সুখবরের মোড়কের আড়ালে কী

>করপোরেট করে সরকার কিছুটা ছাড় দিয়েছে। আছে কিছু কিছু পদক্ষেপ। তা কতটুকু কাজে লাগবে, করোনাকালের ক্ষতি থেকে উত্তরণে করপোরেটের জন্য বাজেট কেমন হলো, প্রধান নির্বাহীদের কী কী জানা দরকার?
অলংকরণ : আরাফাত
অলংকরণ : আরাফাত

নতুন বাজেটে করপোরেট কর কিছুটা কমল। ছয় বছর ধরে দাবি তুলে তুলে এবার কিছুটা ছাড় পেলেন ব্যবসায়ীরা। কিন্তু একটু তলিয়ে দেখলেই হাসি মিলিয়ে যেতে সময় লাগবে না।

করোনাভাইরাস যে পরিস্থিতি তৈরি করেছে, তাতে করপোরেট করে ছাড় আসলে তেমন কোনো সুফল বয়ে আনবে না। বরং বাজেট করপোরেটদের আরও চাপে ফেলবে। কীভাবে, সেটা জানাচ্ছেন ব্যবস্থাপনা পরিচালক, প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) ও হিসাববিদেরা। তার আগে জেনে নেওয়া দরকার, আসলে বাজেটে করপোরেটদের জন্য কী কী পদক্ষেপ আছে, আর এখন তাদের কী কী দরকার ছিল।

করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে ২৬ মার্চ থেকে ৬৬ দিন সাধারণ ছুটি ছিল। প্রথম এক মাস পণ্য বিক্রি ও উৎপাদন মোটামুটি শূন্যের কোটায় থাকার পর এখন কিছুটা ঘুরে দাঁড়িয়েছে করপোরেটগুলো। তা–ও উৎপাদন কোথাও ৫০ শতাংশ, কোনো খাতে ৬০ শতাংশ। এ বছর লাভ নয়, বরং করপোরেটরা কর্মীদের বেতন-ভাতা দিয়ে টিকে থাকার আশায়।

এখন দরকার দুটি জিনিস। প্রথমত, কোম্পানিতে নগদ অর্থের প্রবাহ। দ্বিতীয়ত, বাজারে চাহিদা, যাতে পণ্য উৎপাদন করে বিক্রি করা যায়। এ রকম এক প্রেক্ষাপটে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল গত বৃহস্পতিবার সংসদে ২০২০-২১ অর্থবছরের জন্য বাজেট প্রস্তাব তুলে ধরেন।

বাজেটে করপোরেট–সংশ্লিষ্ট মূল প্রস্তাবগুলো ও তার প্রভাব কী হতে পারে, তা দেখে নেওয়া যাক।

১. পুঁজিবাজারের বাইরে থাকা কোম্পানির করপোরেট কর ৩৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে সাড়ে ৩২ শতাংশ করা হয়েছে। এই ছাড়ের বাইরে ব্যাংক, বিমা, তামাক কোম্পানি ও মুঠোফোন অপারেটর।

২. উপহার দিয়ে পণ্যের প্রচারে (প্রমোশনাল) কোম্পানি মোট বিক্রির শূন্য দশমিক ৫ শতাংশের বেশি ব্যয় করতে পারবে না।

৩. বিদেশ ভ্রমণে ব্যয়ও মোট রাজস্বের শূন্য দশমিক ৫ শতাংশে সীমিত রাখতে হবে।

৪. স্থানীয় পর্যায়ে পুরোনো লোহা বা স্ক্র্যাপ কেনা, চিনি আমদানি, পোলট্রি শিল্পের কাঁচামালসহ কয়েকটি ক্ষেত্রে অগ্রিম আয়কর (এআইটি) কমানো হয়েছে।

৫. কাঁচামাল আমদানিকালে মূল্য সংযোজন কর (মূসক/ভ্যাট) বাবদ যে ৫ শতাংশ কেটে রাখা হয়, সেখানে ১ শতাংশের একটি ছাড় দিয়েছে সরকার।

