আশুগঞ্জ দিয়ে ট্রানজিট: চার বছরে মাত্র ১৭ চালান

২০১৬ সালে আশুগঞ্জ নৌবন্দর দিয়ে ট্রানজিট শুরু হয়। ফাইল ছবি
২০১৬ সালে আশুগঞ্জ নৌবন্দর দিয়ে ট্রানজিট শুরু হয়। ফাইল ছবি

চার বছর আগে আনুষ্ঠানিকভাবে ভারতকে মাশুলের বিনিময়ে ট্রানজিট দেওয়া শুরু হয়। ২০১৬ সালের জুন মাসে কলকাতা থেকে নৌপথে প্রথমে আশুগঞ্জ নৌবন্দর, এরপর সড়কপথে আখাউড়া হয়ে ত্রিপুরার রাজধানী আগরতলায় প্রথম চালান যায়। ভারত এক দশক আগে থেকেই ট্রানশিপমেন্টের আওতায় পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য ত্রিপুরায় পণ্য নিতে আগ্রহ দেখিয়ে আসছে।

এই ট্রানজিট পথের উদ্বোধন করতে তৎকালীন নৌমন্ত্রী শাজাহান খান, প্রধানমন্ত্রীর বর্তমান অর্থনীতিবিষয়ক উপদেষ্টা মসিউর রহমান হেলিকপ্টারে করে আশুগঞ্জে গিয়েছিলেন। তখন আশা করা হয়েছিল, বাংলাদেশের ভূখণ্ড দিয়ে পণ্য আনা-নেওয়ায় এই পথ ব্যবহার করতে ভারতীয় ব্যবসায়ীরা ব্যাপক আগ্রহ দেখাবেন। 

কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি। গত চার বছরে এই পথে কলকাতা থেকে আগরতলায় সাকল্যে মাত্র ১৭টি চালান গেছে। এসব চালানে ইস্পাত, চাল, ভোজ্যতেল ও পাথর নেওয়া হয়েছে। তবে আগরতলা থেকে কোনো পণ্য কলকাতায় যায়নি। সব মিলিয়ে বাংলাদেশ মাশুল পেয়েছে ৩৫ লাখ টাকা। এই হলো ট্রানজিটের ফল। বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ) সূত্রে এই তথ্য জানা গেছে। 

এমন অবস্থায় জাহাজে কলকাতা থেকে চট্টগ্রাম বন্দর এবং চট্টগ্রাম থেকে সড়কপথে কুমিল্লা–আখাউড়া হয়ে আগরতলা—এভাবে আরেকটি ট্রানজিটের পরীক্ষামূলক যাত্রা শুরু হয়েছে। কলকাতা থেকে চট্টগ্রাম বন্দর হয়ে আনা চার কনটেইনার লোহা ও ডাল আখাউড়া স্থলবন্দরে পৌঁছেছে। আজ বৃহস্পতিবার কনটেইনার ভর্তি এসব পণ্যের চালান সীমান্ত পার হয়ে আগরতলায় যাবে। এই চালানে বাংলাদেশ মাশুল পেয়েছে মাত্র ৫৯ হাজার টাকা। 

বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে বিদ্যমান নৌ প্রটোকলের আওতায় ২০১৬ সালে আশুগঞ্জ বন্দর ব্যবহার করে ট্রানজিট সুবিধা দেওয়া হয়। এর আগে ট্রানজিটের মাশুল কত হবে, তা নিয়ে উভয় পক্ষের মধ্যে কয়েক বছর শুধু দর-কষাকষি হয়। এমনকি মাশুল নেওয়া উচিত হবে কি না, তা–ও আলোচনায় এসেছে। কিন্তু এত হইহল্লা করে যে ট্রানজিট দেওয়া হলো, সেটির গত চার বছরের ফলাফল খুব বেশি আগ্রহী হয়ে ওঠার মতো নয়। ভারতীয় ব্যবসায়ীরা কলকাতা– আশুগঞ্জ–আখাউড়া–আগরতলা পথে ট্রানজিট ব্যবহারে আগ্রহই দেখাচ্ছেন না।

ট্রানজিট পণ্য চলাচল সহজ ও নির্বিঘ্ন করতে আশুগঞ্জে একটি আন্তর্জাতিক মানের কনটেইনার টার্মিনাল এবং আশুগঞ্জ থেকে আখাউড়া পর্যন্ত চার লেনের সড়ক নির্মাণের জন্য আলাদা দুটি প্রকল্প নেওয়া হয়। অবশ্য প্রকল্পটির কাজও খুব বেশি এগোয়নি। 

আশুগঞ্জ দিয়ে বেশির ভাগ মালামাল গেছে ত্রিপুরা রাজ্য সরকারের। জানা গেছে, ত্রিপুরার রাজধানী আগরতলা থেকে উদয়পুর হয়ে সাবরুম পর্যন্ত নতুন রেলপথ নির্মাণ করা হচ্ছে। ওই রেলপথের জন্য কলকাতা থেকে লোহার স্লিপার, পাথরের চালান নেওয়া হয়েছে। গত দেড় বছরে আশুগঞ্জ নৌবন্দর ব্যবহার করে যে পাঁচটি চালান গেছে, সব কটিতেই ত্রিপুরা রেলওয়ের স্লিপার ও পাথর নেওয়া হয়েছে। 

