প্রবাসী আয় ইতিবাচকই, আমেরিকা থেকে আয় আসা বেড়েছে

>মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি দেশ থেকে যেমন আয় আসা কমেছে, আবার হঠাৎ করেই আয় আসা বেড়ে গেছে আমেরিকা থেকে।

করোনাভাইরাসের ধাক্কায় কিছু দেশ থেকে প্রবাসী আয় আসা কমতে শুরু করেছে। আবার কিছু দেশ থেকে আয় আসা হঠাৎ বেড়েছে। ফলে এখন পর্যন্ত প্রবাসী আয়ের ধারা ইতিবাচকই রয়েছে। তবে এই ইতিবাচক ধারা কত দিন থাকবে, তা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। 

দেশভিত্তিক প্রবাসী আয়ের তথ্য থেকে দেখা গেছে, মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি দেশ থেকে আয় আসা কমেছে। আর হঠাৎ করেই আয় আসা বেড়েছে আমেরিকা থেকে। যদিও যুক্তরাজ্য থেকে আয় আসা কিছুটা কমে গেছে। 

বিশ্লেষকেরা বলছেন, বিশ্বজুড়ে করোনার কারণে অর্থনৈতিক যে মন্দা দেখা দিয়েছে, তাতে কমবেশি সব দেশ থেকেই আগামী দিনে আয় আসা কমে যেতে পারে। বর্তমানে অনেকেই জমানো টাকা দেশে পাঠিয়ে দিচ্ছেন। আবার ছাঁটাই হওয়া অনেক শ্রমিক ছাঁটাইয়ের কারণে কিছু বাড়তি অর্থ পেয়েছেন। সেসব টাকা তাঁরা দেশে পাঠিয়ে দিয়েছেন। এ কারণে প্রবাসী আয় এখনো ইতিবাচক ধারায় রয়েছে। 

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রবাসী আয়ের তথ্য অনুযায়ী, মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো থেকেই সবচেয়ে বেশি আয় আসে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি আয় আসে সৌদি আরব থেকে, এরপরই সংযুক্ত আরব আমিরাত। বাংলাদেশের তৃতীয় সর্বোচ্চ আয় আসে আমেরিকা থেকে। আয় পাঠানোর শীর্ষ ১০ দেশের তালিকায় এরপরের অবস্থানে রয়েছে যথাক্রমে কুয়েত, যুক্তরাজ্য, ওমান, মালয়েশিয়া, কাতার, ইতালি ও সিঙ্গাপুর। 

জানতে চাইলে পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর প্রথম আলোকে বলেন, কেউ জমানো টাকা, আবার কেউ চাকরি ছেড়ে দেওয়ার টাকা দেশে পাঠাচ্ছে। এ কারণে আয় বেড়েছে। করোনাভাইরাসের যে পরিস্থিতি চলছে, তাতে শিগগিরই কোনো দেশ ঘুরে দাঁড়াতে পারবে বলে মনে হয় না। সৌদি আরব এরই মধ্যে বড় আকারের শ্রমিক ছাঁটাই শুরু করছে। এর ফলে সবচেয়ে বেশি আয় আসা দেশটি থেকে বড় আঘাত আসবে। 

আহসান এইচ মনসুর আরও বলেন, গত চার মাসে নতুন করে কোনো জনশক্তি রপ্তানি করা যায়নি। চলতি বছরে যাবে বলে মনে হয় না। এর মধ্যে অনেকে ফিরে এসেছেন, আবার অনেককে ফিরে আসতে হবে। ফলে পরিস্থিতি ভালো হওয়ার কোনো সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না। এসব নিয়ে সরকারের কোনো পরিকল্পনাও নেই। 

জানা গেছে, সৌদি আরব থেকে প্রতি মাসে ৩০ থেকে ৩৫ কোটি ডলার আয় আসত। তবে করোনাভাইরাস শুরু হলে গত মার্চে আয় কমে হয় ২৮ কোটি ডলার ও এপ্রিলে ২৭ কোটি ডলার। তবে মে মাসে তা বেড়ে হয় ৩৮ কোটি ও জুনে আরও বেড়ে হয় ৪৮ কোটি ডলার। করোনাভাইরাসের প্রকোপে মার্চের শুরু থেকে কারফিউ জারি করে দেশটি, যা শেষ হয় গত ২১ জুন। জুনেই দেশটি ১২ লাখ বিদেশি শ্রমিক ছাঁটাইয়ের ঘোষণা দেয়। ২০১৯ সালে প্রায় সাড়ে চার লাখ বিদেশি শ্রমিক ওই দেশ ছেড়েছিলেন। 

