বেচাকেনায় 'অখুশি নন' ব্যবসায়ীরা

কোরবানির ঈদ সামনে রেখে প্রতিবছর বাড়ে রেফ্রিজারেটরের চাহিদা। করোনাকালেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। রেফ্রিজারেটর দেখছেন ক্রেতারা। গতকাল রাজধানীর জাতীয় স্টেডিয়াম মার্কেটের ট্রান্সকম ডিজিটালের বিক্রয় ও প্রদর্শনী কেন্দ্রে।  ছবি: হাসান রাজা
কোরবানির ঈদ সামনে রেখে প্রতিবছর বাড়ে রেফ্রিজারেটরের চাহিদা। করোনাকালেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। রেফ্রিজারেটর দেখছেন ক্রেতারা। গতকাল রাজধানীর জাতীয় স্টেডিয়াম মার্কেটের ট্রান্সকম ডিজিটালের বিক্রয় ও প্রদর্শনী কেন্দ্রে। ছবি: হাসান রাজা

পবিত্র ঈদুল আজহায় রেফ্রিজারেটর কেনার যে ধুম পড়ে, সেখানে এবার ভাটা। তারপরও বিক্রেতা প্রতিষ্ঠানগুলো অখুশি নয়। কারণ, কয়েক মাস আগেই এর চেয়ে খারাপ দশা দেখেছে তারা। সে তুলনায় বিক্রির পরিমাণকে বেশ ভালোই বলছে তারা।

একই চিত্র পোশাক, জুতা, আসবাব, মুঠোফোন, মোটরসাইকেলসহ বিভিন্ন পণ্যের বাজারে। বিভিন্ন কোম্পানি, পাইকারি ব্যবসায়ী ও দোকানমালিকদের সঙ্গে কথা বলে দেখা যায়, তাঁরা এবারের ঈদুল আজহায় গত বছরের তুলনায় ৫০ থেকে ৭০ শতাংশ পর্যন্ত পণ্য বিক্রির আশা করছেন।

বড় কথা হলো গত এপ্রিল, মে ও জুনের তুলনায় বিক্রির পরিমাণ অনেক বেশি। এটাই তাঁদের জন্য সুখবর। কারণ হলো, এখন বিক্রি করে তাঁরা যে টাকা পাচ্ছেন, তা দিয়ে বকেয়া দোকানভাড়া, সরবরাহকারীর বকেয়া বিল ও কর্মীদের বেতন-ভাতা দিতে পারছেন। অনেকের জমে যাওয়া পণ্য বিক্রির সুযোগ তৈরি হয়েছে।

শুরুতে দেখা যাক রেফ্রিজারেটরের বাজারের কী অবস্থা। এ বাজারে সবচেয়ে বড় হিস্যা ওয়ালটনের। ঈদবাজারে ওয়ালটন এবার ছয় লাখ রেফ্রিজারেটর বিক্রির আশা করছে, যা গত বছর ছিল ১০ লাখ। জানতে চাইলে ওয়ালটন হাই-টেক ইন্ডাস্ট্রিজের অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক গোলাম মুর্শেদ লিখিত বক্তব্যে বলেন, করোনায় এবার বিক্রি কম হলেও খুব বেশি একটা খারাপ যাবে না। গত এপ্রিল ও মে মাসের তুলনায় জুন-জুলাইয়ে ওয়ালটন রেফ্রিজারেটর বিক্রির পরিমাণ প্রায় তিন গুণ বেশি।

পোশাকের বাজারে ঈদুল আজহার গুরুত্ব চার ভাগের এক ভাগ। মানে হলো সারা বছর যে বেচাকেনা হয়, তার ২৫ শতাংশ হয় কোরবানির ঈদে। এবার পোশাক ব্যবসায়ীরা পয়লা বৈশাখের বাজার হারিয়েছেন। ঈদুল ফিতরে বেচাকেনার সুযোগ পেয়েছিলেন অল্প কিছুদিন। তাতে ক্রেতা খুব একটা মেলেনি। এবার করোনার মধ্যে ক্রেতা টানতে অধিকাংশ ফ্যাশন হাউসই মূল্যছাড় দিয়েছে। কেউ কেউ দিচ্ছে ৭০ শতাংশ পর্যন্ত মূল্যছাড়। তাতে বিক্রয়কেন্দ্রের পাশাপাশি অনলাইনেও বিক্রি বেড়েছে ফ্যাশন হাউসের।

