখন তাঁদের হাতে দুটো কঠিন পথ খোলা রয়েছে এবং তার মধ্যে যেকোনো একটিকে বেছে নিতে হবে। হয় দারিদ্র্যকে মেনে নেওয়া অথবা কোভিড-১৯–এ আক্রান্তের ঝুঁকির মধ্যে থেকেও বেঁচে থাকার জন্য জীবিকা নির্বাহ করা। তবে আমাদের হাতেই রয়েছে এর সমাধান। কোভিড নিয়ন্ত্রণে জনশৃঙ্খলার বিষয়টি যে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, আমাদের দেশ এবং সমাজকে সেটি অনুধাবন করতে হবে। আচরণগত পরিবর্তনগুলো মেনে চলতে হবে যেমন ঘন ঘন হাত ধোয়া, সামাজিক দূরত্ব মেনে চলা, মাস্ক পরিধান করা এবং রোগ প্রতিরোধসক্ষমতা বৃদ্ধি করা। লক্ষণ প্রদর্শনের প্রাথমিক পর্যায়ে রোগ নির্ণয় করেই যদি দ্রুত কোয়ারেন্টিন করা যায় এবং যাঁরা আক্রান্ত ব্যক্তির সংস্পর্শে এসেছিলেন, তাঁদেরও সঙ্গে সঙ্গে চিহ্নিত করে চিকিৎসার আওতায় আনা যায়, তাহলেই আক্রান্তের সংখ্যা কমানোর পাশাপাশি হাজারো জীবন বাঁচানো সম্ভব। 

আমাদের করণীয় এখন অনেকটাই পরিষ্কার। আমরা কি জীবিকা নির্বাহের মাধ্যমে জীবন রক্ষা করব? যদি সেটা করতে চাই, তাহলে আমাদের সমাজের সবাইকে স্বাস্থ্য সুরক্ষার বিষয়ে অবশ্যই সচেতন হতে হবে। প্রত্যেকের নিরাপদ এবং স্বাস্থ্যকর পরিবেশে কাজ করার পরিবেশ নিশ্চিত করতে সম্পদের ব্যবহার করতে হবে।

আমরা বিশ্বাস করি, ব্যবসার মাধ্যমে পৃথিবীর জন্য ভালো কাজ করার সুযোগ রয়েছে এবং এটা করা আমাদের দায়িত্ব। কোভিড-১৯–এর এই সংকটকালে বিষয়টি আরও স্পষ্ট হয়েছে। এখন সময় আমাদের ব্যবসায়িক মডেলকে আবার মূল্যায়ন করার, সরবরাহব্যবস্থাকে নতুন করে সাজানো এবং ‘নতুন স্বাভাবিকতা’র ধারণাকে আয়ত্ত করা। আবার অন্যভাবে বললে আমরা যদি এই মহামারিকে মোকাবিলা করে বেঁচে থাকতে পারি, তাহলে কিন্তু সংকটের বিপরীতে আরও শক্তিশালী হিসেবে আবির্ভূত হব। দায়িত্বশীল এবং ভালো কাজের মাধ্যমে আমাদের ব্যবসাকে আরও ভালো করতে পারব।

কেদার লেলে সিইও এবং ব্যবস্থাপনা পরিচালক, ইউনিলিভার বাংলাদেশ লিমিটেড 

দীর্ঘমেয়াদি সম্ভাবনাকে প্রাধান্য দিচ্ছি
হিমিহিকো কাতসুকি

হিমিহিকো কাতসুকি
হিমিহিকো কাতসুকি

বাংলাদেশে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব ঠেকাতে প্রায় দুই মাস সাধারণ ছুটি ছিল। ছুটি শেষ হলেও এখনো অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড পুরোপুরি সচল হয়নি। সব মিলিয়ে আমাদের ব্যবসা ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। তবে আমরা স্বল্পমেয়াদি সমস্যার বদলে দীর্ঘমেয়াদি সম্ভাবনাকে প্রাধান্য দিচ্ছি।

বাংলাদেশ হোন্ডা প্রাইভেট লিমিটেড (বিএইচএল) দুই মাস তেমন কোনো বিক্রি না হওয়ার পরও কর্মীদের নিয়মিত বেতন-ভাতা, করোনাকালীন সুবিধা ভাতা দিয়েছে। আমরা এ সময়ে কর্মীদের মধ্যে কোম্পানির মুনাফার ভাগের অর্থ বিতরণ করেছি, যাতে দুর্যোগকালে সেটা তারা কাজে লাগাতে পারে। সরবরাহকারীদের বিলের বিপরীতে অর্থ পরিশোধ করা হচ্ছে। আমরা পরিবেশকদের পরিচালন ব্যয়ের অংশও বহন করেছি। 

৩১ মে কার্যালয় খোলার পর আমরা ‘সুরক্ষাই প্রথম অগ্রাধিকার’ নীতিতে এগোচ্ছি। প্রয়োজন অনুযায়ী কর্মীদের ব্যক্তিগত সুরক্ষা সামগ্রী দেওয়া হয়েছে। নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা হচ্ছে। এ জন্য চিকিৎসক নিয়োগ করা হয়েছে।

