১০ বছরে সরকারি চাকরিজীবীদের বেতন-ভাতা ৩ গুণ ছাড়িয়েছে

জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৫ সালের ২৬ মার্চ ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে আরেকটি ভাষণ দিয়েছিলেন। সেই ভাষণটিকেও ঐতিহাসিক মর্যাদা দেওয়া হয়। ওই ভাষণের একটি অংশ জুড়ে ছিল সরকারি কর্মচারীদের মানসিকতা নিয়ে। বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘আপনি চাকরি করেন, আপনার মাইনা দেয় ঐ গরীব কৃষক। আপনার মাইনা দেয় ঐ গরীব শ্রমিক। আপনার সংসার চলে ওই টাকায়। আমরা গাড়ী চড়ি ওই টাকায়। ওদের সম্মান করে কথা বলুন, ইজ্জত করে কথা বলুন। ওরাই মালিক।... সরকারী কর্মচারীদের বলি, এটা স্বাধীন দেশ। এটা ব্রিটিশের কলোনি নয়। পাকিস্তানের কলোনি নয়।’

কিন্তু অর্থ মন্ত্রণালয় প্রতি অর্থবছরের জন্য যে বাজেট তৈরি করে, সেটির সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর দর্শন ও চিন্তা যাচ্ছে না। কারণ, অর্থ মন্ত্রণালয় প্রতিবারই আলাদা করে দেখাচ্ছে, বাজেট থেকে সরকারি কর্মকর্তারা কত বেতন-ভাতা নিচ্ছেন, আর সরকারি কর্মচারীরা কত বেতন-ভাতা পাচ্ছেন। সহকারী সচিব থেকে অর্থসচিব পর্যায়ের ব্যক্তিরাই এ দায়িত্বে থাকেন। তাঁরা অধস্তনদের মনে করেন সরকারি কর্মচারী, আর নিজেদের ভাবেন সরকারি অফিসার বা কর্মকর্তা। অথচ সংবিধানের ২১ ধারা অনুযায়ী তাঁরাও ‘কর্মচারী’।

২০২০-২১ অর্থবছরের জন্য ৫ লাখ ৬৮ হাজার কোটি টাকার প্রস্তাবিত বাজেটে সব সরকারি কর্মচারীর জন্য বেতন-ভাতা বাবদ রয়েছে ৬৮ হাজার ৪৬৪ কোটি টাকা। এর মধ্যে বেতন ২৯ হাজার ২৭০ কোটি টাকা ও ভাতা ২৫ হাজার ৪৭০ টাকা। বাজেটের পরিচালন ও উন্নয়ন ব্যয়ের অর্থনৈতিক বিশ্লেষণে স্পষ্ট ও আলাদা করে উল্লেখ করা হয়েছে, অফিসারদের বেতন ১১ হাজার ৪৪৮ কোটি টাকা, কর্মচারীদের বেতন ২৫ হাজার ৩৭২ কোটি টাকা। এ ছাড়া উভয়ের ভাতা ৩১ হাজার ৬২৬ কোটি টাকা।

১০ বছরে বেড়েছে ২২১%
২০১১-১২ থেকে ২০২০-২১ অর্থবছরের জন্য প্রস্তাবিত বাজেটের সংক্ষিপ্তসার বিশ্লেষণে দেখা যায়, ১০ বছর আগে তাঁদের বেতন-ভাতা দিতে সরকারের মোট খরচ হয়েছিল ২১ হাজার ৩৫০ কোটি টাকা। তখন বেতন ১১ হাজার ২৫৮ কোটি টাকা ও ভাতা ১০ হাজার ৯২ কোটি টাকা ছিল। সেই হিসাবে ১০ বছরে সরকারি চাকরিজীবীদের প্রথম গ্রেড থেকে ২০তম—সব গ্রেড পর্যন্ত বেতন-ভাতা বেড়েছে ২২১ শতাংশ। 

>সব সরকারি চাকরিজীবী প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী। কিন্তু বাজেটে বরাদ্দেরসময় বিভাজন করা হয়।

বিশ্লেষণে আরও দেখা গেছে, আগামী ২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেটের ১২ দশমিক ৫ শতাংশই হচ্ছে সরকারি চাকরিজীবীদের বেতন-ভাতা, যা ১০ বছর আগে অবশ্য ১৪ শতাংশ ছিল। যেহেতু বাজেট পুরোপুরি বাস্তবায়িত হয় না, সেহেতু প্রকৃত বাস্তবায়নের পর বেতন-ভাতার হার বরাদ্দের চেয়ে বাড়বে।

সরকারি চাকরিতে একসময় প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয় ও চতুর্থ—এসব শ্রেণি দেখানোর চর্চা থাকলেও এখন তা নেই। ২০১৫ সালে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিনের নেতৃত্বাধীন বেতন কমিশনের প্রতিবেদনে ২০টি গ্রেডে বেতন-ভাতা দেওয়ার সুপারিশ করা হয়। সে অনুযায়ীই নতুন বাজেটে বেতন-ভাতায় দেওয়া বরাদ্দও ব্যয় হবে। কিন্তু এই প্রতিবেদনের অনেক সুপারিশ মানা হলেও সরকারি কর্মচারীদের মধ্যে শ্রেণি-বিভেদ তুলে দেওয়ার বিষয়টি মানা হয়নি। পাঁচ বছর ধরেই তা এড়িয়ে চলছে অর্থ মন্ত্রণালয়।

