ডিজিটাল হাটে পশুর বিক্রিবাট্টা

ডিজিটাল বিপণন
ডিজিটাল বিপণন

প্রতিবছর বড়দের সঙ্গে হাটে গিয়ে গরু কেনা ছিল রিফাত আলমের ছোটবেলায় ঈদের এক নম্বর চাওয়া। বড় হওয়ার পরও হাটে গিয়ে দেখেশুনে কোরবানির জন্য গরু কেনার কাজটি ভালোবেসেই করতেন রিফাত। কয়েক বছর হয়, পরিবার নিয়ে মরু শহর দুবাইয়ে বসবাস করছেন। কোরবানির ঈদ এলেই ফেসবুকে পশুর হাট ও গরুর ছবি দেখলেই নিজের অজান্তেই কষ্টে চোখটা ভিজে যেত। স্মৃতির পাতায় ভেসে আসত পুরোনো দিনের কথা। এবারও রিফাত আলামের চোখ ভিজে উঠেছে পানিতে। তবে এ পানি কষ্টের না, এ পানি আনন্দের।

রিফাত আলম বলছিলেন, ‘বিদেশে বসেই এবার পশুর ডিজিটাল মাধ্যমে ক্লিকে ক্লিকে হাট ঘুরে ঘুরে কেনার স্বাদ পেয়েছি। অনেক দিন পর মনে হয়েছে ছোটবেলায় ফিরে গেছি। কী যে ভালো লেগেছে, তা বলে প্রকাশ করা যাবে না।’

ভালো লাগার এ অনুভূতিকে নিজের চোখের সামনে অনুভব করা সুযোগ করে দিয়েছে ডিজিটাল হাট। শুধু রিফাত আলমই নন, প্রযুক্তির এ সুবিধা ব্যবহার করে দেশ-বিদেশের লাখ লাখ মানুষ ডিজিটাল হাটে পছন্দের পশু কেনার সুযোগ পেয়েছেন।

ই-হাট
অনলাইনে কীভাবে পশুর হাট সম্ভব? এ প্রশ্নের জবাবে ই-কমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ই-ক্যাব) সাধারণ সম্পাদক আবদুল ওয়াহেদ তমাল বললেন, ‘প্রযুক্তির উৎকর্ষের কারণে সবকিছু আরও সহজভাবে করা সম্ভব হচ্ছে। এবার কোরবানির ঈদকে সামনে রেখে আমরা ডিজিটাল হাটের ব্যবস্থা করেছি। ডিজিটাল হাট মানে যে হাটে অনলাইনের মাধ্যমে পশুর দেখে-শুনে–বুঝে তারপর কেনার সুযোগ পাচ্ছে ক্রেতারা।’

কোরবানি ঘিরে দেশের লাখ লাখ মানুষের জীবিকা নির্ভর করে। তাই বর্তমানে করোনা পরিস্থিতিতেও ডিজিটাল পদ্ধতিতে, অর্থাৎ ই-কমার্সের মাধ্যমে কেনাবেচাকে সচল রাখা এবং দেশব্যাপী অনলাইনে পশু কেনাকাটার প্রতি মানুষের আস্থা গড়ে তোলার জন্য এ ডিজিটাল হাট। এর ফলে দেশের ক্রেতারা নতুন একটা বিষয়ের সঙ্গে পরিচয় হচ্ছে।

ই-ক্যাব সূত্রে জানা গেছে, ৩০ জুলাই রাত পর্যন্ত ডিজিটাল হাট থেকে প্রায় ২৭ হাজার কোরবানির পশু বিক্রি হয়েছে।

আবদুল ওয়াহেদ বলেন, ‘ডিজিটাল হাটে পশুর দাম কত হবে, ক্রেতা কীভাবে পশুর দাম শোধ করবে, অনলাইনে যেটা দেখানো সেই পশুটিই ক্রেতাকে দেওয়া হচ্ছে কি না, এ বিষয়গুলোসহ বিভিন্ন বিষয়ে আস্থা অর্জনেই ছিল আমাদের এ বছরের লক্ষ্য। গত কয়েক দিনের অভিজ্ঞতার আলোকে বলতে পারি, ক্রেতা-বিক্রেতার আস্থা আস্তে আস্তে অর্জন করছি আমরা।’

