বাড়ছে কাজুবাদামের ফলন, বাড়ছে নতুন উদ্যোক্তা

দাম না পেয়ে একসময় কাজুবাদামের গাছ কেটে ফেলেছিলেন পাহাড়ের অনেক কৃষক। সময়ের ব্যবধানে এখন সেই কাজুবাদাম চাষেই বেশি আগ্রহ তাঁদের। আর তাতে বছর ঘুরতেই পাহাড়ে বাড়ছে কাজুবাদামের ফলন।

এদিকে কাজুবাদাম প্রক্রিয়াজাতের কোনো প্রতিষ্ঠান বা কারখানা ছিল না বছর পাঁচেক আগেও। চট্টগ্রামের উদ্যোক্তা শাকিল আহমেদের হাত ধরে এখন প্রক্রিয়াজাত কারখানা গড়ে তুলছেন নতুন নতুন উদ্যোক্তারা। এসব কারণে অপ্রচলিত কৃষিপণ্যটি দেশীয় চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি রপ্তানির সম্ভাবনাও দেখাচ্ছে।

পাহাড়ি এলাকায় অনাবাদি বা পতিত জমিতে কাজুবাদাম চাষের সম্ভাবনা দেখে কৃষি মন্ত্রণালয় কাজুবাদামের আবাদ বাড়াতে মাঠপর্যায়ে কৃষকদের প্রশিক্ষণ ও সহায়তা দিচ্ছে। প্রক্রিয়াজাত কারখানার উদ্যোক্তাদের নীতিসহায়তাও দিচ্ছে মন্ত্রণালয়। উদ্যোক্তারা আশা করছেন, পরিকল্পনা অনুযায়ী আবাদ এবং কারখানা গড়ে তোলা গেলে রপ্তানি আয়ে ভালো সম্ভাবনা দেখাবে এই অপ্রচলিত কৃষিপণ্য।

জানতে চাইলে কৃষিমন্ত্রী মো. আব্দুর রাজ্জাক গত বৃহস্পতিবার প্রথম আলোকে বলেন, কৃষিপণ্য বহুমুখীকরণের যে পদক্ষেপ সরকার নিয়েছে, তাতে কাজুবাদামকে সম্ভাবনাময় ফসল হিসেবে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। কৃষি মন্ত্রণালয় কাজুবাদাম আবাদের জন্য চারা লাগানোসহ কৃষকদের সহায়তা করছে। আবার প্রক্রিয়াজাত কারখানার উদ্যোক্তাদের নীতিসহায়তা দিচ্ছে।

ফলন বাড়ছে

পার্বত্য এলাকায় বহু আগেই কাজুবাদামের ফলন হতো। কাঁচা কাজুবাদাম থেকে খোসা ছাড়িয়ে প্রক্রিয়াজাত করার মতো কারখানা না থাকায় এই বাদামের কদর ছিল না। ২০১০ সালে পাহাড়ে বেড়াতে গিয়ে চট্টগ্রামের উদ্যোক্তা শাকিল আহমেদের চোখে পড়ে এই বাদাম। ২০১০-১১ অর্থবছরে কাঁচা কাজুবাদামের একটি চালান রপ্তানির পরই কদর পেতে থাকে ফলনটি।

এরপর কৃষকেরা চাষে আগ্রহী হন। ধীরে ধীরে ফলন বাড়তে থাকে। ২০১৮ সালে যেখানে ৯৬২ টন ফলন হয়, সেখানে ২০২০ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ১ হাজার ৩২৩ টনে। অর্থাৎ ৩ বছরের ব্যবধানে ফলন বেড়েছে ৩২ শতাংশ।

তিন পার্বত্য জেলার মধ্যে মূলত বান্দরবানে সবচেয়ে বেশি কাজুবাদামের ফলন হয়। আর খাগড়াছড়ি ও রাঙামাটিতে সামান্য পরিমাণে
আবাদ হয়।

বান্দরবান পার্বত্য জেলার কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক এ কে এম নাজমুল হক প্রথম আলোকে বলেন, বান্দরবানে এখন ৮ লাখ ৬৯ হাজার কাজুবাদামের গাছ রয়েছে। প্রতিবছরই গাছের সংখ্যা বাড়ছে। তাই এখন যে উৎপাদন হচ্ছে, তা প্রতিবছর ধারাবাহিকভাবে বাড়বে।

কৃষি মন্ত্রণালয় জানায়, কাজুবাদামের চাষ ছড়িয়ে দিতে গত মাসে ৫০ হাজার কাজুবাদামের চারা সংগ্রহের দরপত্র আহ্বান করা হয়েছে। ভারত বা ভিয়েতনাম থেকে এনে এই চারা লাগানো হবে। পার্বত্য এলাকার পাশাপাশি বরেন্দ্র অঞ্চলেও কাজুবাদাম চাষের প্রক্রিয়া চলছে।

>

২০১৬ সালে দেশে প্রথম কাজুবাদাম প্রক্রিয়াজাত কারখানা গড়ে ওঠে
এরপর গড়ে উঠেছে আরও দুটি

বান্দরবানের রুমা সদর ইউনিয়নের লিয়ান কম বম প্রথম আলোকে বলেন, ‘ফলন ভালো হয়েছে। তবে করোনার কারণে অন্য সময়ের তুলনায় এবার দাম কম ছিল। আশা করছি, আগামী বছর ভালো দাম পাব।’