এ নিয়ে গতকাল বুধবার মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিনের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘সবাই প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী। কেউ যদি নিজেকে কর্মকর্তা মনে করে অন্যকে কর্মচারী মনে করেন, এটা ঠিক নয়। বঙ্গবন্ধুর কল্যাণরাষ্ট্রের ধারণার সঙ্গেও এটা যায় না। বেতন কমিশনের প্রতিবেদনে তাই আমরা শ্রেণি-ধারণার পরিবর্তে গ্রেডভিত্তিক বেতন-ভাতার সুপারিশ করেছিলাম। সুপারিশ কার্যকর হয়েছে, কিন্তু দেখা যাচ্ছে ওই ধারণাটি রয়ে গেছে।’

এখনো কর্মকর্তা-কর্মচারী বিভেদ
সরকারি কর্ম কমিশন (পিএসসি) যে ২৭ ধরনের ক্যাডার পদে নিয়োগ দেয়, তাদের বলা হয় প্রথম শ্রেণির গেজেটেড কর্মকর্তা। গেজেট প্রকাশের মাধ্যমে তাঁদের নিয়োগ দেন রাষ্ট্রপতি। অর্থ বিভাগের নবম থেকে প্রথম গ্রেডের সরকারি কর্মচারীরাও তাই।

বাজেট প্রণয়নের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কোনো বদ-চিন্তা বা কাউকে ছোট করে দেখার মানসিকতা থেকে তাঁরা বাজেটে কর্মকর্তা বা কর্মচারীর আলাদা বরাদ্দটি দেখান না, দেখান হিসাব ও বোঝার সুবিধার্থে।

দ্বিতীয় শ্রেণি হচ্ছে শুধু ১০ম গ্রেডের কর্মচারীরা। প্রশাসনিক কর্মকর্তা (এও) ও ব্যক্তিগত কর্মকর্তারা (পিও) এর মধ্যে পড়েন। 

 এ ছাড়া ১১-১৬তম গ্রেডের অফিস সহকারী, সাঁট মুদ্রাক্ষরিক, কম্পিউটার অপারেটর ও ডেটা এন্ট্রি অপারেটররা তৃতীয় শ্রেণির এবং ১৭-২০তম গ্রেডের অফিস সহায়ক ও পরিচ্ছন্নতাকর্মীরা চতুর্থ শ্রেণির। 

 পিএসসি অবশ্য কিছু নন-ক্যাডার পদেও নিয়োগ দেয়। নন-ক্যাডার নবম গ্রেডের হলে ১ম শ্রেণি ও ১০ম গ্রেডের হলে ২য় শ্রেণি বলা হয়। ক্যাডাররা ৯ম থেকে পদোন্নতি পেয়ে পেয়ে ১ম গ্রেড পর্যন্ত উঠতে পারেন। নন-ক্যাডারদের বেশির ভাগই থাকেন ব্লক পোস্টে।

হরেক রকমের ভাতা
অর্থ বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, বেতনের সঙ্গে সব সরকারি কর্মচারী নানা ধরনের ভাতা পান। বড় ভাতাটি হচ্ছে বাড়িভাড়া। এ ছাড়া আছে চিকিৎসা ভাতা ও উৎসব ভাতা।

 উপসচিব থেকে সচিব পর্যন্ত বিনা সুদে গাড়ি কেনার যে সুযোগ দিয়ে রেখেছে সরকার, সেই গাড়ির তেল খরচ বাবদই প্রতি মাসে একেকজন পাচ্ছেন মোট বেতন-ভাতার সমান অর্থ। এ ছাড়া রয়েছে টেলিফোন, ভ্রমণ, গৃহকর্মী, ডোমেস্টিক এইড, আপ্যায়ন, শ্রান্তি ও বিনোদন ইত্যাদি ভাতা। আর নিচের গ্রেডের কর্মচারীরা পান যাতায়াত, টিফিন ও সন্তানের শিক্ষা ভাতা।

কিন্তু সরকারি চাকরিতে আরও ব্যতিক্রম ধরনের ভাতা রয়েছে, সাধারণ মানুষের অনেকেই হয়তো জানেন না। যেমন ধোলাই ভাতা, কার্যভার ভাতা, পাহাড়ি ও দুর্গম ভাতা, বিশেষ ভাতা, অবসর ভাতা, কিট ভাতা, রেশন ভাতা, ঝুঁকি ভাতা, ক্ষতিপূরণ ভাতা, প্রেষণ ভাতা, ইন্টার্নি ভাতা, প্রশিক্ষণ ভাতা, মহার্ঘ ভাতা, অধিকাল ভাতা, বিশেষ গার্ড ভাতা ইত্যাদি। অবশ্য এ ক্ষেত্রে সব ভাতা সবাই পান না।

এর মধ্যে দেশের ভেতরে ভ্রমণ ভাতা দেওয়া হয় এলাকা ও কিলোমিটার অনুযায়ী। বিদেশে ভ্রমণে করলে প্রতিদিনের থাকা-খাওয়ার জন্য ভাতা দেওয়া হয়। আর বিশেষ ভাতা দেওয়া হয় বাংলাদেশ পুলিশ, র‍্যাব, জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যদের। 

সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এম হাফিজউদ্দিন খান প্রথম আলোকে বলেন, ব্রিটিশ যুগ থেকে যে মানসিকতা চলে আসছে, তারই প্রতিফলন হচ্ছে বাজেট বইয়ে কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের জন্য আলাদা করে বরাদ্দ দেখানো। সবাই আসলে কর্মচারী। সরকারি তথ্যে এ বিভেদ যত কম উল্লেখ থাকবে, তত তাড়াতাড়ি আমলাতন্ত্র থেকে এ ধরনের মানসিকতার বদল হবে।