বিনিয়োগ হতে হবে তিন ক্ষেত্রে

>সফল মানুষদের গল্প শুনতে, তাঁদের ভাবনা বা পরামর্শগুলো জানতে প্রথম আলোর ফেসবুক পেজ ও ইউটিউব চ্যানেলে শুরু হয়েছে ‘এমটিবি নিবেদিত টপ টক’ অনুষ্ঠান। ২১ জুলাই এর তৃতীয় অনুষ্ঠানের অতিথি হয়ে যুক্ত হয়েছিলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর আতিউর রহমান এবং মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী সৈয়দ মাহবুবুর রহমান। অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেছেন প্রথম আলোর বিশেষ বার্তা সম্পাদক শওকত হোসেন। আলোচনার সংক্ষিপ্ত রূপ থাকল পাঠকদের জন্য।
আতিউর রহমান ও সৈয়দ মাহবুবুর রহমান
আতিউর রহমান ও সৈয়দ মাহবুবুর রহমান

শওকত হোসেন: কোভিড ১৯-এ অর্থনীতি বিপর্যস্ত। অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে সরকার প্রায় এক লাখ কোটি টাকার প্রণোদনা তহবিলের ঘোষণা দিয়েছে। এমন একটা প্রেক্ষাপটে আতিউর রহমান, আপনার কাছে প্রশ্ন, অর্থনীতি কোন পথে পুনরুদ্ধার হতে পারে, কোথায় আমাদের অগ্রাধিকার এবং কাদের ওপর আমাদের বিনিয়োগ করা উচিত?

আতিউর রহমান: অর্থনীতির পুনরুদ্ধার কৌশল হিসেবে তিন ক্ষেত্রে বিনিয়োগ করা উচিত। প্রথমত, মানুষের ওপর বিনিয়োগ করা উচিত। যারা পিরামিডের নিচের দিকে আছে, তাদের বাঁচিয়ে রাখতে হবে, টিকিয়ে রাখতে হবে এবং একই সঙ্গে তাদের নতুন করে কাজ শিখিয়ে নতুন করে কাজের জন্য তৈরি করতে হবে। তারা অনানুষ্ঠানিক খাতেই মূলত কাজ করে। তাদের ট্রেড লাইসেন্স নেই, তাদের টিন নম্বর নেই। সুতরাং এই মানুষগুলোর ওপর বিনিয়োগ করা এক নম্বর। দ্বিতীয়ত, অর্থনীতির পুনরুদ্ধারটা হতে হবে আরও সবুজ ও আরও স্থিতিস্থাপক। একটা সবুজ পুনরুদ্ধারের দিকে যেতে হবে, যেখানে আমরা কম কার্বন ক্লাইমেট রেজিলিয়েন্টের দিকে যাব। তিন নম্বরটি হলো, ডিজিটাল ট্রান্সফরমেশন অর্থাৎ ডিজিটাল রূপান্তর আমাদের জন্য কত সহায়ক, এই সুযোগে আমরা তা শিখেছি। এখানে বিনিয়োগ আরও বেশি করতে হবে। ন্যাশনাল পেমেন্ট সুইচকে দ্রুত ইন্টারঅপারেবল করে ফেলা দরকার। মানে কেউ যদি মোবাইল ব্যাংকিংয়ে কাজ করে, তাহলে সে যেন সৈয়দ মাহবুবের ব্যাংকে ঢুকতে পারে, মাহবুবের ব্যাংকে যে কাজ করে, সে যেন সিটি ব্যাংকে ঢুকতে পারে। এমনকি যেকোনো ব্যাংক যেন মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসের সঙ্গে অংশীদার হয়ে ন্যানো ক্রেডিট দিতে পারে। যে মোবাইলে মাসে ২০-২৫ হাজার টাকা লেনদেন করছে, সেখান থেকে কিছু সঞ্চয় করছে, মোবাইলে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স ব্যবহার করে তার ব্যবহারের বা ক্যাশ লেনদেনের ধরনটা বুঝে আমি পাঁচ হাজার টাকা ঋণ দেব। সুতরাং, এই তিনটি ক্ষেত্রে আমাদের পুনরুদ্ধার করতে হবে এবং এই তিনটি ক্ষেত্রের প্রভাবই আমরা কৃষিতে দেখতে পাব। বাংলাদেশের কৃষি হলো আমাদের একমাত্র রক্ষাকবচ।

শওকত হোসেন: অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের সবচেয়ে বড় চাপটা পড়ছে ব্যাংকারদের ওপর। সৈয়দ মাহবুবুর রহমানের কাছে প্রশ্ন, এই চাপটা আপনারা কীভাবে সামলাচ্ছেন?

সৈয়দ মাহবুবুর রহমান: অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে প্রধানমন্ত্রী খুব দ্রুতই প্রায় এক লাখ কোটি টাকার যে প্রণোদনার ঘোষণা দিয়েছেন। তবে এর সবকিছুই ব্যাংকের ওপর পড়েছে। এমনিতেই ব্যাংক খাত একটা খারাপ সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছিল। আমাদের দেশে প্রায় ৫৯টি ব্যাংক আছে। আমি আসলে গোনাও বন্ধ করে দিয়েছি। হাতে গোনা কয়েকটা ব্যাংক ছাড়া বেশির ভাগের অবস্থাই কিন্তু সুরক্ষিত নয়। চাপটা এসেছে ব্যাংকের ওপর, রাজস্ব থেকে কিন্তু বড় কিছু আসে নাই। বাজেটে আমরা সে রকম কিছু দেখিনি। আবার বলা হয়েছে, গ্রাহক-ব্যাংক সম্পর্কের ওপর ভিত্তি করে সব হবে।

শওকত হোসেন: আপনি যে অনানুষ্ঠানিক খাতের কথা বললেন, তারা তো আসলে ব্যাংকের কাছে যায় না, ব্যাংকও তাদের কাছে পৌঁছায় না। আবার বড়রা ব্যাংকের কাছ থেকে বেশি অর্থ নিয়ে গেলে বাকিরা কী পাবে? এসব সমস্যার সমাধান আসলে কীভাবে সম্ভব?

