সাগরে ভাসবে লাল-সবুজ

কনটেইনার বহনকারী জাহাজ।  সংগৃহীত
কনটেইনার বহনকারী জাহাজ। সংগৃহীত

সমুদ্রগামী সাধারণ পণ্যবাহী জাহাজে লাল–সবুজের পতাকা ওড়ানোর দৃশ্য অনেক পুরোনো। একই দৃশ্য ছিল কনটেইনার জাহাজেও। তা–ও এক দশক আগে। সেখান থেকে দেশীয় প্রতিষ্ঠানগুলো সরে আসে। এখন আবার কনটেইনার জাহাজে লাল–সবুজের পতাকা ফিরিয়ে এনেছে কর্ণফুলী গ্রুপ।

চলতি মাস থেকেই সমুদ্রগামী কনটেইনার জাহাজেও উড়ছে লাল–সবুজের পতাকা। জাহাজের ফানেলও (চিমনি) রাঙানো হয়েছে লাল–সবুজে। থাকছে এক টুকরা চট্টগ্রামের নামও।

পতাকা উড়িয়ে জাহাজ দুটি চট্টগ্রাম থেকে সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়ার পোর্ট কেলাং বন্দরে কনটেইনার পরিবহন করবে। এই দুটি বন্দর থেকে বাংলাদেশের আমদানি পণ্যবাহী কনটেইনার নিয়ে চট্টগ্রামে আসবে জাহাজ দুটি। আবার ফিরতি পথে নিয়ে যাবে দেশের রপ্তানি পণ্যবাহী কনটেইনার। ২২ জুন সোমবার চট্টগ্রাম বন্দর থেকে প্রথম যাত্রা শুরুর সময় নির্ধারণ করা হয়েছে জাহাজ দুটির।

দেশের নাম যুক্ত করে এই পরিবহন সেবার নাম দেওয়া হয়েছে ‘বাংলাদেশ এক্সপ্রেস সার্ভিস’। জাহাজ দুটির নতুন নাম রাখা হয়েছে ‘সাহারে’ ও ‘সারেরা’। কর্ণফুলী গ্রুপের সহযোগী প্রতিষ্ঠান এইচআর লাইনস লিমিটেড ফিডার অপারেটর হিসেবে জাহাজ দুটি পরিচালনা করবে। দুটি জাহাজই প্রতিবার সর্বোচ্চ ১ হাজার ৫৫০ একক কনটেইনার পরিবহন করতে পারবে। এতে বিনিয়োগ হয়েছে প্রায় ১০০ কোটি টাকা।

কর্ণফুলী গ্রুপের পরিচালক হামদান হোসেন চৌধুরী গতকাল বুধবার প্রথম আলোকে বলেন, এক যুগ পর দেশের পতাকাবাহী কনটেইনার জাহাজ যুক্ত করতে পারা গৌরবের। বাংলাদেশ এক্সপ্রেস সার্ভিসের আওতায় প্রতি সপ্তাহের নির্দিষ্ট দিনে (সোমবার) কনটেইনার পণ্য নিয়ে জাহাজ চট্টগ্রাম বন্দর ছেড়ে যাবে। এতে পোশাক রপ্তানিকারকদের চট্টগ্রাম থেকে কনটেইনার পণ্য সিঙ্গাপুর বা মালয়েশিয়ার বন্দরে অপেক্ষমাণ বড় জাহাজে তুলে দিতে দুচিন্তা করতে হবে না।

বন্দরের তথ্যে দেখা যায়, বর্তমানে চট্টগ্রাম থেকে সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, শ্রীলঙ্কা ও চীনের বন্দরগুলোতে বিদেশি ২২টি প্রতিষ্ঠানের (ফিডার অপারেটর) ৮৪টি জাহাজ কনটেইনার পরিবহন করছে। চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে এসব জাহাজ গত বছর ২৯ লাখ কনটেইনার পরিবহন করেছে। কর্ণফুলী গ্রুপের জাহাজ দুটি বছরে এক লাখ কনটেইনার পরিবহন করতে পারবে।

শিপিং খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় ১০টি শিপিং কোম্পানির সব কটির বাংলাদেশে ব্যবসা রয়েছে। এজেন্সি, সরাসরি ও যৌথ অংশীদারত্বে তারা এ ব্যবসা পরিচালনা করছে। এইচআর লাইনসকে মূলত ২২টি ফিডার অপারেটরের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করেই ব্যবসা করতে হবে।