এক ভার্চুয়াল হাটে
ই-ক্যাবের সাধারণ সম্পাদক আবদুল ওয়াহেদ বলেন, ‘আমার মা আমাকে বেশ কয়েকবার জিজ্ঞেস করল আমি কি গরুর ব্যবসা করছি? আম্মুকে বুঝিয়ে বললাম, আমি নতুন করে গরুর ব্যবসা শুরু করিনি, আমরা চেষ্টা করছি যাতে এ দেশের লাখো খামারি–উদ্যোক্তা অনলাইনে গরু বিক্রি করতে পারেন এবং ন্যায্য দাম পান। করোনা পরিস্থিতিতে ক্রেতাদের হাটে গিয়ে পশু কিনতে না হয়, যাতে ঘরে বসে থেকেই নিরাপদে কোরবানির গরু কেনা এবং কসাই সেবাসহ ই-কমার্সের মাধ্যমে মাংস হোম ডেলিভারির সেবা পায়। তাই পুরো আয়োজনটাকে বলা যায় এক ভার্চ্যুয়াল হাট।’

আরও বেশি সুরক্ষিত
করোনাভাইরাস থেকে পরিবারকে আরও বেশি সুরক্ষিত রাখতে এবং মানুষের স্বাস্থ্যঝুঁকির কথা চিন্তা করে ই-ক্যাব ও ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন কোরবানি পশুর বিশাল সমারোহ নিয়ে বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো আয়োজন করেছে ডিজিটাল হাট। এ হাটে ঘরে বসেই পশু কেনার সুযোগ রয়েছে। এর ফলে সংক্রামিত হওয়ার সুযোগ বহুলাংশেই কমে গেছে।

হুড়োহুড়ির বদলে ক্লিকে ক্লিকে
পশুর হাট মানেই হুড়োহুড়ি। ক্রেতা-বিক্রেতার দর-কষাকষি। দামাদামি করে সবচেয়ে ভালো কেনার সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা। কয়েক বছর ধরে বদলের হাওয়া লেগেছে কোরবানির পশু কেনার ক্ষেত্রে। হুড়োহুড়ির বদলে এখন প্রযুক্তি ব্যবহার করে ক্লিকে ক্লিকে গরু কেনার সুযোগ পাচ্ছেন ক্রেতারা। আর বিক্রেতারাও পাচ্ছেন ন্যায্যমূল্য। এতে দুই পক্ষেরই লাভ।

নতুন সুযোগ
কোরবানির ঈদের আগে কান পাতলেই রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে হুররে, হাম্বা আর হাঁকডাকের আওয়াজ কানে আসত। রাস্তাঘাটেও এর প্রভাব পড়ত। কিন্তু এবার করোনার কারণে ভিন্ন পরিবেশ। করোনাভাইরাস সংক্রমণের ঝুঁকির কারণে দেশের অনেক জায়গায়ই আয়োজন করা হচ্ছে না পশুর হাটের। তাই বলে তো আর কোরবানি বন্ধ থাকতে পারে না। ফলে পশুর হাট হাজির হয়েছে ভার্চ্যুয়াল দুনিয়ায়। পশু বিক্রির নতুন সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে এতে। আগেও অনলাইনে পশুর বিকিকিনি ছিল, কিন্তু এবারের মতো এতটা নয়। ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি অনেকেই ফেসবুকে পেজ খুলে পশু বিক্রি করছেন।