আতিউর রহমান: আসলে রাজস্ব নীতি এবং আর্থিক নীতির একটা সমন্বয় সাধন করতে হবে। আর ব্যাংকর ক্ষেত্রে বড় বিষয় হলো, ঝুঁকিটা কে শেয়ার করবে? এর একটা অংশ অবশ্যই ব্যাংক করতে পারবে, বাকি অংশ সরকারকে নিতে হবে। সরকার তো সরাসরি নেবে না। এটা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মাধ্যমে নিতে হবে। যেমন তারা ব্যাংকগুলোকে কম খরচে তহবিল দিচ্ছে। সেখানে তারা সুদে ভর্তুকি দিচ্ছে। কিন্তু আমি মনে করি সেটা যথেষ্ট না। এখন সরকারের উচিত একটা ক্রেডিট গ্যারান্টি স্কিম চালু করা, যাতে এই ক্রেডিট গ্যারান্টির মধ্যে রিস্কটা শেয়ার করা যায়। এটা বড়দের ক্ষেত্রে। কথা হচ্ছে ছোটদের নিয়ে। এসএমইর জন্য কিংবা অণু বা কুটির শিল্পের জন্য তিন হাজার কোটি টাকা রাখা হয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক ১ শতাংশে ব্যাংকে তহবিল দেবে, ব্যাংক আড়াই শতাংশ যোগ করে সাড়ে ৩ শতাংশে ক্ষুদ্রঋণ সংস্থাগুলোকে (এমএফআই) দেবে। এমএফআই সেটাকে ৯ শতাংশে নিয়ে যাবে ছোটদের কাছে। আমি মনে করি, এই তহবিলের পরিমাণ বাড়ানো উচিত। আমার প্রস্তাব, ব্যাংককে আরও ১ শতাংশ ভর্তুকি দেওয়া উচিত ঝুঁকি নেওয়ার জন্য। আর কেন্দ্রীয় ব্যাংক কেন শূন্য শতাংশে তহবিলটা দিচ্ছে না।

শওকত হোসেন: সৈয়দ মাহবুবুর রহমানের কাছে আবার যাই। আপনারা তাহলে কী চান? কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে কী চান, সরকারের কাছেই বা কী চান—এই দুটো আমরা একটু জানতে চাইছি।

সৈয়দ মাহবুবুর রহমান: মুশকিল হলো কি, আমাদের দেশে আমানত সংগ্রহের খরচটা বেশি। এখন আমরা বড় ঋণও ৯ শতাংশে দিচ্ছি, আবার ছোট ঋণও ৯ শতাংশে দিচ্ছি। যদি একটা এক হাজার কোটি টাকার পোর্টফোলিও থাকে, আমি কিন্তু দুই থেকে তিনজনের মাধ্যমেই এক হাজার কোটি টাকার পোর্টফোলিওর ব্যবস্থা করে ফেলতে পারব। কিন্তু এক হাজার কোটি টাকার পোর্টফোলিও যদি আমি ছোট ঋণ দিয়ে করি, যদি এক কোটি টাকা দিয়েও করি, আমার প্রায় এক হাজার গ্রাহক লাগবে। এই এক হাজারকে তো আমি দুই বা তিনজন দিয়ে করতে পারব না। আবার ন্যানো ঋণ নিয়ে আমি নিজে কিছু কাজ করেছি। এই ঋণকে অন্য ঋণের সঙ্গে মেলালে হবে না। ধরেন, একজন রিকশাচালক ঘর থেকে বেরিয়ে দেখল তার রিকশার চাকাটা ফেটে গেছে। এখন ২০০ বা ৩০০ টাকা লাগবে। তার পকেটে টাকা নেই। সঙ্গে সঙ্গে সে ওই ঋণের দিকে চলে যাবে। সেটা বিকাশই হোক বা রকেটই হোক। যদি সে ঋণ পাওয়ার মতো হয়, তাহলে কিন্তু তার হিসাবে ৩০০ টাকা ঢুকে গেল। এখন এই ৩০০ বা ৫০০ টাকা আদায় করতে গিয়ে যদি বলেন ৯ শতাংশ সুদ ধরতে হবে, তাহলে এটা তো সম্ভব নয়।

মনে রাখতে হবে স্কয়ার গ্রুপের রিস্ক প্রোফাইল আর বাজারের একটা দোকানের রিস্ক প্রোফাইল কিন্তু এক নয়। পুরো বিশ্বেই এখন রিস্ক অনুযায়ী মূল্য নির্ধারণ করা হচ্ছে। বাজারের চাহিদা অনুযায়ী ঠিক হবে। এটা এখন একটা গ্লোবাল ইকোনমি। আমরা যেদিকে যেতে চাইছি, সেদিকে যেতে গিয়ে দেখা যাচ্ছে আমরা পিছিয়ে যাচ্ছি। সেই জিনিসটা আমাদের ব্যাংকারদের জন্য বিরাট একটা ইস্যু হয়ে যাচ্ছে।