৬. পণ্য পরিবহন সেবায় ভ্যাটের ৮০ শতাংশ পর্যন্ত ‘ইনপুট ক্রেডিট’ হিসেবে রেয়াত পাওয়া যাবে। তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে কর রেয়াত নেওয়া আইনে ঢুকিয়ে সীমিত করা হয়েছে।

৭. ভ্যাট নিয়ে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সঙ্গে বিরোধে জড়াতে হলে মোট অংকের ১০ শতাংশের বদলে ২০ শতাংশ জমা দিতে হবে।

৮. স্থানীয় ঋণপত্রের মাধ্যমে চাল, আটা, আলু, পেঁয়াজ-রসুন কেনায় ২ শতাংশ উৎসে কর কাটতে হবে।

৯. রপ্তানিমুখী করপোরেটদের দুশ্চিন্তার বিষয় হলো, তাদের উৎসে কর শূন্য দশমিক ২৫ শতাংশ থেকে বেড়ে শূন্য দশমিক ৫ শতাংশ হচ্ছে।

১০. কোম্পানির আনুতোষিক বা গ্র্যাচুইটি তহবিল যদি নিবন্ধিত না হয়, তাহলে কর্মীকে দেওয়া অর্থ তাঁর আয় হিসেবে গণ্য হবে। এর মানে হলো, কোনো সিইও যদি চাকরি ছেড়ে যাওয়ার সময় ৫০ লাখ টাকা গ্র্যাচুইটি হিসেবে পান, সেটা থেকে তাঁর আয়কর দিতে হবে, যদি কোম্পানির তহবিল অনুমোদিত না হয়। বাংলাদেশে সাধারণত কোম্পানিগুলো এ খাতে তহবিল রাখে না। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই অনুমোদন নেওয়া হয় না।

তাহলে সামগ্রিকভাবে কী দাঁড়ালো, বাজেট কেমন হলো—তা জানতে চেয়েছিলাম কয়েকটি করপোরেটের কাছে। তারা বলছে, এ বছর মুনাফার আশা ক্ষীণ। তাই করপোরেট কর কমানোর কোনো সুফল বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই পাওয়া যাবে না। অগ্রিম কর (এটি) ১ শতাংশ কমানোয় কোম্পানিতে কিছু প্রবাহ অর্থ আসবে। কিন্তু অন্য পদক্ষেপগুলো সামগ্রিকভাবে ব্যবসার ওপর চাপ বাড়াবে।

করপোরেটরা চেয়েছিল, এবার অগ্রিম আয়কর পুরোপুরি তুলে নেওয়া হোক। অথবা তা সমন্বয়ের সুযোগ দেওয়া হোক। এ ক্ষেত্রে কোনো কথা নেই বাজেটে।

ক্রাউন সিমেন্টের ভাইস চেয়ারম্যান ও বাংলাদেশ সিমেন্ট ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিসিএমএ) সভাপতি মো. আলমগীর কবির বলেন, ‘অগ্রিম আয়কর চূড়ান্ত দায় হিসেবে বিবেচনা করা যায় না। এ বছর টিকে থাকার জন্য, মুনাফা নয়। এ সময় ৩ শতাংশ অগ্রিম আয়কর কেটে নিলে আমরা কীভাবে টিকে থাকব।’ তিনি বলেন, ‘আমরা আগামী দিনগুলোতে সিমেন্ট খাতে চাহিদা আগের জায়গায় যাবে বলে আশা করতে পারছি না। এ সময় কাঁচামালের কর কমালে খুব ভালো হতো।’

পণ্য ও নানা উপহার দিয়ে কোম্পানির যে ‘প্রমোশনাল’ ব্যয়, তাতে লাগাম টানার ফলে ওষুধ কোম্পানিগুলো বড় ধরনের বিপাকে পড়বে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে একটি ওষুধ কোম্পানির একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা বলেন, এ খাতের ব্যয় নির্ধারিত সীমার অনেক বেশি। এটিকে যদি ব্যয় হিসাবে দেখানোর সুযোগ না থাকে, তাহলে করভার অনেক বেড়ে যাবে।