হোন্ডার পরিবেশকদের বিক্রয়কেন্দ্রে জীবাণুমুক্তকরণ ও স্বাস্থ্য পরীক্ষার ব্যবস্থা করা হয়েছে, যাতে ক্রেতারা নিরাপদে আমাদের পণ্যগুলো দেখতে ও কিনতে পারেন। বাংলাদেশ হোন্ডা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও বাংলাদেশ সরকারের স্বাস্থ্যবিধি মেনে ব্যবসা পরিচালনা করছে।

দেশে সরকারের সহায়তায় মোটরসাইকেল শিল্প বিকাশ নীতি, ২০১৮ কার্যকর হয়েছে। মোটরসাইকেলের যন্ত্রাংশ যাতে ক্রমান্বয়ে বাংলাদেশেই উৎপাদন করা হয়, এ উদ্দেশ্যে নীতিমালায় প্রাথমিক পর্যায়ে বিদেশ থেকে কম শুল্ক হারে বিভিন্ন যন্ত্রপাতি আমদানির সুযোগ রাখা হয়। উৎপাদকেরা গত কয়েক বছরে কারখানা ও যন্ত্রপাতি উৎপাদনে বিপুল পরিমাণ অর্থ বিনিয়োগ করেছেন। সরকারের নীতিসহায়তা নিয়ে মোটরসাইকেলের দাম আরও সাশ্রয়ী করা হয়েছে।

যাহোক, করোনাভাইরাসজনিত অর্থনৈতিক নিম্নগতির ফলে চলতি বছর মোটরসাইকেল বিক্রি ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ কমতে পারে। দুর্ভাগ্যক্রমে এতে আমাদের বিনিয়োগ ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা আছে। 

বাংলাদেশে প্রতিবছর প্রায় পাঁচ লাখ মোটরসাইকেল বিক্রি হয়। বাজারটি এখনো ততটা বড় নয়। বাংলাদেশে মোটরসাইকেলের বাজারের আকার ভারতের ৩৪ ভাগের ১ ভাগ, ইন্দোনেশিয়ার ১২ ভাগের ১ ভাগ, ভিয়েতনামের ৬ ভাগের ১ ভাগ, পাকিস্তানের ৪ ভাগের ১ ভাগ ও থাইল্যান্ডের ৩ ভাগের ১ ভাগ। এর মূল কারণ এ দেশে মোটরসাইকেলের দাম বেশি।

আমাদের চ্যালেঞ্জ এ শিল্পের বিকাশ নিশ্চিত করা। অনুকূল নীতি পেলে এবং কোভিড-১৯ কেটে গেলে প্রচুর কাজের সুযোগ তৈরি করতে পারব এবং দেশের অর্থনীতিকে পুনরুদ্ধারে অবদান রাখতে সক্ষম হব।

করোনা সংক্রমণ রোধে মোটরসাইকেল সবার জন্য নিরাপদ বাহন হতে পারে। কিন্তু বর্তমান মূল্যস্তরের অধীনে সাধারণ মানুষের পক্ষে মোটরসাইকেল কেনা কঠিন। উৎপাদনকারীরা স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত মোটরসাইকেলের দাম কমানোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। তবে মোটরসাইকেলের নিবন্ধন ব্যয় প্রতিবেশী দেশগুলোর প্রায় চার গুণ। আমরা এটি কমানো এবং তাৎক্ষণিক নিবন্ধন ব্যবস্থা চালুর অনুরোধ করছি। 

বিশ্বের মধ্যে বাংলাদেশের অর্থনীতি অত্যন্ত দ্রুতগতিতে বিকশিত হচ্ছে। বাংলাদেশের বিপুল জনসংখ্যার শক্তিকে এ অর্থনৈতিক বিকাশে কাজে লাগানোর জন্য আমি প্রস্তাব দিতে চাই। আমি মনে করি, এমনকি কোভিড-১৯–এর প্রভাবের পরেও এই অগ্রগতি থামবে না। 

বেশ কয়েকটি বিদেশি মোটরসাইকেল-সংশ্লিষ্ট বিনিয়োগকারী বাংলাদেশে বিনিয়োগে আগ্রহ দেখিয়েছিল। তবে তারা হিসাব করে দেখে যে বিনিয়োগের তুলনায় আয় যথেষ্ট হবে না। বাংলাদেশে মোটরসাইকেলের দাম অন্যান্য দেশের মতো প্রতিযোগিতামূলক হয়ে উঠলে বাজার অবশ্যই বাড়বে। এটি বাংলাদেশের শীর্ষস্থানীয় শিল্পে পরিণত হবে। 

হোন্ডা বিশ্বাস করে, বাংলাদেশে মোটরসাইকেলের বাজার বছরে ৩০ লাখে উন্নীত হবে। বাজার বড় হলে খুব ভালো পরিমাণে বিদেশি বিনিয়োগ বাংলাদেশে আসবে। 

আমি কেবল মোটরসাইকেল শিল্পকেই জানি। আমি বিশ্বাস করি, এই শিল্প ও সরকারের মধ্যে কৌশলগত সমন্বয় বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণ করতে পারে। বাংলাদেশের অর্থনীতির সমৃদ্ধিতে বড় ভূমিকা রাখতে পারে।

হিমিহিকো কাতসুকি, ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা, বাংলাদেশ হোন্ডা প্রাইভেট লিমিটেড