বিদেশি বিনিয়োগ কমে গেল!

তিন অর্থবছর পর বিদেশি বিনিয়োগ কমে গেছে
তিন অর্থবছর পর বিদেশি বিনিয়োগ কমে গেছে

টানা তিনটি অর্থবছর প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ প্রবাহ বাড়ার পর আবার তা কমে গেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের লেনদেনের ভারসাম্য সারণির হালনাগাদ পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায় যে গত অর্থবছর শেষে দেশে মোট প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৫৫ কোটি ডলার। আর ২০১২-১৩ অর্থবছর শেষে তা ছিল ১৭৩ কোটি ডলার।
এর ফলে তিন অর্থবছর পর বিদেশি বিনিয়োগ আবার কমে গেল। অবশ্য গত অর্থবছরের বিদেশি বিনিয়োগের যে উপাত্তটি পাওয়া যাচ্ছে, তা প্রাথমিক প্রাক্কলন। বিদেশি বিনিয়োগের হিসাবটি চূড়ান্ত হবে আরও কিছুদিন পর যখন বাংলাদেশ ব্যাংক এ-সংক্রান্ত ষাণ্মাসিক জরিপ সম্পন্ন করবে।
অন্যদিকে অর্ধযুগের বা ছয় বছরের বিনিয়োগপ্রবণতা বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে ছয় বছরের ব্যবধানে দেশে প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ বেড়েছে প্রায় ৬২ শতাংশ। আর এই ছয় বছরের মধ্যে শেষ তিন অর্থবছরে বিদেশি বিনিয়োগ শতকোটি ডলারের ওপর চলে গেছে।
মূলত ২০১১-১২ অর্থবছরে ১১৯ কোটি ৪৮ লাখ ডলারের বিদেশি বিনিয়োগ আসার পর ২০১২-১৩ অর্থবছরে তা বেড়ে হয় ১৭৩ কোটি ডলার। ধারণা করা হয়েছিল যে এই ধারাবাহিকতায় ২০১৩-১৪ অর্থবছরে তা ২০০ কোটি ডলার ছাড়িয়ে যাবে। বাস্তবে তা হয়নি, বরং কিছুটা কমে গেছে।
দেশে গত অর্থবছরের প্রথমার্ধে (জুলাই-ডিসেম্বর, ২০১৩) বড় ধরনের রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা ছিল। নির্বাচন সামনে রেখে দেশজুড়ে সহিংসতার বিস্তার ঘটেছিল। এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে বিনিয়োগ পরিস্থিতির ওপর।
প্রাথমিকভাবে বাংলাদেশ ব্যাংকের লেনদেন ভারসাম্য সারণির তথ্য থেকে দেখা যায়, গত অর্থবছরের প্রথমার্ধে (জুলাই-ডিসেম্বর) দেশে প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ এসেছিল ৮৪ কোটি ডলারের। তবে পরের ছয় মাসে (জানুয়ারি-জুন) তা কিছুটা কমে হয় ৭০ কোটি ডলার।
অবশ্য পঞ্জিকা বছর হিসেবে ২০১৩ সালে বিদেশি বিনিয়োগ বেড়েছে। জাতিসংঘের বাণিজ্য ও উন্নয়ন সংস্থার (আঙ্কটাড) তথ্যানুসারে, ২০১৩ সালে বাংলাদেশে ১৫৯ কোটি ৬০ লাখ ডলারের বিদেশি বিনিয়োগ এসেছিল, যা ২০১২ সালের তুলনায় ২৪ শতাংশ বেশি। পঞ্জিকা বছর ও অর্থবছরের পরিসংখ্যানে বরাবরই কিছু ব্যবধান দেখা দেয়।
কয়েক দিন আগে মেট্রোপলিটন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (এমসিসিআই) গত অর্থবছরের শেষ প্রান্তিকের অর্থনৈতিক পর্যালোচনা প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। এতে বিদেশি বিনিয়োগ প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, ‘মনে হচ্ছে বিনিয়োগকারীরা এখনো আস্থা ফিরে পাননি। তাঁরা আরেকটি রাজনৈতিক অস্থিরতার আশঙ্কা করছেন। মূলত ২০১৩ সাল থেকেই বিনিয়োগকারীরা নতুন বিনিয়োগের ক্ষেত্রে ধীরে চলো নীতি অবলম্বন করছেন।’
