৫০ লাখ পরিবারের মধ্যে ৩৪ লাখ এখনো টাকা পায়নি

টাকা। প্রতীকী ছবি
টাকা। প্রতীকী ছবি

করোনার কারণে ক্ষতিগ্রস্ত দেশের ৫০ লাখ দরিদ্র পরিবারের কাছে আড়াই হাজার টাকা করে এখনো পৌঁছাতে পারেনি সরকার। কারণ, জেলা প্রশাসকদের (ডিসি) নেতৃত্বে এবং উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের (ইউএনও) তত্ত্বাবধানে যে তালিকা করা হয়েছিল, তা ছিল অনিয়ম ও অসংগতিতে ভরা।

আড়াই হাজার টাকা করে নগদ সহায়তা নেওয়ার যোগ্য নন, এমন অনেককেই তালিকায় রাখা হয়েছে। এতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে সরকারি কর্মচারী, পেনশনভোগী এবং পাঁচ লাখ টাকার বেশি সঞ্চয়পত্রের মালিককেও। অন্য সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি থেকে সুবিধা ভোগ করে আসছেন, এমন ব্যক্তিদেরও রাখা হয়েছে এ তালিকায়। অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগের এক অবস্থানপত্রে এসব তথ্য উঠে এসেছে।

অর্থ বিভাগ গত ৩০ জুন 'মুজিব বর্ষে করোনায় ক্ষতিগ্রস্ত ৫০ লাখ পরিবারের মধ্যে মোবাইল ব্যাংকিং পরিষেবার মাধ্যমে নগদ অর্থ সহায়তা কর্মসূচি' শীর্ষক অবস্থানপত্রটি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে পাঠিয়েছে। একই দিন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগ, সব বিভাগীয় কমিশনার এবং ডিসিকে আলাদা চিঠি দিয়ে তালিকা সংশোধনের কথাও বলেছে।

অর্থ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, ৫০ লাখ পরিবারের জন্য ১ হাজার ২৫০ কোটি টাকা দুই মাস আগেই অর্থ বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। টাকা পৌঁছানোর খরচের জন্যও বরাদ্দ রয়েছে আট কোটি টাকা। তালিকাটি যখন চূড়ান্ত করা হয়েছিল, তখন রোজার ঈদ ছিল সামনে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ওই ঈদের আগে গত ১৪ মে টাকা দেওয়ার কার্যক্রমের উদ্বোধন করেন। এখন আরেক ঈদ চলে এসেছে।

অর্থ বিভাগের অবস্থানপত্র বলছে, এখন পর্যন্ত টাকা পেয়েছে এক-তৃতীয়াংশেরও কম পরিবার। অর্থাৎ ৩৪ লাখ পরিবার এখনো টাকা পায়নি। অথচ তালিকাটি করা হয়েছিল ডিসিদের নেতৃত্বে এবং ইউএনও তত্ত্বাবধানেই।

২২ লাখ ৮৬ হাজার ৫২৮ জনের তথ্য নানা ধরনের অসংগতিতে ভরা।
৪ লাখ ৯৩ হাজার ২০০ জনকে বাদ দেওয়া হয়েছে।
তিন হাজারের মতো সরকারি কর্মচারী ও সাত হাজারের মতো পেনশনভোগী রয়েছেন।
৫৫৭ জনের নাম রয়েছে, যাদের সঞ্চয়পত্র কেনা আছে ৫ লাখ টাকারও বেশি করে।
৮ লাখ ৭৯ হাজার ৩৫০ জনের তালিকা নতুন করে করতে হবে।

রিকশাচালক, ভ্যানচালক, দিনমজুর, নির্মাণশ্রমিক, কৃষিশ্রমিক, দোকানের কর্মচারী, ব্যক্তি উদ্যোগে পরিচালিত বিভিন্ন ব্যবসায় কর্মরত শ্রমিক, পোলট্রি খামারের শ্রমিক, বাস-ট্রাকের শ্রমিক, হকারসহ নানা পেশার মানুষ তালিকার মধ্যে থাকার কথা। তাঁরা সহায়তা পাবেন মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিস (এমএফএস) অর্থাৎ নগদ, বিকাশ, রকেট ও শিওরক্যাশের মাধ্যমে। নগদ ১৭ লাখ, বিকাশ ১৫ লাখ, রকেট ১০ লাখ এবং শিওরক্যাশ ৮ লাখ মানুষের কাছে টাকা পৌঁছানোর দায়িত্ব পায়।

কতজন পেয়েছেন
অর্থ বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, এখন পর্যন্ত ১৬ লাখ ১৬ হাজার ৩৫৬ জন আড়াই হাজার টাকা করে পেয়েছেন। আর ২ লাখ ১৭ হাজার ৭৩১ জনের টাকা পাওয়ার বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। অর্থাৎ, দুই-তৃতীয়াংশই টাকা পাওয়ার অপেক্ষায় আছেন।

জানতে চাইলে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী মো. এনামুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, 'তালিকাটি ভালোভাবে করা যায়নি। একটু দেরি হোক, তবু প্রকৃত লোক টাকাটা পাক, এটাই আমাদের চাওয়া।'

