দরকার ছিল বড় সংস্কার

আকবর আলি খান। ফাইর ছবি
আকবর আলি খান। ফাইর ছবি

২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেট প্রস্তাব একদিকে গতানুগতিক, অন্যদিকে ব্যতিক্রমধর্মী। বাজেটে যেসব লক্ষ্য এক দশক ধরে দেখা যাচ্ছে, এবারেরটিতেও তা-ই দেখা গেল। অতি উচ্চ লক্ষ্যমাত্রা, বাস্তবায়নের ব্যর্থতা, রাজস্ব আদায় করার ব্যর্থতা, অপ্রয়োজনীয় বড় বড় প্রকল্প গ্রহণ করার জন্য বাণিজ্যিক ভিত্তিতে বৈদেশিক ঋণের সম্প্রসারণ করা ইত্যাদি সবই আছে। এত দিন একভাবে চলে আসছিল। এখন আর সেই দিন নেই। প্রতিযোগিতামূলক বিশ্ব, সেখানে টিকে থাকার প্রশ্ন। কোনো সংস্কার ছাড়াই তরতর করে এগিয়ে যাওয়া আর যাবে না।

অথচ প্রস্তাবিত বাজেটে আয় এবং ব্যয়ের কোনো সংযোগ নেই। অর্থমন্ত্রী নিজেই তা স্বীকার করেছেন। তিনি বলেছেন, বাজেট প্রস্তুত করা হয়েছে ব্যয় করার জন্য। আয় কোথা থেকে আসবে, সেটা পরে দেখবেন। এটাকে সত্যিকারের বাজেট বলা যাবে না। বাংলাদেশের সংবিধানে বাজেটের যে বিধানের কথা বলা হয়েছে, সে অনুযায়ী আয় এবং ব্যয়ের মধ্যে সামঞ্জস্য থাকতে হবে। এই সামঞ্জস্য না থাকলে বাজেটকে বাজেট বলা যাবে কি না, তা বিবেচনা করার প্রয়োজন রয়েছে। তবে এটা সত্য যে বাজেটের যে লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে, সে লক্ষ্য নির্ধারণ করা ছাড়া আমাদের কোনো উপায় নেই। মানুষের জীবন রক্ষা করা সরকারের বড় দায়িত্ব। অর্থের অভাবে কাজ বন্ধ করে দেওয়া ঠিক হবে না। বাংলাদেশে বর্তমানে যে ঝড় চলছে, এই ঝড়ের মধ্যে বাজেট কতটুকু শেষ পর্যন্ত থাকবে, আর কতটুকু পরিবর্তন হয়ে যাবে, সেটা অনুমান করা শক্ত। অর্থমন্ত্রীও স্বীকার করেছেন, পুরোপুরি তিনি তা করতে পারছেন না।

দরকার ছিল বড় ধরনের সংস্কার। অনেক দিন ধরে বাংলাদেশে আমরা কোনো সংস্কার করিনি। ছোটখাটো সংস্কার হয়েছে, কিন্তু দেশের সমস্যা সমাধানের জন্য এগুলো খুবই অপ্রতুল। রাজস্ব খাতে সংস্কার করার প্রয়োজন রয়েছে। কিন্তু এই খাতে আমরা উল্লেখযোগ্য কিছু দেখিনি। ব্যাংক খাতে সংস্কারের প্রয়োজন রয়েছে, সেখানেও বড় ধরনের কোনো সংস্কারের উদ্যোগ দেখতে পাচ্ছি না। সরকারের ব্যয় ব্যবস্থাপনায় সংস্কারের প্রয়োজন রয়েছে। সেখানেও কিছু দেখতে পাচ্ছি না। রাজস্ব খাতে ব্যয় ক্রমেই বেড়ে চলেছে, তা কমানোর উদ্যোগ গ্রহণের প্রয়োজন রয়েছে। এখানেও সংস্কারের কোনো কিছু দেখা যাচ্ছে না। ফলে পুরো বাজেটে উল্লেখযোগ্য কোনো সংস্কারের প্রস্তাব না থাকার কারণে ভয় পাচ্ছি যে এ বছরের বাজেটটা শেষ পর্যন্ত কী হয়। বড় ধরনের সংস্কার যদি না হয়, অর্থনীতি পুনরুদ্ধার করা কঠিন হবে। সরকারি খাতে বিনিয়োগ নিরুৎসাহিত হবে, বৈদেশিক বিনিয়োগ আসবে না এবং সব মিলিয়ে আমরা এমন অবস্থায় চলে যাব, যেখান থেকে প্রবৃদ্ধি পুনরুদ্ধার করা মুশকিল হবে। এই অবস্থা থেকে সরকারকে মানুষের বাঁচার জন্য সবই করতে হবে। সঙ্গে সঙ্গে সংস্কারের ব্যবস্থাও নিতে হবে। আর সবার ওপরে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে সুশাসন। সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে ব্যর্থ হলে সাধারণ জনগণের কোনো লাভ হবে না।