এমসিসিআই মনে করে, বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণ করার জন্য বিদ্যমান সুবিধা ও প্রণোদনাগুলো অব্যাহত রাখলেই হবে না, তা বাড়াতে হবে।
বিনিয়োগ বোর্ড সূত্রে জানা যায়, বাংলাদেশে বিনিয়োগের খাতও অবারিত। পাঁচটি খাতে বিদেশি বিনিয়োগ নিষিদ্ধ। এগুলো হলো: প্রতিরক্ষা, আণবিক শক্তি, সংরক্ষিত বনভূমি এবং টাঁকশাল ও রেল। বাংলাদেশে বিনিয়োগ করার ক্ষেত্রে ১৭টি খাতে কর অবকাশ-সুবিধা রয়েছে, যা ২০১৫ সাল পর্যন্ত কার্যকর। আবার আর্থিক দিক থেকে বা মুনাফা প্রত্যাবাসনের ক্ষেত্রেও বিধিবিধান যথেষ্ট শিথিল।
এমসিসিআই আরও বলেছে, উচ্চ সুদের হার ও জটিল করব্যবস্থা বিনিয়োগকে বাধাগ্রস্ত করছে। কাজেই এগুলোকে যৌক্তিক করতে হবে। বিনিয়োগ বোর্ড যে এককেন্দ্রিক সেবা (ওয়ান স্টপ সার্ভিস) চালু করেছে, তাকে অর্থবহ করতে হবে। এ জন্য বোর্ডকে শক্তিশালী করা দরকার যেন বিনিয়োগসংশ্লিষ্ট অন্য প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর তার একটা প্রভাব থাকে। একইভাবে সরকারি-বেসরকারি অংশীদারি (পিপিপি) ও প্রস্তাবিত অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ পৃথকভাবে না করে এই বোর্ডের আওতায় রাখা প্রয়োজন।
মেট্রো চেম্বার দুর্বল অবকাঠামো ও অপর্যাপ্ত গ্যাস-বিদ্যুৎ সরবরাহ পরিস্থিতির উন্নতি ঘটানোর ওপরও জোর দিয়েছে। একই সঙ্গে জোর দিয়েছে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও সুশাসনের ওপর।
যোগাযোগ করা হলে আমেরিকান চেম্বার অব কমার্স (অ্যামচেম) ইন বাংলাদেশের সভাপতি আফতাব-উল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘বাংলাদেশে যে বিপুল পরিমাণ বিদেশি বিনিয়োগ আসা উচিত তার সামান্যই আসছে। এর জন্য দায়ী মূলত সুশাসনের ঘাটতি। আর বিনিয়োগ কমে যাওয়ার পেছনে রয়েছে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার অভাব। দেশি বিনিয়োগকারীরাই যেখানে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করছে না, সেখানে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা কেন এগিয়ে আসবে, তা ভাবা দরকার।’
আফতাব-উল ইসলাম আরও বলেন, অবকাঠামো বা গ্যাস-বিদ্যুৎ ঘাটতির কথা যতটা বলা হচ্ছে, প্রকৃত সমস্যা ততটা নয়। এসব সমস্যা কাটিয়ে ওঠা সম্ভব যদি সুশাসন ও স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা যায় তাহলে বিদেশি বিনিয়োগ বাড়বে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বরে সন্ত্রাসী হামলার পর থেকে বিশ্বজুড়েই বিদেশি বিনিয়োগের লক্ষ্য ও বিবেচনা বদলে গেছে। কত দ্রুত কতটা বিনিয়োগ তুলে নেওয়া যাবে বা মুনাফা করা যাবে। তার চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ হলো কতটা নিরাপদভাবে বিনিয়োগ ধরে রাখা যায়। বিনিয়োগকারীদের কাছে স্থিতিশীলতা ও নিরাপত্তা তাই অধিক গুরুত্বপূর্ণ।
বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধার পাশাপাশি ইউরোপীয় ইউনিয়ন, কানাডা, জাপান, অস্ট্রেলিয়াসহ প্রায় সব উন্নত দেশে বাংলাদেশি পণ্য এখন শুল্কমুক্ত বাজার-সুবিধা পাচ্ছে। তার মানে বাংলাদেশে বিনিয়োগ করে এসব দেশে রপ্তানি করলে বাজার-সুবিধা পাওয়া যাবে। শুধু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এই সুবিধা নেই। আবার ৩২টি দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের দ্বিপক্ষীয় বিনিয়োগ চুক্তি রয়েছে। আরও আটটি দেশের সঙ্গে তা করার প্রক্রিয়া চলছে। একইভাবে ২৮টি দেশের সঙ্গে দ্বৈত কর পরিহার চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। আরও ২১টি দেশের সঙ্গে তা সম্পাদনের কাজ চলছে। এই চুক্তি কার্যকর থাকলে বিদেশি বিনিয়োগকারীকে যেকোনো একটি দেশে আয়কর দিলেই চলে।
অবশ্য গত অর্থবছরের বিদেশি বিনিয়োগের খাতওয়ারি বিশ্লেষণ এখনো পাওয়া যায়নি। তবে তার আগের পাঁচ বছরের বিদেশি বিনিয়োগের কাঠামো পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে এই বিনিয়োগের ৪৫ শতাংশ হলো নতুন পুঁজি। আর যে নতুন পুঁজি এসেছে, তার কিছু বিদ্যমান কোম্পানি এনেছে। তবে বেশির ভাগ পুঁজিই এসেছে নতুন বিনিয়োগের কারণে। মোট বিনিয়োগের ৪১ শতাংশ হলো দেশে ব্যবসারত বিদেশি ও বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর চলমান আয় ও মুনাফা থেকে পুনর্বিনিয়োগ। আর ১৪ শতাংশ হলো কোম্পানিগুলোর ঋণ।
বিনিয়োগের খাত হিসেবে অগ্রাধিকারে রয়েছে বস্ত্র, ব্যাংকিং ও টেলিযোগাযোগ। যদিও পাঁচ বছরের মধ্যে কোনো কোনো বছরে এর অবস্থান কিছুটা অদল-বদল হয়েছে। যেমন ২০০৮-০৯ ও ২০০৯-১০ অর্থবছরে টেলিযোগাযোগ খাতে বড় ধরনের বিনিয়োগ এলেও পরের দুই বছর তা হয়নি। তবে গত অর্থবছরে আবার এই খাতে বিদেশি বিনিয়োগ বেড়েছে। বিপরীতে প্রথম দুই বছরে ব্যাংকিং খাতে বিনিয়োগ যে পরিমাণ এসেছে, পরের তিন বছর তা ক্রমাগত বেড়েছে। তবে বস্ত্র ও তৈরি পোশাক খাতে বিদেশি বিনিয়োগ গত পাঁচ বছরে ধারাবাহিকভাবে বেড়েছে। লক্ষণীয় বিষয় হলো, জ্বালানি খাতে বিদেশি বিনিয়োগ উল্লিখিত তিন খাতের তুলনায় তেমন বাড়েনি। ২০১০-১১ ও ২০১১-১২ অর্থবছরেই ১০ কোটি ডলারের বেশি করে বিনিয়োগ এসেছিল। আগে-পরের বছরগুলোয় তা আবার বেশ কম ছিল।
 দেশে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে
 তিন অর্থবছর পর বিদেশি বিনিয়োগ কমে গেছে
 ছয় বছরের ব্যবধানে দেশে প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ বেড়েছে প্রায় ৬২ শতাংশ
 বাংলাদেশ থেকে মুনাফা প্রত্যাবাসনের ক্ষেত্রে বিধিবিধান যথেষ্ট শিথিল
 এ দেশে বিনিয়োগ করলে বিভিন্ন দেশে পণ্য রপ্তানিতে বাজার-সুবিধা পাওয়া যায়
‘‘অবকাঠামো বা গ্যাস-বিদ্যুৎ ঘাটতির কথা যতটা বলা হচ্ছে, প্রকৃত সমস্যা ততটা নয়। এসব সমস্যা কাটিয়ে ওঠা সম্ভব যদি সুশাসন ও স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা যায়। তাহলে বিদেশি বিনিয়োগ বাড়বে
আফতাব-উল ইসলাম
সভাপতি, অ্যামচেম, বাংলাদেশ