বিদেশ ভ্রমণ ও প্রমোশনাল ব্যয়ে লাগাম টানার ফলে উদ্বিগ্ন বিদেশি ব্যবসায়ীদের সংগঠন ফরেন ইনভেস্টরস চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (এফআইসিসিআই)। সংগঠনটি তাদের বাজেট প্রতিক্রিয়ায় বলেছে, এ দুই পদক্ষেপের ফলে ব্যবসার আকারভেদে কোম্পানির করভার পরোক্ষভাবে ৫ থেকে ১৫ শতাংশ বেড়ে যেতে পারে।

ফরেন চেম্বারের সভাপতি রূপালী চৌধুরী প্র বাণিজ্যকে বলেন, ‘আমরা আসলে এ পদক্ষেপটি পুরোপুরি বুঝতে পারছি না। কোম্পানি কোথায়, কতটা ব্যয় করবে, সেটায় লাগাম টানা হলে তা হবে ব্যবসায় হস্তক্ষেপের মতো।’

ভ্যাট হার নিয়ে বিরোধে মামলা করতে ২০ শতাংশ অর্থ আগে জমা দেওয়া করপোরেটে অর্থপ্রবাহের ওপর ব্যাপক চাপ ফেলবে বলে আশঙ্কা। ভ্যাট রেয়াতের সুযোগ কিছু কিছু ক্ষেত্রে সীমিত করে দেওয়ায় ব্যবসার ব্যয় বাড়বে বলেও মনে করে তারা। সবচেয়ে বড় চিন্তার বিষয় হলো, করোনাকালে লাভ হোক আর না-ই হোক, আগের মতোই মোট বিক্রির একটি অংশ সরকারকে দিতে হবে করপোরেটদের। সাধারণ কোম্পানির ক্ষেত্রে হারটি শূন্য দশমিক ৬ শতাংশ। মুঠোফোন অপারেটরদের ক্ষেত্রে তা ২ শতাংশ।

করপোরেটরা ন্যূনতম কর থেকেও মুক্তি চেয়েছিল। তা তো কমানো হয়নি, বরং কোম্পানির বাইরে সাধারণ ব্যবসায়ীর ওপর কর বসানো হয়েছে।

ন্যূনতম করের শীর্ষ ভুক্তভোগীর একটি মুঠোফোন অপারেটর রবি আজিয়াটা। ২০১৯ সালে তাদের ৭ হাজার ৪৮১ কোটি টাকা রাজস্বের বিপরীতে ২ শতাংশ হারে ন্যূনতম কর দিতে হয় ১৪৯ কোটি টাকা। অথচ ৪৫ শতাংশ হারে তাদের করপোরেট কর আসত ৭৬ কোটি টাকা। বিপুল বিনিয়োগের বিপরীতে তারা মুনাফা করতে পেরেছে ১৮ কোটি টাকা।

রবির চিফ করপোরেট অ্যান্ড রেগুলেটরি অফিসার সাহেদ আলম প্র বাণিজ্যকে বলেন, ‘ন্যূনতম করের বোঝা প্রত্যাহার না হওয়াটা আমাদের জন্য অত্যন্ত হতাশাব্যঞ্জক। আমরা মনে করি, বিষয়টি পুনর্বিবেচনার সুযোগ এখনো আছে।’

বাজেটের সঙ্গে পাস হওয়া অর্থবিলের দাঁড়ি-কমা বিশ্লেষণ করে খুঁটিনাটি বের করে আনেন হিসাববিদেরা। তাঁদেরই একজন দ্য ইনস্টিটিউট অব চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্টস অব বাংলাদেশের (আইসিএবি) সাবেক সভাপতি মো. হুমায়ুন কবির বলেন, করপোরেট কর কমানোর প্রস্তাব বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের একটি ইতিবাচক ভাবমূর্তি তৈরিতে সহায়তা করবে। তিনি বলেন, করপোরেটে এখনকার তারল্য সংকট কাটাতে তেমন কোনো পদক্ষেপ চোখে পড়েনি। বরং রপ্তানিতে উৎসে কর বাড়ানো এবং প্রমোশনাল ব্যয় ও ভ্রমণ ব্যয়ে বিধিনিষেধ আরোপ করার ফলে করপোরেটের করের বোঝা বাড়তে পারে, যা করপোরেট কর কমানোর সুফলটুকু কেড়ে নেবে।