কর্ণফুলী গ্রুপের পরিচালক রাইমা চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, ‘আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে হলে গুণগত মানের সেবা দিতে হবে। গ্রাহকদের সেরা মানের সেবা দিতে চাই আমরা।’
বাংলাদেশ পতাকাবাহী জাহাজ সংরক্ষণ আইন ২০১৯ অনুযায়ী, দেশীয় জাহাজে ৫০ শতাংশ পণ্য পরিবহনের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। আবার জেটিতে জাহাজ ভিড়ানোর জন্যও অপেক্ষা করতে হবে না। নৌবাণিজ্য দপ্তর থেকে চট্টগ্রাম বন্দরে পাঠানো এক চিঠিতে এ তথ্য জানানো হয়েছে।

চট্টগ্রাম বন্দর চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল এস এম আবুল কালাম আজাদ প্রথম আলোকে বলেন, দেশীয় পতাকাবাহী কনটেইনার জাহাজ থাকা গৌরবের। যেকোনো দুর্যোগ বা সংকটে দেশি পতাকাবাহী জাহাজ থেকে বেশি সহায়তা পাওয়া যায়। বৈদেশিক বাণিজ্যের জন্যও বড় শক্তি। আইন অনুযায়ীই সুযোগ–সুবিধা পাবে দেশীয় পতাকাবাহী জাহাজগুলো।

শিপিং ব্যবসায় কর্ণফুলী লিমিটেড দেশের প্রথম প্রজন্মের প্রতিষ্ঠান। ১৯৫৪ সালে চট্টগ্রামে হেদায়েত হোসেন চৌধুরীর হাত ধরে গ্রুপটির যাত্রা শুরু হয়। বর্তমানে গ্রুপটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে আছেন হেদায়েত হোসেন চৌধুরীর ছেলে সাংসদ সাবের হোসেন চৌধুরী। কনটেইনার শিপিং কোম্পানির এজেন্সি হিসেবে এটি যুক্ত হয় ৩৩ বছর আগে। বর্তমানে গ্রুপটি চারটি ফিডার অপারেটর কোম্পানি ও পাঁচটি মেইন লাইন অপারেটরের এজেন্সি পরিচালনার ব্যবসায় যুক্ত রয়েছে। শিপিং ছাড়াও বেসরকারি কনটেইনার ডিপোসহ লজিস্টিকস কোম্পানিতে বিনিয়োগ রয়েছে গ্রুপটির। ফিডার অপারেটর হিসেবে এবারই প্রথম আত্মপ্রকাশ করেছে গ্রুপটি।

এর আগে বেসরকারি খাতে দুটি দেশীয় প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশের পাতাকাবাহী জাহাজে কনটেইনার পরিবহন করত। প্রতিষ্ঠান দুটি হলো এইচআরসি শিপিং কোম্পানি ও কিউসি কনটেইনার লাইন। ১৯৯৬ থেকে ১৯৯৮ সালের মধ্যে এই ব্যবসায় যুক্ত হয় প্রতিষ্ঠান দুটি। এইচআরসির হাতে ১০টি ও কিউসির হাতে ৭টি জাহাজের মালিকানা ছিল। এক দশক পর দেশীয় প্রতিষ্ঠানের হাত থেকে ধীরে ধীরে পুরোটাই বিদেশিদের হাতে চলে যায় এ ব্যবসা। ২০০৭ সালে কিউসি ও ২০১০ সালে এইচআরসি এ ব্যবসা থেকে পুরোপুরি সরে আসে। এখন দুটি জাহাজ নিয়ে আবারও একটি দেশীয় প্রতিষ্ঠান এই ব্যবসার সূচনা করতে যাচ্ছে।

রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্যে দেখা যায়, সমুদ্রপথে দেশীয় জাহাজে পণ্য পরিবহন করে ২০১৮–১৯ অর্থবছরে রপ্তানি আয় হয়েছিল ৩০ কোটি ৫৭ লাখ ডলার। পুরোটাই এসেছিল দেশীয় পতাকাবাহী সাধারণ পণ্যবাহী জাহাজ থেকে। এবার এই তালিকায় যুক্ত হবে এই দুটি কনটেইনার জাহাজের আয়ও। সাশ্রয় হবে বিদেশি মুদ্রাও। সঙ্গে পতাকার গৌরবও।