স্বল্পসংখ্যক মানুষের কাছে অবিশ্বাস্য সম্পদ

বিশ্বে এখন ১০০ কোটি মার্কিন ডলারের চেয়ে বেশি ধনসম্পদ রয়েছে, এমন মানুষের সংখ্যা ২ হাজার ৮২৫। ৭৮০ কোটি মানুষের পৃথিবীতে সংখ্যাটা খুবই কম। কিন্তু এই স্বল্পসংখ্যক মানুষের কাছে যে পরিমাণ সম্পদ রয়েছে, তা অবিশ্বাস্য। বর্তমানে তাঁদের হাতে থাকা সম্পদের নিট মূল্য ৯ দশমিক ৪ ট্রিলিয়ন বা ৯ লাখ ৪০ হাজার কোটি মার্কিন ডলার। এক বছর আগে এ রকম অতিধনী ছিলেন ২ হাজার ৬০৪, সম্পদের মোট মূল্য ছিল ৮ লাখ ৬০ হাজার কোটি ডলার।

ওয়েলথ এক্স নামে একটি বিশ্বখ্যাত প্রতিষ্ঠানের ‘বিলিয়নিয়ার সেনসাস ২০২০’ শীর্ষক অতিধনী শুমারিতে এমন তথ্য উঠে এসেছে। প্রতিষ্ঠানটি ২০১৩ সাল থেকে এই শুমারি করে আসছে। এ নিয়ে সপ্তমবার শুমারি করল ওয়েলথ এক্স।

প্রসঙ্গত, এক বিলিয়নে ১০০ কোটি। যাঁদের ১০০ কোটি ডলারের চেয়ে বেশি আছে, তাঁদের বিলিয়নিয়ার বলা হয়। এ ছাড়া এক ট্রিলিয়নে এক লাখ কোটি। 

২০২০ সালের চিত্র

ওয়েলথ এক্স ২০১৯ সালের বিলিয়নিয়ারদের ওপর শুমারিটি করেছে। এতে দেখা যায়, এক বছরে, অর্থাৎ ২০১৮ সালের তুলনায় বিলিয়নিয়ারের সংখ্যা ২২১ বা ৮ দশমিক ৫ শতাংশ এবং সম্পদ ৮০ হাজার কোটি ডলার বা ১০ দশমিক ৩ শতাংশ বেড়েছে।

তবে ওয়েলথ এক্স চলতি ২০২০ সালের তথ্যও তুলে ধরেছে। সংস্থাটি বলছে, প্রযুক্তি, বিমা, ব্যবসায়িক সেবা ও স্বাস্থ্যসেবা—এসব খাতে এ বছরের প্রথম পাঁচ মাসে বিলিয়নিয়ারের সংখ্যা ৬ থেকে ৯ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে। জাহাজ ও বিমান পরিবহন এবং পোশাক ও বিলাসপণ্য খাতের বিলিয়নিয়াররা খারাপ করেছেন।

বিলিয়নিয়ারের সংখ্যা ও সম্পদ দুটোই ১০ শতাংশের চেয়ে বেশি বেড়েছে এশিয়া ও উত্তর আমেরিকায়। ইউরোপ, প্যাসিফিক আর আফ্রিকায়ও বিলিয়নিয়ার বেড়েছে। তবে মধ্যপ্রাচ্য, লাতিন আমেরিকা ও ক্যারিবীয় অঞ্চলে কমেছে।

বরাবরের মতো বিলিয়নিয়ারের সংখ্যায় যুক্তরাষ্ট্রই শীর্ষে, যেখানে রয়েছে বিশ্বের সর্বোচ্চ ২৮ শতাংশ বিলিয়নিয়ার।

ওয়েলথ এক্সের বিশ্লেষক মায়া ইমবার্গ বলেন, ২০০৮-০৯ সালের অর্থনৈতিক সংকট-পরবর্তী এক দশক ধরে আর্থিক বাজারগুলোর কার্যক্রম বৃদ্ধি ও অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের সুবাদে সার্বিকভাবে অর্থনীতির সম্প্রসারণ ঘটেছে। তারই প্রতিফলন হলো অতিধনীদের সম্পদ বৃদ্ধি। সংকটের পর থেকে সময়োপযোগী আর্থিক ও মুদ্রানীতি নেওয়ার ফলেই তা হয়েছে।

>বিশ্বে অতিধনীর সংখ্যা বাড়ছে
এ রকম ২,৮২৫ জন ধনীর কাছে রয়েছে ৯ লাখ ৪০ হাজার কোটি ডলারের ধনসম্পদ

কোথায় কত বিলিয়নিয়ার

সর্বোচ্চ ৮৪৭ জন বা ৩০ শতাংশ বিলিয়নিয়ার তৈরি হয়েছে ইউরোপে। এই সংখ্যা আগের বছরের চেয়ে ৬ দশমিক ৯ শতাংশ বেশি। তাঁদের সম্পদ ৮ দশমিক ২ শতাংশ বেড়ে ২ দশমিক ৫ ট্রিলিয়ন বা ২ লাখ ৫০ হাজার কোটি ডলারে উঠেছে।

উত্তর আমেরিকায় দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ৮৩৪ জন বা ৩০ শতাংশ বিলিয়নিয়ারের বাস, যা আগের বছরের চেয়ে ১১ দশমিক ২ শতাংশ বেশি। তাঁদের নিট সম্পদ ১৩ দশমিক ৮ শতাংশ বেড়ে ৩ দশমিক ৫ ট্রিলিয়ন উঠেছে, যা বিশ্বের ৩৭ শতাংশ।