সরকারি কর্মচারীরাও তালিকায়
তথ্য যাচাই করে ৫০ লাখের তালিকা থেকে অন্তত ৪ লাখ ৯৩ হাজার ২০০ জনকে বাদ দেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছে অর্থ বিভাগ। তাঁদের মধ্যে তিন হাজারের মতো সরকারি কর্মচারী ও সাত হাজারের মতো পেনশনভোগী রয়েছেন। অর্থ বিভাগ দেখেছে, তালিকায় এমন ৫৫৭ জনের নাম রয়েছে, যাঁদের সঞ্চয়পত্র কেনা আছে পাঁচ লাখ টাকারও বেশি করে।

আবার এক লাখেরও বেশি লোক আছেন, যাঁরা অন্য সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি থেকে ইতিমধ্যে সুবিধা পাচ্ছেন। আর প্রায় তিন লাখ ব্যক্তি রয়েছেন, যাঁদের একাধিকবার অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এ ছাড়া পথশিশু, ইমাম, ভবঘুরে, ভিক্ষুক, গৃহিণী, বেদে, হিজড়াদের নাম রয়েছে তালিকায় অন্তত ৮০ হাজার জনের।

অর্থ বিভাগের শীর্ষ পর্যায়ের কর্মচারীরা বলছেন, তাঁদের নজরে এসেছে যে তালিকা তৈরির সঙ্গে যুক্ত কিছু সরকারি কর্মচারী অন্য সরকারি কর্মচারীদের নাম দিয়েছেন। বদলে কমিটির অন্য সদস্যরাও নিজেদের পছন্দসই নাম দিয়েছেন।

২৩ লাখের তথ্যই অসংগতিপূর্ণ
এর বাইরে আরও ২২ লাখ ৮৬ হাজার ৫২৮ জনের তথ্য নানা ধরনের অসংগতিতে ভরা। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় গত ১৫ জুন এসব তথ্য সংশোধন করতে বলেছে ইউএনওদের। তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগ গত ২৭ জুন একই বিষয়ে ইউএনওদের কাছে চিঠি পাঠিয়েছে।

এই সংখ্যার মধ্যে ৮ লাখ ৩০ হাজার জনের জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) বা স্মার্ট কার্ডের বিপরীতে নিবন্ধনকৃত মোবাইল নম্বর নেই। প্রায় আট লাখের এনআইডি বা স্মার্ট কার্ডের নম্বর ও তাতে দেওয়া জন্ম তারিখের সঙ্গে নির্বাচন কমিশনের সার্ভারে থাকা তথ্যের কোনো মিল নেই।

এ ছাড়া ৬ লাখ ৩৮ হাজারের মোবাইল নম্বর এনআইডির বিপরীতে দেওয়া মোবাইল নম্বর থেকে আলাদা এবং সুনির্দিষ্ট পেশা নেই অর্থাৎ গৃহিণী, বস্তিবাসী, বিধবা বা স্বামী পরিত্যক্তা রয়েছেন আরও ১৯ হাজার জন। ১১ ডিজিটের মোবাইল নম্বরের মধ্যে অনেকে কমবেশি ডিজিটও উল্লেখ করেছেন।

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ডিসি হায়াত খান ৫ জুলাই মোবাইল ফোনে প্রথম আলোকে বলেন, 'নতুন নির্দেশনা অনুযায়ী সংশোধন করে ঢাকায় পাঠাচ্ছি। আর এনআইডির বিপরীতে যাঁদের নিবন্ধিত মোবাইল সিম নেই, তাঁদের জন্য ব্যাংক হিসাবও খোলা হবে।'

মোবাইল না থাকলে ব্যাংকে টাকা
অর্থ বিভাগ বলেছে, এনআইডির বিপরীতে কারও মোবাইল ফোন নম্বর নাও থাকে পারে। সে ক্ষেত্রে উপজেলা প্রশাসনের তত্ত্বাবধানে এনআইডির বিপরীতে ১০ টাকা আমানত-সংবলিত হিসাব খোলার ব্যবস্থা করতে হবে।

এ ছাড়া টাকা যাঁরা পেয়েছেন, যাঁরা প্রক্রিয়াধীন রয়েছেন এবং সংশোধনের জন্য আছেন, তাঁদের বাদ দিয়ে ৮ লাখ ৭৯ হাজার ৩৫০ জনের তালিকা নতুন করে করার পরামর্শ দিয়েছে অর্থ বিভাগ।

গত রোববার অর্থ বিভাগ ভিন্ন এক চিঠিতে বাংলাদেশ ব্যাংককে ১০ টাকার হিসাব খোলার ব্যবস্থা নিতে অনুরোধ করেছে। বাংলাদেশ ব্যাংক গত সোমবারই এ নিয়ে জারি করেছে প্রজ্ঞাপন।

সার্বিক বিষয়ে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এ বি মির্জ্জা মো. আজিজুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, এ ধরনের ক্ষেত্রে দেখা যায়, যাঁদের সুবিধা পাওয়ার কথা, তাঁরা পান না, যাঁদের পাওয়ার কথা না, তাঁরা যাচ্ছেন। চাল-গমের ক্ষেত্রে তো তছরুপ হওয়ার অনেক উদাহরণ রয়েছে।

মির্জ্জা আজিজ বলেন, এবার শোনা গেল পাঁচ লাখ টাকার বেশি সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ করা ব্যক্তিরাও আড়াই হাজার টাকা করে সহায়তা নেওয়ার তালিকায়। সরকারের সদিচ্ছা থাকলেও শুধু উপকারভোগীদের ত্রুটিপূর্ণ নির্বাচনপদ্ধতির কারণে দুই মাসেও ৫০ লাখ লোককে টাকা দেওয়া গেল না। এটা দুঃখজনক।