নতুন সাজে ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান
ব্যস্ততা ও ভোগান্তি এড়াতে নগরজীবনে কোরবানির পশু বেচাকেনার আয়োজনে এবার তুমুল ব্যস্ত ই-কমার্স সাইটগুলো। ঘরে বা অফিসে বসেই গ্রাহকদের পছন্দের পশু কেনাকাটার সুযোগ দিতে কোরবানির এই ভর মৌসুমে নতুন রূপে সেজেছে ওয়েবসাইটগুলো। অনলাইনে খামারির কাছ থেকে কোরবানির পশু কিনতে এবং ক্রেতার কাছে বিক্রি করতেও বাহারি সব অফার নিয়ে এরই মধ্যে হাজির তারা। পাশাপাশি গরু-খাসি বিক্রির জন্য খোলা হয়েছে নতুন ফেসবুক পেজও। এসব পেজ ও ওয়েবসাইটে বিভিন্ন দামের গরু, ছাগল, ভেড়ার ছবি, বিবরণ ও দাম দেওয়ার পাশাপাশি সেগুলো কোথাকার, তা-ও উল্লেখ করা হয়েছে। ঈদুল আজহা উপলক্ষে ভার্চ্যুয়াল এই পশুর হাটে গরু-ছাগলের ছবিসহ অনেক ক্ষেত্রে ভিডিও দেখারও সুযোগ রয়েছে। একই সঙ্গে জানা যাচ্ছে গরুর আকার, ওজন এবং সম্ভাব্য মাংসের পরিমাণও।

ঝামেলাহীন
ঝামেলাহীন কিছু কম দামে অনলাইনে পশু কেনার সুযোগ রয়েছে ক্রেতাদের। এর ফলে সাধারণ হাটের চেয়ে ই-কমার্স শপগুলোয় দাম কম হওয়ায় বেচাকেনা তিন গুণ বেড়েছে। ডিজিটাল হাট থেকে কোরবানির পশু কিনলে হাসিল লাগে না। নগদ টাকা বহন করা ঝামেলা নেই। অনলাইনেই টাকা পরিশোধ করা যায়। ধর্মীয় নিয়ম মেনে প্যাকেজিং করে বাসায় পৌঁছে দেওয়ার সুযোগ দিয়েছে ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলো। রয়েছে কসাইয়ের ব্যবস্থাও। এ ছাড়া হাটে না গিয়ে অনলাইনেই পরিজনের পছন্দে গরু কেনায় স্বাচ্ছন্দ্য তো রয়েছেই। ডিজিটাল হাটের পশুর ডিজিটাল স্কেলে ওজন মাপার ব্যবস্থা রয়েছে। রয়েছে স্বাস্থ্য পরীক্ষা করার সুযোগ। সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো পশু কেনার পর কোরবানি দেওয়া পর্যন্ত দামের ১০ থেকে ২৫ শতাংশ পরিশোধ করলে খামারে রাখার ব্যবস্থা রয়েছে।

কেমন হচ্ছে বেচাকেনা
দারাজের হেড অব ইকুইজিশন সাইমুন সানজিদ চৌধুরী বলেন, ‘আমাদের বেশ কিছু মার্চেন্ট থেকে বাছাই করে আমরা শুধু ন্যায্যমূল্যে যারা গরু দিতে পারবে, তাদের কাছ থেকে গরু নিচ্ছি। ফলে আমরা গরুর দাম ক্রেতাদের নাগালের মধ্যে রাখতে পেরেছি। তাই আমাদের বিক্রিও বেশ ভালো।’ অনলাইন হাট হলেও ক্রেতাদের সুবিধার কথা মাথায় রেখে সবকিছু ঠিক করেছে প্রতিষ্ঠানগুলো।

‘দেশীগরু বিডি’র প্রধান নির্বাহী টিটু রহমান বলেন, ‘প্রথাগত হাটের সঙ্গে পার্থক্য গড়তে হলে অবশ্যই দাম এবং মান দুটোকে প্রাধান্য দিতে হবে। আমরা সে লক্ষ্যে কাজ করছি। আমরা হাটের চেয়ে একই মাপের গুরু তুলনামূলক কিছুটা কম দামে বিক্রি করছে। ফলে প্রতিদিন আমাদের বিক্রির হার বাড়ছে।’