সৌদি আরবে বসবাসরত একাধিক বাংলাদেশি জানিয়েছেন, করোনার পরে অনেকেই চাকরি হারিয়েছেন। তাঁদের অনেকে জমানো টাকা তুলে দেশে পাঠানো শুরু করেছেন। চাকরি হারানো মানুষগুলো সুযোগ পেলেই দেশে ফিরে যাবেন। এমন অবস্থা আরও অনেক শ্রমিকের। 

সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে প্রবাসী আয় আসা করোনার শুরুতে কিছুটা কমে এলেও এখন তা আবার আগের ধারায় ফিরে গেছে। তবে করোনার পর আমেরিকা থেকে আয় আসা বেড়েছে। দেশটি থেকে করোনার আগে প্রতি মাসে গড়ে ২০ কোটি ডলার আয় আসত। তবে গত মে ও জুনে তা বেড়ে হয়েছে যথাক্রমে ২৬ কোটি ও ২৫ কোটি ডলার। যদিও গত মার্চ ও এপ্রিলে ১৭ কোটি ডলার করে আয় এসেছিল। 

ব্যাংক খাত–সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, মার্চ ও এপ্রিলে করোনার কারণে আমেরিকা থেকে আয় আসা বেশ কমে গিয়েছিল। কারণ, ওই সময় দেশটিতে বলতে গেল মানুষ ঘরবন্দী ছিলেন। দেশটিতে যেসব বাংলাদেশি থাকেন, তাঁদের অনেকে গাড়িরচালক ও রেস্টুরেন্টে কাজ করেন। লকডাউন বা অবরুদ্ধ পরিস্থিতির কারণে তাঁদের আয় কমে যায়। তবে সেখানকার বৈধ নাগরিকদের এ সময়ে অর্থসহায়তাও করেছে দেশটির সরকার। 

কুয়েত থেকে প্রতি মাসে সাধারণত ১১ থেকে ১৩ কোটি ডলার আয় আসত করোনার আগে। তবে গত মার্চ, এপ্রিল ও মে মাসে এ আয় কমে নেমে আসে যথাক্রমে ৯ কোটি, ৮ কোটি ও ৫ কোটি ডলারে। করোনা–পরবর্তী অর্থনৈতিক সংকট কাটাতে দেশটি নতুন নীতিমালা প্রণয়নের
উদ্যোগ নিয়েছে। সেটি পাস হলে চলতি বছরই দেশটিতে প্রায় ১৫ লাখ প্রবাসী শ্রমিক কাজ হারাবেন। এর মধ্যে বাংলাদেশি আড়াই লাখ। আবার বাংলাদেশি শ্রমিকদের বড় অংশকে কাজ দিয়েছিলেন সংসদ সদস্য কাজী শহিদ ইসলাম পাপুল। শহিদ ইসলাম এখন মানব পাচার ও অবৈধ মুদ্রা পাচারের অভিযোগে কাতারে আটক রয়েছেন। ফলে দেশটিতে কাজের উদ্দেশ্যে যাওয়া বাংলাদেশিরা বড় সমস্যায় পড়বেন বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। 

অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) ভাইস চেয়ারম্যান ও এনআরবি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মেহমুদ হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘এটা স্বস্তির যে করোনার মধ্যেও ভালো প্রবাসী আয় আসছে। তবে কত দিন এভাবে আসবে, এটা নিশ্চিত নয়। যাঁরা ফিরে আসছেন, তাঁদের কাজে লাগাতে উদ্যোগ নিতে হবে। যাতে দেশের ওপর বাড়তি চাপ তৈরি না হয়। নতুন বাজার খুঁজে জনশক্তি রপ্তানিতেও বিশেষ নজর দিতে হবে।’ 

জানা গেছে, গত ২০১৯–২০ অর্থবছরে প্রবাসী আয়ের ওপর ২ শতাংশ নগদ প্রণোদনা দেয় সরকার। ফলে ওই অর্থবছরে ১ হাজার ৮২০ কোটি ডলার আয় দেশে আসে, যা আগের অর্থবছরের তুলনায় প্রায় ১১ শতাংশ বেশি। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে আয় এসেছিল ১ হাজার ৬৪১ কোটি ডলার। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে আয় আসে ১ হাজার ৪৯৮ কোটি ডলার।