ফ্যাশন এন্ট্রাপ্রেনিউরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (এফইএবি) বা ফ্যাশন উদ্যোগের সাবেক সভাপতি আজহারুল হক বলেন, বর্তমানে বেচাকেনা রোজার ঈদের থেকে ভালো। গত কোরবানির ঈদের তুলনায় ৪০ শতাংশ বিক্রি হচ্ছে। শেষ পর্যন্ত সেটি ৫০ শতাংশ হতে পারে। তবে যা হচ্ছে, সেটিকে আশাব্যঞ্জক বলতে হবে।

আজহারুল হক আরও বলেন, মূল্যছাড় দিয়ে ক্রেতা আকর্ষণের কারণ এখন লাভ-লোকসানের কিছু নেই। নগদ টাকা ওঠানোই লক্ষ্য। গত তিন মাসে সেই অর্থে কোনো বিক্রি ছিল না। দোকানভাড়া ও কর্মীদের বেতন দিতেই অনেকের পুঁজি শেষ হয়ে গেছে।

ফ্যাশন ব্র্যান্ড আড়ংয়ের প্রধান পরিচালন কর্মকর্তা (সিওও) মো. আশরাফুল আলম জানান, তাঁরা অনলাইনে নিবন্ধন করে ক্রেতাদের কেনাকাটার সুযোগ ও অন্যান্য নিরাপত্তাব্যবস্থা রাখছেন। এর মধ্যেও মোটামুটি ভালো বিক্রি হচ্ছে। গত বছর ঈদুল আজহার তুলনায় এবার ৬০ থেকে ৬৫ শতাংশ ক্রেতা দেখা যাচ্ছে। তিনি বলেন, পণ্য বিক্রি না হলেও আড়ং তার ৬৫ হাজার কারিগরের টাকা কখনো বকেয়া রাখে না। তবে এখন বিক্রি হওয়ায় সামনের দিনগুলোতে নতুন করে পণ্য তৈরির ফরমাশ দেওয়া যাবে।

বিক্রির ক্ষেত্রে মোটামুটি একই চিত্রের কথাই জানালেন আরেক ব্র্যান্ড ইয়েলোর হেড অব রিটেইল হাদী এস এ চৌধুরী। তিনি বলেন, গত ঈদুল ফিতরের চেয়ে এবার ঈদুল আজহায় বিক্রি অনেক ভালো। গত বছর ঈদুল আজহার তুলনায় এবার করোনার মধ্যে বিক্রি অনেক খারাপ হওয়ার কথা। কিন্তু ভালোই হচ্ছে।

নতুন ফ্যাশন ব্র্যান্ডের মধ্যে স্নোটেক্স গ্রুপের সহযোগী প্রতিষ্ঠান সারা লাইফস্টাইল কয়েক বছর ধরে ভালো করছে। বর্তমানে তাদের পাঁচটি বিক্রয়কেন্দ্র রয়েছে। তবে করোনার কারণে নতুন বিক্রয়কেন্দ্র খোলা আপাতত স্থগিত রেখেছে প্রতিষ্ঠানটি।

স্নোটেক্স গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এস এম খালেদ প্রথম আলোকে বলেন, পরিস্থিতি বিবেচনায় বর্তমানে বিক্রিবাট্টা খারাপ হচ্ছে না। গত কোরবানির চেয়ে এবার সমান বা কিছু বেশি বিক্রি হবে। আর গত রোজার ঈদে যে বিক্রি হয়েছিল, সেটিকে ইতিমধ্যেই ছাড়িয়ে যাওয়া সম্ভব হয়েছে। তিনি বলেন, বর্তমানে মোট বিক্রির ১০ শতাংশ অনলাইনে হচ্ছে।

জুতার বিক্রিও খারাপ না এ ঈদে। জানতে চাইলে বাটা শু বাংলাদেশের রিটেইল অপারেশন ম্যানেজার আরফানুল হক প্রথম আলোকে বলেন, ‘গত বছরের কোরবানির ঈদের তুলনায় এবার আমাদের বিক্রি ৭০ থেকে ৭৫ শতাংশ। আর গত রোজার ঈদের তুলনায় বেড়েছে ৫০ শতাংশের বেশি।’

এটা গেল ব্র্যান্ডের দোকানের কথা। গত সোমবার বিকেলে রাজধানীর মিরপুর ১০ নম্বর সেকশন থেকে ১ নম্বর সেকশন ঘুরে দেখা যায়, রাস্তার পাশের বুটিক শপ ও ফুটপাতের দোকানে ক্রেতার উপস্থিতি বেশ ভালো। বড় কথা হলো, বেশির ভাগ মানুষ কিনতেই বেরিয়েছেন। আগের মতো অকারণ ঘোরাঘুরিতে কেউ নেই।

