৪০ লাখের বাইরে আরও ১ কোটি আছে

সন্দেহ নেই বাংলাদেশের অর্থনীতিতে তৈরি পোশাক খাতের গুরুত্ব ও অবদান অপরিসীম। মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) পোশাক খাতের অবদান এখন ১১ দশমিক ১৭ শতাংশ। প্রায় ৪০ লাখ মানুষ এখানে কাজ করে। মোট রপ্তানি আয়ের প্রায় ৮৬ শতাংশ পোশাক খাত থেকেই আসে। নারী ক্ষমতায়নেও পোশাক খাতের একটি বড় ভূমিকা রয়েছে।

পোশাক খাতের অগ্রযাত্রার পেছনে সরকারের নীতি-সহায়তার বড় অবদান রয়েছে। বিশেষ করে বড় মূলধন ছাড়াই পণ্য তৈরি করে আবার রপ্তানি করতে ‘ব্যাক টু ব্যাক এলসি’ বা ঋণপত্রের ব্যবস্থা করা হয়েছিল এবং দেওয়া হয়েছিল বন্ড সুবিধা (বিনা শুল্কে কাঁচামাল আমদানি করে, তা দিয়ে প্রস্তুত পণ্য রপ্তানি করে শুল্ক পরিশোধের ব্যবস্থা)। এ দুটো সুযোগকে কাজে লাগিয়ে আশির দশক থেকে দেশের তরুণ উদ্যোক্তারা পোশাকশিল্পকে আজ এই পর্যায়ে নিয়ে এসেছে। কিছু পোশাকমালিকের বিরুদ্ধে বন্ড সুবিধার অপব্যবহার বা কোটা বিক্রি করে বিপুল অর্থবিত্ত তৈরি করার মতো অভিযোগ থাকলেও সে অন্য আলোচনা। কেননা, সে রকম অনেকেই সেই অর্থ বিনিয়োগ করে আরও বড় ব্যবসায়ী হয়েছেন।

তবে পোশাকশিল্প নিয়ে সমালোচনাও আছে। প্রথমত, বাংলাদেশ রপ্তানিতে খুব বেশি পোশাকশিল্পনির্ভর। এই নির্ভরতা থেকেও নানা সমস্যা দেখা দেয়। এই নির্ভরতা দাবি আদায়ে পোশাকমালিকদের একটি বড় অস্ত্র বটে। উদ্যোক্তাদের কৃতিত্বের পাশাপাশি সস্তা শ্রম বাংলাদেশের পোশাক খাতের অগ্রগতির একটি বড় শর্ত। ফলে মজুরি কমিয়ে রাখার একটা প্রবণতা সব সময়েই দেখা যায়। আর এ কারণে বেতন-ভাতা বাড়াতে আন্দোলনে নামতে হয় পোশাকশ্রমিকদের।

পোশাকশিল্প নিয়ে আরেকটি সমালোচনা হচ্ছে প্রায় ৪০ বছরেও এই শিল্পটি নিজের পায়ে দাঁড়াতে শেখেনি। তাদের সরকারের আর্থিক সহায়তার দরকার পড়ে। এখনো যেকোনো সংকট শুরু হলেই তারা সরকারের দিকে তাকিয়ে থাকে এবং এবং নগদ সহায়তা ছাড়া তারা টিকে থাকতে পারে বলে তারা নিজেরাই মনে করে না। সেটা যেকোনো অর্থনৈতিক মন্দায় হোক কিংবা বেতন বাড়ানোর আন্দোলন। করোনাভাইরাসের সময় এটি আবার নতুন করে প্রমাণিত হলো।

তবে পোশাক খাতের বাইরেও বাংলাদেশ আছে। আর তা হচ্ছে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প বা স্মল অ্যান্ড মিডিয়াম এন্টারপ্রাইজ (এসএমই)। এর সঙ্গে অবশ্য এখন কুটির ও অণু (মাইক্রো) শিল্পকে এখন এর যুক্ত করে বলা হচ্ছে সিএমএসএমই। সংজ্ঞা অনুযায়ী ১০ লাখ টাকার নিচে স্থায়ী সম্পদ ও জনবল ১৫ পর্যন্ত হলে তাকে বলা হয় কুটির শিল্প। আর ১৬ থেকে ৩০০ জন পর্যন্ত কর্মীর প্রতিষ্ঠান অণু, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের অন্তর্ভুক্ত। সরকারি তথ্য অনুযায়ী, দেশে এখন ৪৬ হাজার ২৯১টি শিল্পপ্রতিষ্ঠান আছে, যার ৯৩ ভাগই অণু, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পপ্রতিষ্ঠান (এমএসএমই)।

বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) জরিপ বলছে, জিডিপির ২৫ শতাংশ আসে এই খাত থেকে। শিল্প খাতের কর্মসংস্থানের ৮৬ শতাংশই এই খাতে, যা সংখ্যায় প্রায় ১ কোটি। এই খাত মাসে প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকার পণ্য উৎপাদন করে, মজুরি দেয় প্রায় ৬ হাজার কোটি টাকা। তবে এই খাতের মাত্র ৩৮ শতাংশ প্রতিষ্ঠান ব্যাংকঋণ পায়।

এমএসএমইদের প্রভাবশালী কোনো সংগঠন নেই, এই খাতের কেউ সাংসদ নন, কেউ মন্ত্রীও হতে পারেননি। আসলে তাদের পক্ষে বলারও কেউ নেই। এ খাতের উদ্যোক্তাদের আয় ও সঞ্চয় কম, ঝুঁকি মোকাবিলার সক্ষমতাও কম। বাজারজাত করার সামর্থ্য তাদের কম, অর্থায়ন তাদের জন্য চিরকালীন সমস্যা, এই খাতের বড় অংশই কখনো ব্যাংকের কাছে যায় না, কারণ ঋণের বিপরীতে জামানত দেওয়ার মতো সম্পত্তি তাদের নেই। ফলে যেকোনো সংকটে তারা টিকে থাকতে পারে না, সবার আগে ঝড়ে পড়ে।

করোনোভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে দেশের সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত খাত হচ্ছে এই এমএসএমই। অথচ সব চিন্তা, সব পরিকল্পনা মূলত প্রভাবশালী খাতগুলো নিয়ে। পোশাক খাতের ৪০ লাখ শ্রমিকদের কথা অবশ্যই ভাবতে হবে, তবে এমএসএমইর এক কোটি শ্রমিকের কথাও মনে রাখতে হবে।

সরকার এমএসএমই খাতের জন্য ২০ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজের ঘোষণা দিয়েছে। এর ১০ হাজার কোটি টাকা পুনঃ অর্থায়ন করবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এ ঋণের সুদের মাত্র ৪ শতাংশ দিতে হবে উদ্যোক্তাদের, বাকি ৫ শতাংশ সুদ সরকার দেবে। কিন্তু এই এখন পর্যন্ত অব্যবহৃতই আছে। প্রথমত, আগে থেকেই এই খাতের বড় অংশ ব্যাংকমুখী নয়। আবার ৯ শতাংশ সুদ নির্ধারণ করে দিয়ে বাস্তবে সরকার এই খাতের ক্ষতিই করেছে। ঋণ দেওয়ার খরচ উঠে আসবে না বলে ৯ শতাংশ সুদে ঋণ দিতে চায় না ব্যাংকগুলো।

কেনিয়া একইভাবে সুদ নির্ধারণ করে দেওয়ায় বিপাকে পড়েছিল তাদের এসএমই খাত। বাজার থেকে উধাও হয়ে যায় তারা। একই অবস্থা হতে যাচ্ছে বাংলাদেশেও।

অর্থনীতিকে টিকিয়ে রাখতে হলে, সরবরাহ ব্যবস্থা চালু রাখতে হলে, কর্মসংস্থান ও চাহিদা বাড়াতে হলে নির্ভর করতে হবে দেশের এমএসএমই-এর ওপরেই। প্রণোদনা প্যাকেজ ভেঙে এবার পোশাক খাতের বেতন-ভাতা দেওয়া হচ্ছে। এতে তহবিল থেকে অন্য শিল্প খাতের ভাগ কমে যাবে। আর্থিক সংকটে পড়ে সরকার ব্যাংকব্যবস্থা থেকে ঋণ নেওয়া বাড়ালে বেসরকারি খাতের ভাগ আরও কমবে। আয়ের কথা না ভেবে ব্যয় করার যে ঘোষণা অর্থমন্ত্রী বাজেট পেশের পরে বলেছিলেন, তার ফল পাওয়া শুরু হয়েছে। যত বড় সংকটই হোক, পরিকল্পনা ও সুচিন্তিত পদক্ষেপই তা মোকাবিলার একমাত্র পথ।