>

করোনার এই কঠিন সময়ে বড় ধরনের সংস্কার ছাড়া যে দ্রুত এগিয়ে যাওয়া যাবে না, সে কথাই বললেন আকবর আলি খান।

বাংলাদেশে আমরা গত এক দশকে স্বাস্থ্য খাতকে অবহেলা করেছি। সরকার স্বাস্থ্য খাতে উল্লেখযোগ্য কোনো উদ্যোগ এবারও নেয়নি। স্বাস্থ্য খাতে এক দশকে যেসব বিনিয়োগ হয়েছে, তাতে কোনো সুফল পাওয়া যায়নি। কারণ, একটা অশুভ চক্রের হাতে পড়ে গিয়েছিল স্বাস্থ্য খাত। চক্রটি সাধারণ মানুষকে চিকিৎসা দেওয়ার বদলে অর্থ আদায়ের ব্যাপারে বেশি উৎসাহী ছিল। স্বাস্থ্য খাতের প্রশাসনিক ব্যবস্থাও অত্যন্ত দুর্বল। বরাদ্দ বাড়লেও দ্রুত কিছু করা যাবে কি না, আমার সন্দেহ আছে। ফলে স্বাস্থ্য খাতে বিনিয়োগ তেমন বাড়াতে হবে, প্রশাসনকেও শক্তিশালী করতে হবে। দুটি কাজ একসঙ্গে করা অত্যন্ত শক্ত এবং এই শক্ত কাজটি করার চ্যালেঞ্জ সরকারকে গ্রহণ করতেই হবে।

আর সামাজিক সুরক্ষার কথা যদি বলি, এ খাতে যেসব ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, তা যথেষ্ট নয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ভাতার হার নিম্ন। অন্য দেশগুলোর সঙ্গে তুলনা করলে দারিদ্র্য নিরসনের সঙ্গে এই সুরক্ষা কর্মসূচি যায় না। এ খাতের ব্যয়টা ভালোভাবে করতে হবে। যাদের পাওয়া দরকার, তারাই যেন সুরক্ষা পায়। আরেকটা কথা বলতেই হয়, ব্যাংক কমিশনের কথা আমরা শুনেছিলাম। এবারের বাজেটে সে ব্যাপারে কোনো প্রস্তাবই নেই। অবশ্য ব্যাংক কমিশনই বড় কথা নয়। বাংলাদেশ ব্যাংক ঠিকমতো কাজ না করলে কমিশন করেও কোনো লাভ হবে না। কিছু বিষয় হয়তো উঠে আসবে। সে অনুযায়ী পদক্ষেপ না নিলে তা কাগজেই পড়ে থাকবে। রাজস্ব জিডিপির নিম্নহার বাংলাদেশের জন্মলগ্ন থেকেই আছে। এটা বাড়াতে হলে পুরো রাজস্ব ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজাতে হবে। ধীরে ধীরে করলে হবে না। একবারে বড় ধরনের সংস্কারে হাত দিতে হবে। দুঃখজনক যে এবারের প্রস্তাবিত বাজেটে তার কোনো ইঙ্গিতই আমরা দেখতে পাইনি।

আকবর আলি খান: সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা