বিপাকে দেশি টাইলসশিল্প

ফাইল ছবি
ফাইল ছবি
>আমদানি করা টাইলসের ওপর ট্যারিফ মূল্য কমিয়েছে এনবিআর। ফলে দেশি টাইলস প্রতিষ্ঠান আরও প্রতিযোগিতার মুখে।

দেশীয় সিরামিকশিল্প বিপাকে পড়েছে। আমদানি করা টাইলসের ওপর ট্যারিফ মূল্য কমিয়ে দেওয়ায় বিদেশি টাইলসের আমদানি খরচ এখন কমবে। এর ফলে দেশীয় টাইলসের বাজারে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। বাজারে টিকে থাকতে আরও বেশি প্রতিযোগিতার সম্মুখীন হতে হবে। বিদেশি টাইলসের দাম কমে গেলে দেশীয় টাইলস থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতে পারেন ক্রেতারা। গত কয়েক বছরে দ্রুত সম্প্রসারিত খাতগুলোর একটি হলো সিরামিকশিল্প। 

এই বাজেট মৌসুমেও জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) বাজেট প্রক্রিয়ার বাইরে গিয়ে বেশ কিছু পণ্যের ট্যারিফ মূল্য পুনর্বিন্যাস করেছে। বাংলাদেশ সিরামিকস প্রস্তুতকারক সমিতি ও দেশীয় কোম্পানি মীর সিরামিকস ট্যারিফ মূল্য কমানোয় উদ্বেগ প্রকাশ করে এনবিআরকে চিঠি দিয়েছে। চিঠিতে দেশীয় শিল্প সুরক্ষার স্বার্থে আমদানি করা টাইলসের ট্যারিফ মূল্য আবার আগের জায়গায় ফেরত নেওয়ার দাবি জানানো হয়েছে। 

গত ৩ জুন জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) একটি প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে আমদানি করা বিভিন্ন ধরনের টাইলসের ট্যারিফ মূল্য নির্ধারণ করে। ধরনভেদে প্রতি স্কয়ার মিটার টাইলসের ট্যারিফ মূল্য ঠিক করা হয় ৬ টাকা থেকে ১২ টাকা। কিন্তু এর ঠিক ২০ দিন পরে এই ট্যারিফ মূল্য আবার কমিয়ে দিয়ে নতুন ট্যারিফ ঠিক করা হয়। আকার ও ধরনভেদে নতুন ট্যারিফ মূল্য সোয়া ৫ টাকা থেকে ১১ টাকা করা হয়। সেখানে দেখা গেছে, প্রতি স্কয়ার মিটার ট্যারিফ মূল্য ৭৫ পয়সা থেকে ১ টাকা কমানো হয়েছে। উল্লেখ্য, ট্যারিফ মূল্যের ওপর ভিত্তি করেই আমদানি শুল্ক, মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট), অগ্রিম আয়কর, আগাম ভ্যাটসহ বিভিন্ন শুল্ক-কর বসে। এর ফলে দেশীয় টাইলস নির্মাতা প্রতিষ্ঠানগুলো আগের দামেই পণ্য বিক্রি করলেও আমদানি করা টাইলসের খরচ কিছুটা কমে যাবে। 

টাইলস নির্মাতা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, নতুন এ সিদ্ধান্তের ফলে আমদানিকারকের খরচ কমপক্ষে ১০ শতাংশ কমে যাবে। ফলে তাদের কম দামে টাইলস বাজারে দিতে হবে। 

এতে ক্রেতার লাভ হবে, এমন আশা করা হলেও পেছনের গল্পটি ভিন্ন। বাংলাদেশের টাইলসের বাজার প্রায় পুরোটাই নিয়ন্ত্রণ করেন দেশীয় উদ্যোক্তারা। টাইলসের বাজারে দেশীয় উদ্যোক্তাদের অংশীদারত্ব প্রায় ৮৫ শতাংশ। এর মানে, দেশে যত টাইলস বিক্রি হয়, এর ৮৫ শতাংশই দেশি কোম্পানির। 