উদ্যোক্তা যাঁরা

দেশে কাজুবাদাম প্রক্রিয়াজাত করার প্রথম সমন্বিত কারখানা গড়ে তোলেন উদ্যোক্তা শাকিল আহমেদ। কারণ, কাঁচা কাজুবাদাম রপ্তানির চেয়ে প্রক্রিয়াজাত বাদামে মূল্য সংযোজন বেশি। চট্টগ্রামের পতেঙ্গার ডেইলপাড়ায় ২০১৬ সালে তিনি গড়ে তোলেন গ্রিনগ্রেইন কেশিও প্রসেসিং ইন্ডাস্ট্রি। শাকিল আহমেদের পর ২০১৭ সালে নীলফামারীতে জ্যাকপট কেশোনাট ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড নামের কারখানা গড়ে তোলেন উদ্যোক্তা মো. শামীম আজাদ। শুরুতে সীমিত আকারে চললেও গত বছর থেকে পুরোদমে কাজুবাদাম প্রক্রিয়াজাত শুরু করেন এই উদ্যোক্তা।

জানতে চাইলে শামীম আজাদ প্রথম আলোকে বলেন, দেশে খুব দ্রুত চাহিদা বাড়ছে। আবার রপ্তানির সম্ভাবনাও অনেক। স্থানীয়ভাবে বাজারজাতের পাশাপাশি এখন রপ্তানিরও চেষ্টা করছেন তিনি।

এ ছাড়া ২০১৮ সালে চট্টগ্রামের কর্ণফুলী উপজেলায় টু এইচ ফ্রুট ইন্ডাস্ট্রি নামে কাজুবাদামের কারখানা গড়ে তুলেছেন দুজন উদ্যোক্তা। কারখানাটির অন্যতম উদ্যোক্তা এস এম ইয়াকুব প্রথম আলোকে বলেন, করোনার কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছি। তারপরও এই কৃষিপণ্যের সম্ভাবনা অনেক। 

রপ্তানি ও অভ্যন্তরীণ বাজারের সম্ভাবনা দেখে এই খাতে যুক্ত হয়েছে ইস্পাত খাতের প্রতিষ্ঠান বিএসআরএম গ্রুপ। গ্রুপটি গত বছর থেকে পাহাড়ে কৃষকদের প্রশিক্ষণ ও সহায়তা দিয়েছে। আবার সদ্য শেষ হওয়া মৌসুমে গ্রুপটি ১০০ টনের বেশি কাঁচা কাজুবাদাম সংগ্রহ করেছে। এখন কারখানা গড়ে তোলার লক্ষ্যে কাজ করছে।

জানতে চাইলে বিএসআরএম গ্রুপের হেড অব করপোরেট স্ট্র্যাটেজি অ্যান্ড প্রজেক্ট মনির হোসেন  বলেন, সরকার আবাদ, প্রক্রিয়াজাত ও রপ্তানিতে বেশ গুরুত্ব দিচ্ছে। সরকারের সহযোগী হয়ে বিএসআরএম গ্রুপ কারখানা গড়ে তুলতে চায়।

উদ্যোক্তারা জানান, যশোরেরও একজন ব্যবসায়ী কাজুবাদাম কারখানা গড়ে তোলার উদ্যোগ নিয়েছেন। এ ছাড়া রাঙামাটি ও খাগড়াছড়িতেও কয়েকজন ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা কাজুবাদাম প্রক্রিয়াজাত করার উদ্যোগ নিয়েছেন।

বাধা যেখানে

দেশীয় উদ্যোক্তারা পার্বত্য এলাকা থেকে কাঁচা কাজুবাদাম সংগ্রহ করেন। বছরে একবার ফলন হওয়ায় একসঙ্গে পুরো বছরের বাদাম সংগ্রহে করতে হয়। ফলন বাড়লেও এখনো চাহিদার তুলনায় উৎপাদন কম। এ জন্য কিছু উদ্যোক্তা কাঁচা কাজুবাদাম আমদানি করে প্রক্রিয়াজাত করতে চাইছেন।

এ ক্ষেত্রে উদ্যোক্তারা ভিয়েতনামের উদাহরণ দিচ্ছেন। কাজুবাদাম রপ্তানিতে শীর্ষ দেশ ভিয়েতনাম বছরে ১৫ লাখ টন কাঁচা কাজুবাদাম আমদানি করে। আবার নিজেদের উৎপাদিত কাঁচা কাজুবাদামও প্রক্রিয়াজাত করে রপ্তানি করে।

তবে এ দেশে কাঁচা কাজুবাদাম ও প্রক্রিয়াজাত কাজুবাদামের শুল্ককর একই। এখন যেহেতু উদ্যোক্তারা কারখানা গড়েছেন, সে জন্য তাঁরা চাইছেন দেশীয় উদ্যোক্তাদের স্বার্থে শুল্কবৈষম্য দূর করা হোক। এ জন্য কৃষি মন্ত্রণালয়ও গত মার্চে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআর) চিঠি দেয়। তবে এনবিআরের পক্ষ থেকে এখনো কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি।

এ খাতে আরেক বাধা হলো, প্রক্রিয়াজাত কাজুবাদামের শুল্কায়ন মূল্য এখনো অনেক কম। কাজুবাদাম কারখানার প্রথম উদ্যোক্তা শাকিল আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, ভিয়েতনামের মতো শূন্য শুল্কে কাঁচা কাজুবাদাম আমদানির সুযোগ দেওয়া উচিত উদ্যোক্তাদের। আবার প্রক্রিয়াজাত কাজুবাদাম আমদানিতে শুল্ককর বাড়ানো ও দাম কম দেখানোর অবৈধ সুযোগ বন্ধ করতে হবে। তাহলে উদ্যোক্তারাই এই খাতকে এগিয়ে নিতে পারবেন।