হাজার হাজার মানুষের আনাগোনায় মনেই হয়নি দেশে করোনা মহামারিকাল চলছে। এতে খুশি ফুটপাতের বিক্রেতা জসিম উদ্দিন। তিনি বলেন, সাত-আট দিন ধরে বেশ ভালো বিক্রি করছেন। পুরোনো পণ্য বিক্রি করে নতুন করে গত সপ্তাহে পাইকারি বাজার থেকে কিনেছেন।

পাইকারি দোকানগুলো মূলত পুরান ঢাকার উর্দু রোডে। সেখানকার বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ পোশাক প্রস্তুতকারক সমিতির সভাপতি আলাউদ্দিন মালিক বলেন, বিক্রি গত বছরের তুলনায় ৫০ শতাংশ। দেশজুড়ে যদি বন্যা না হতো, তাহলে আরেকটু ভালো বিক্রির আশা করা যেত। তিনি বলেন, বছরের মূল বিক্রির সময় পয়লা বৈশাখ ও ঈদুল ফিতরে যে ক্ষতি হয়েছে, তা কাটিয়ে ওঠা সহজ নয়।

সাধারণ সময়ে প্রতি ঈদেই আসবাব বিক্রি ১০-১৫ শতাংশ বাড়ে। তবে করোনায় সব হিসাব ওলট-পালট হয়ে গেছে। গত মে মাসে সীমিত পরিসরে দোকানপাট খুললে কিছু বিক্রিবাট্টা হয়। তবে কোরবানির ঈদের আগে সেটি বেশ কিছুটা বেড়েছে বলে জানালেন ব্যবসায়ীরা।

জানতে চাইলে হাতিলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সেলিম এইচ রহমান প্রথম আলোকে বলেন, করোনার কারণে গত তিন মাসে যে বিক্রি হয়েছিল, তার তুলনায় বর্তমানে আসবাব বিক্রি ৫০ শতাংশ বেড়েছে। যা হচ্ছে, সেটিকে মন্দ বলা যাবে না। মানুষ মহামারির এই সময়েও স্বাভাবিক জীবনে অভ্যস্ত হতে শুরু করেছে এটিই বড় কথা। অনলাইনেও আসবাব বিক্রি হচ্ছে বলে জানালেন তিনি।

জাপানি ইয়ামাহা ব্র্যান্ডের মোটরসাইকেল উৎপাদনকারী ও বিপণনকারী এসিআই মোটরসের নির্বাহী পরিচালক সুব্রত রঞ্জন দাস বলেন, মোটরসাইকেলের চাহিদা বেশ ভালো। বরং চাহিদা অনুযায়ী পণ্য দেওয়া কঠিন হচ্ছে।

দেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে গত ২৬ মার্চ থেকে দোকানপাট ও বিপণিবিতান বন্ধ রাখা হয়। পরে স্বাস্থ্যবিধি মেনে ১০ মে থেকে দোকানপাট খুলে দেওয়া হয়। তখন সকাল ১০টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত খোলা রাখার অনুমতি ছিল। পরবর্তী সময়ে ৩০ জুন থেকে দোকানপাট খোলা রাখার সময়সীমা তিন ঘণ্টা বাড়ানোর অনুমতি দেয় জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। গতকাল থেকে সরকারের উচ্চপর্যায়ের নির্দেশে রাত নয়টা পর্যন্ত দোকানপাট ও বিপণিবিতান খোলা থাকছে।

ঈদকেন্দ্রিক কেনাবেচায় অর্থনীতি কি একটু হলেও ঘুরে দাঁড়াবে, জানতে চাইলে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সিপিডির গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম প্রথম আলোকে বলেন, স্বাস্থ্যঝুঁকি ও আয় অনিশ্চয়তা কিছুটা হ্রাস পাওয়ায় বেচাবিক্রিতে কিছুটা ইতিবাচক প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। যদিও সবার আয় আগের অবস্থায় ফেরেনি। অনেকেই ঈদে বোনাস পাননি। তারপরও অর্থনীতিতে গতি আসার ক্ষেত্রে ঈদকেন্দ্রিক বেচাকেনা কিছুটা হলেও সহায়তা করবে।