বাংলাদেশ সিরামিকস প্রস্তুতকারক সমিতি সূত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশে টাইলসের বাজারের আকার প্রায় সাড়ে ৯ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে দেশি টাইলসের অংশ প্রায় ৮ হাজার কোটি টাকার বেশি। আমদানি করা টাইলসে ট্যারিফ মূল্য কমানোর ফলে বছরে দেশি প্রতিষ্ঠানগুলোর বাজার অংশ প্রায় ৫০০ থেকে ১ হাজার কোটি টাকা কমে যাবে বলে মনে করেন এই খাতের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা।

জানতে চাইলে সমিতির সাধারণ সম্পাদক ও ফার সিরামিকসের পরিচালক ইরফান উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, আমদানি করা টাইলসে ট্যারিফ মূল্য কমানোর ফলে বাজারে ১০ শতাংশ মূল্য কমে যাবে। ফলে দেশি কোম্পানিগুলো কঠিন প্রতিযোগিতার মধ্যে পড়বে। স্বাভাবিক সময়ে হলে এটা পুষিয়ে নেওয়া যেত। কিন্তু করোনার সময় এমনিতেই ব্যবসা-বাণিজ্যে মন্দা। এ অবস্থায় এই ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়া কঠিন হবে। তাঁর মতে, এনবিআরের এই ধরনের উদ্যোগের ফলে দেশি প্রতিষ্ঠানগুলোর স্বার্থহানি ঘটবে। 

জানা গেছে, দেশীয় সিরামিকস তথা টাইলসশিল্পে প্রায় সাড়ে তিন লাখ মানুষ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে কাজ করেন। বর্তমানে ৩০টি কোম্পানি টাইলস উৎপাদন করে। এসব প্রতিষ্ঠানের বিনিয়োগের পরিমাণ ৫ হাজার ২৩৫ কোটি টাকা। করোনার কারণে ব্যবসা মন্দা থাকায় পুরো বিনিয়োগের পাশাপাশি এই খাতের কর্মীরা ঝুঁকির মধ্যে আছেন। 

বর্তমানে দেশীয় কোম্পানির টাইলস উৎপাদনের পর ১৫ শতাংশ ভ্যাট ও ১৫ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক দিতে হয়, যা এনবিআরকে রাজস্ব পেতে সহায়তা করছে। দেশীয় টাইলসশিল্প গত কয়েক বছরে বেশ শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়েছে। এই খাতে ভালো প্রবৃদ্ধিও হয়েছে।

কিন্তু আমদানি করা টাইলসে ট্যারিফ মূল্য কমানোর পর মীর সিরামিকসের পক্ষ থেকে যে চিঠি এনবিআরে পাঠানো হয়েছে, তাতে বলা হয়েছে, করোনার কারণে দেশীয় শিল্পে গুরুতর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। সাধারণ ছুটি ঘোষণার কারণে দেশীয় উৎপাদক প্রতিষ্ঠানগুলোকে উৎপাদন বন্ধ রাখতে হয়েছে। সাধারণ ছুটি তুলে নেওয়ার পর দেশি প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের পূর্ণ উৎপাদনে ফিরে আসার চেষ্টা করছে। সরকারও নানা ধরনের প্যাকেজ ঘোষণা করেছে। কিন্তু এই সময়ে এনবিআরের টাইলস আমদানিতে ট্যারিফ মূল্য কমিয়ে দেওয়ার ঘোষণা এই খাতের শিল্পোদ্যোক্তাদের বিস্মিত করেছে। 

শুরু হওয়া চলতি অর্থবছরের (২০২০-২১) বাজেটেও দেশীয় স্যানিটারি পণ্যের ওপর বাড়তি ১০ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক বসানো হয়েছে। ফলে দেশি স্যানিটারি পণ্যের দামও বাড়বে। এই খাতের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশীয় টাইলস ও স্যানিটারি পণ্য বাজারে প্রতিযোগিতা সক্ষমতা হারাবে। স্থানীয় বাজারে চীনা পণ্যের সরবরাহ বেড়ে যাবে।