করোনার দারিদ্র্যে ঝুঁকিতে নিম্নবিত্ত মা ও শিশুরা

করোনার কাল যত দীর্ঘ হচ্ছে, বাড়ছে এর পারিপার্শ্বিক প্রভাবও। করোনাভাইরাসের বিস্তারে থেমেছে অর্থনীতির চাকা। যার প্রভাব পড়েছে নিম্নবিত্ত পরিবারে থাকা গর্ভবতী নারীদের জীবনে। সামাজিক সহযোগিতা ও অর্থের অভাবে বাড়ছে মা ও শিশুর ঝুঁকি।

কল্যাণপুর বস্তিতে বাস করেন ৩৪ বছর বয়সী ফাতেমা। সাত ফুট বাই সাত ফুট আকারের ছোট্ট একটি ঘরে বাবা, স্বামী ও আরেক সন্তান নিয়ে বসবাস তাঁর। গর্ভাবস্থার ১০ মাস চলছে ফাতেমার। তিনি নিজেই টের পাচ্ছেন শরীর খারাপের দিকে যাচ্ছে কিন্তু চিকিৎসকের কাছে যাওয়ার মতো টাকা নেই তাঁর কাছে। বললেন, ‘ভাত খাওনের টাকাই নাই, হাসপাতালে ক্যামনে যামু?’

ফাতেমার এটি দ্বিতীয় সন্তান। এর আগের সন্তান জন্ম দেওয়ার সময় ফাতেমা পেয়েছেন স্বাস্থ্যসেবা। করোনায় বস্তিতে আসেন না কোনো স্বাস্থ্যকর্মী। করোনার কারণে জীবিকা হারিয়ে ফাতেমা বা তাঁর পরিবারেরও সাধ্য নেই হাসপাতালে যাওয়ার। বিপদ হতে পারে জেনেও ঘরে বসে আছেন এই আশায়, বাচ্চা স্বাভাবিক নিয়মেই হবে। ‘বাচ্চাটা কয়দিন ধরে কম কম নড়তাসে। এইটা সমস্যা জানি। কিন্তু আল্লাহর কাছে দোয়া করা ছাড়া কিছুই করার নাই।’

করোনায় এই সংকট শুধু ফাতেমার নয়। মে মাসেই করোনায় অন্তঃসত্ত্বা ও শিশু জন্ম–সম্পর্কিত এক পূর্বাভাসে ইউনিসেফ জানায়, করোনায় যোগাযোগ কমে যাওয়া এবং স্বাস্থ্যসেবা ব্যাহত হওয়ায় বাংলাদেশে মে থেকে পরবর্তী ছয় মাসে প্রায় ২৮ হাজার শিশুর মৃত্যু হতে পারে। জনস্বাস্থ্যবিদ ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের করোনাবিষয়ক পাবলিক হেলথ অ্যাডভাইজারি কমিটির সদস্য আবু জামিল ফয়সাল বলেন, ‘চিকিৎসা সেবা অপ্রাপ্তির এই ঝুঁকির আশঙ্কা তো ছিলই। করোনার দরিদ্রতার কাছে এখন নতুন করে যুক্ত হচ্ছ গর্ভাবস্থায় খাদ্যের অপ্রাপ্তি এবং অপুষ্টি, যা মা ও শিশু মৃত্যুর ঝুঁকি বাড়িয়ে দিচ্ছে। যদিও বস্তি এলাকায় করোনা প্রকোপ কম, তবে অভাবজনিত অপুষ্টি তাঁদের বিদ্যমান সমস্যাগুলোকে আরও বাড়িয়ে তুলবে বলে আশঙ্কা করছি।’

করোনায় দেশে দারিদ্র্য কত বেড়েছে, এ বিষয়ে সম্প্রতি একটি গবেষণা করেছে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টার (পিপিআরসি) ও ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (বিআইজিডি)। যৌথ এ গবেষণায় দেখা যায়, করোনায় গ্রামের মানুষদের দৈনিক আয় ফেব্রুয়ারি থেকে এপ্রিলে ৭৯ শতাংশ কমে গেছে, শহরের বস্তি এলাকায় কমেছে ৮২ শতাংশ। পিপিআরসির চেয়ারম্যান হোসেন জিল্লুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘করোনায় সৃষ্ট দারিদ্র্যের ফলে আগে যারা দারিদ্র্যসীমার ওপরে ছিল, এমন পরিবারও দরিদ্রতায় পড়ছে আর যারা আগেই দারিদ্র্যসীমার ছিল, তাদের অবস্থা হয়েছে আরও শোচনীয়।’

পিপিআরসি ও বিআইজিডির গবেষণায় আরও দেখা যায়, শহর ও গ্রামের নিম্নবিত্ত পরিবারগুলোকে আয়ের সঙ্গে সমাঞ্জস্য রাখতে কমাতে হয়েছে খাওয়ার খরচও। শহরের বস্তি এলাকার মানুষরা শতকরা প্রায় ৪৭ ভাগ খাওয়া কমিয়েছেন আর গ্রামে তা কমেছে ৩২ শতাংশ। হোসেন জিল্লুর বলেন, ‘আমরা এখনো লিঙ্গভেদে এই চিত্র বের করতে পারিনি, তবে নিঃসন্দেহে এর প্রভাব নারীদের ওপরে বেশি।’

করোনার অতিমারি প্রভাব জাতীয় পর্যায়ে সেভাবে নিরূপণ না করা হলেও, মা ও শিশুর স্বাস্থ্যে বিরূপ প্রভাব ফেলবে বলেই বিশ্বাস বিশেষজ্ঞদের। যদি বিষয়টি আমলে এনে মোকাবিলা না করা হয়, জাতিসংঘের টেকসই লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে পিছিয়ে পড়তে পারে বাংলাদেশ।