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ট্রানজিট সুবিধা দেওয়া ইতিবাচক। কিন্তু এর সুফল পেতে হলে বন্দর, শুল্ক বিভাগে জনবল নিয়োগের পাশাপাশি আধুনিক যন্ত্রপাতি বসাতে হবে। আশুগঞ্জ বন্দরে এসবের কিছুই করা হয়নি। মালামাল পরিবহনের জন্য রাস্তাঘাটসহ অবকাঠামো তৈরি করতে হবে। এসব না করায় এই ট্রানজিট পথে লিডটাইম ও খরচ কমানো যায়নি। তাই হয়তো এই পথ ব্যবহারে ভারতীয় ব্যবসায়ীদের আগ্রহ কম।

মোস্তাফিজুর রহমান মনে করেন, ত্রিপুরার সঙ্গে ভারতের মূল ভূখণ্ডের রেল যোগাযোগ স্থাপিত হওয়ায় তাদের হাতে পণ্য পরিবহনের আরও সুযোগ তৈরি হয়েছে, যা বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে ট্রানজিট সুবিধাকে আরও প্রতিযোগিতার মধ্যে ফেলেছে।

কত পণ্য গেল

২০১৬ সালের জুন মাসে আনুষ্ঠানিকভাবে ট্রানজিট শুরু হয়। পরের ছয় মাসে তিনটি চালানে ৪ হাজার ২৬২ টন পণ্য আগরতলায় গেছে। এতে মাশুল পাওয়া গেছে ১১ লাখ ৮০ হাজার টাকা। ২০১৭ সালেও সব মিলিয়ে তিনটি চালানে পণ্য গেছে ১ হাজার ৫৯৯ টন, মাশুল মিলেছে ৪ লাখ ৪২ হাজার টাকা। ২০১৮ সালে সবচেয়ে বেশি ছয়টি চালানে ৬ হাজার ৬৪২ টন পণ্য ত্রিপুরায় গেছে। এতে মাশুল পাওয়া গেছে ১০ লাখ ৯৩ হাজার টাকা। গত বছর ৪ হাজার ৫৪৬ টনের তিন চালানে মাশুল মিলেছে ৫ লাখ ৬ হাজার টাকা। 

চলতি বছরে ইতিপূর্বে দুটি চালান গেছে। গত ফেব্রুয়ারি মাসে এমভি সাইক্রোপা জাহাজে করে ত্রিপুরা রেলওয়ের ২ হাজার ১৫০ টন পাথর গেছে। আর জুন মাসে গেছে ৯৬৪ টন লোহার স্লিপার। দুই চালান থেকে মাশুল মিলেছে মাত্র আড়াই লাখ টাকার কিছু বেশি।

চার বছর আগে ভারতকে ট্রানজিট দিতে আশুগঞ্জ নৌবন্দরের কিছু অবকাঠামো উন্নয়ন করা হয়। জেটি, গুদাম, ক্রেন—এসব নির্মাণ করা হয়। এদিকে খুব একটা ব্যবহার না হওয়ায় জেটির বাতি নষ্ট হয়ে গেছে, ক্রেন পড়ে আছে, গুদামঘরটি খালি পড়ে রয়েছে। 

আশুগঞ্জ নৌবন্দরের একজন কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, ট্রানজিটের মালামাল পরিবহনের জন্য গুদামঘর, জেটি তৈরি করা হলেও এখন এগুলো সারা বছর পড়ে থাকে। কীভাবে ব্যবহার বাড়ানো যায়, এর বিকল্প চিন্তা করা হচ্ছে। 

বর্তমান সরকার প্রথম মেয়াদে ক্ষমতায় আসার পরে ২০১১ সালের দিকে আশুগঞ্জ বন্দর দিয়ে প্রথম ট্রানজিটের পণ্য ত্রিপুরায় যায়। তখন ভারত সরকারের বিশেষ অনুরোধে ত্রিপুরার পালাটানা বিদ্যুৎকেন্দ্রের ভারী যন্ত্রপাতি পরিবহনে এই সুবিধা দেয় বাংলাদেশ। পরে এই পথে ট্রানজিট নিয়মিত করতে দুই দেশের মধ্যে আলোচনা শুরু হয়। কয়েক বছর দর-কষাকষির পর টনপ্রতি ১৯২ টাকা ট্রানজিট মাশুল নির্ধারণ করে বাংলাদেশ। এর বাইরে টনপ্রতি ৫০ টাকা নিরাপত্তা মাশুল ও নৌবন্দরে ল্যান্ডিং শিপিং বাবদ টনপ্রতি সাড়ে ৩৪ টাকা মাশুল আছে। সব মিলিয়ে প্রতি টনে ২৭৭ টাকা মাশুল পায় বাংলাদেশ। এ ছাড়া মাঝনদীতে কার্গো জাহাজ অবস্থানের জন্য আলাদা মাশুল আছে।