এশিয়ায় বিলিয়নিয়ারের সংখ্যা ১২ শতাংশ বেড়ে ৭৫৮ জনে উন্নীত হয়েছে। তাঁদের সম্পদ ১১ শতাংশ বেড়ে ২ দশমিক ৪ ট্রিলিয়ন হয়েছে। তাঁদের রয়েছে বৈশ্বিক হিস্যার ২৬ শতাংশ সম্পদ।

আফ্রিকায় বিলিয়নিয়ারের সংখ্যা ৬ দশমিক ২ শতাংশ বেড়ে এখন ৪১ জন, যাঁদের সম্পদমূল্য ৮৮ বিলিয়ন।

লাতিন আমেরিকা ও ক্যারিবীয় অঞ্চলে বিলিয়নিয়ারের সংখ্যা ১ দশমিক ৪ শতাংশ কমে ১৪০ জনে নেমেছে। তাঁদের সম্পদের মূল্য অবশ্য ২ দশমিক ৪ শতাংশ বেড়ে ৪৫০ বিলিয়ন হয়েছে।

মধ্যপ্রাচ্যে বিলিয়নিয়ার ১ দশমিক ১ শতাংশ কমে ১৭২ জন হয়েছে। তবে তাঁদের সম্পদ সামান্য বেড়ে হয়েছে ৪৫০ বিলিয়ন।

সম্পদের বৈষম্য

বিশ্বব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী ২০১৯ সালে বিশ্বের বৃহত্তম অর্থনীতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে জনগণের মাথাপিছু জাতীয় আয় ছিল ৬৫ হাজার ২৮১ ডলার। এটি বাংলাদেশের মানুষের মাথাপিছু আয় ২ হাজার ১৭৩ ডলারের তুলনায় ৩০ গুণ বেশি। আর আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) হিসাবেও পার্থক্যটা প্রায় একই রকম। এতে দেখা যায়, বিশ্বের সবচেয়ে ধনী দেশের জনগণের মাথাপিছু আয় বাংলাদেশের জনগণের তুলনায় ৩০ গুণ বেশি। অথচ ওপরের দিকে থাকা অতি ধনীদের সঙ্গে তলানির ধনীদের পার্থক্য আরো অনেক বেশি।

বিলিয়নিয়ারদের মধ্যে পার্থক্যটা মূলত নিট সম্পদের পরিমাণে। ওয়েলথ এক্সের তালিকায় থাকা ২ হাজার ৮২৫ জন বিলিয়নিয়ারের মধ্যে অর্ধেকের বেশি অবস্থান ‌‌করছেন ‘সর্বনিম্ন সম্পদ’ শ্রেণিতে, যাঁদের সম্পদের পরিমাণ ১ থেকে ২ বিলিয়ন বা ১০০ থেকে ২০০ কোটি ডলার। এটি বিলিয়নিয়ারদের মোট সম্পদের মাত্র ২০ শতাংশ। এসব অতিধনী যেন শীর্ষ ধনীদের তুলনায় গরিবই বটে। কারণ, তাঁদের চেয়ে শীর্ষ ধনীদের সম্পদ ৫০, ১০০ কিংবা ১৫০ গুণের বেশি।

শীর্ষ দুই শ্রেণিতে যাঁরা রয়েছেন, তাঁরা সংখ্যায় মাত্র ১৫৩ জন বা মোট ধনীর সাড়ে ৫ শতাংশ, অথচ তাঁদের কাছেই কিনা রয়েছে বিলিয়নিয়ারদের মোট সম্পদের ৩৫ শতাংশ বা ৩ দশমিক ৩ ট্রিলিয়ন। আবার এই সম্পদের এক-তৃতীয়াংশই রয়েছে মাত্র শীর্ষ ১৫ জনের হাতে, যাঁদের প্রত্যেকের সম্পদের মূল্য ৫০ বিলিয়নের বেশি।

মাত্র তিন হাজারের কম ধনীর কাছে ৯ লাখ ৪০ হাজার কোটি ডলারের সম্পদ থাকায় যে জিনিসটা প্রমাণিত হয়, তা হলো বিশ্বে ধনী-গরিবের আয় বা সম্পদের বৈষম্য কতটা প্রকট। ব্লুমবার্গ বিজনেসউইক-এর সংকলিত উপাত্ত মতে, বিশ্বে ১৫০ কোটি প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের কাছে নিট সম্পদের পরিমাণ মাত্র এক হাজার ডলার বা এর চেয়ে কম।

বিশ্বব্যাংকের সর্বশেষ ২০১৫ সালের হিসাব অনুযায়ী বিশ্বের ৭৩ কোটি ৪০ লাখ বা ১০ শতাংশ মানুষ আন্তর্জাতিক দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করেন, যাঁদের দৈনিক আয় ১ দশমিক ৯০ ডলারের কম।

 কোভিড-১৯ মোকাবিলায় প্রতিশ্রুতি

গত কয়েক মাসে ২১৫টি দেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ছড়িয়েছে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) পূর্বাভাস অনুযায়ী করোনার কারণে বৈশ্বিক অর্থনীতিতে ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়াবে ১২ ট্রিলিয়ন বা ১২ লাখ ডলার। কোভিড-১৯ মোকাবিলায় বৈশ্বিক প্রণোদনার পরিমাণ অবশ্য ১০ ট্রিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে।

কোভিড-১৯ মহামারি মোকাবিলায় ১০ শতাংশের কিছু বেশি বিলিয়নিয়ার আর্থিক সহায়তা প্রদানের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, যা সব মিলিয়ে মাত্র ২০০ কোটি ডলারের কিছু কম-বেশি হবে। 

সূত্র: ওয়েলথ এক্স, সিএনবিসি