বড় বড় আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কাছে বিশ্ব অর্থনীতি জিম্মি

লুকা টি কাটসেলি, গ্রিসের সাবেক অর্থমন্ত্রী। বর্তমানে ন্যাশনাল অ্যান্ড কাপোডিডিস্ট্রিয়ান ইউনিভার্সিটি অব এথেন্সের অর্থনীতির অধ্যাপক। গত সপ্তাহে বাংলাদেশে এসেছিলেন। তখন প্রথম আলোকে কিছুটা সময় দিয়ে কথা বলেছেন বৈশ্বিক আর্থিক বাজার ও রাজস্বনীতির বিভিন্ন দিক নিয়ে

লুকা টি কাটসেলি
লুকা টি কাটসেলি

প্রথম আলো: বাংলাদেশ মধ্য আয়ের দেশের কাতারে উন্নীত হওয়ার আশা করছে ২০২১ সালের মধ্যে। এই উন্নয়নযাত্রায় প্রধান চ্যালেঞ্জ কী কী বলে মনে করেন?
লুকা কাটসেলি: উন্নয়নের জন্য অবকাঠামো, মানবসম্পদ, প্রযুক্তি ও ব্যবসায় যোগাযোগ বাড়াতে হবে। ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা বড় আকারের প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে যেন টিকে থাকতে পারে, এমন পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। একেক দেশের একেক রকম সমস্যা। বাংলাদেশে এসে আমি দেখতে পেলাম যানজট এখানে একটি বিরাট সমস্যা। মানুষের আয়সীমা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এ সমস্যা আরও বাড়বে। কাজেই এটা নিয়ে কাজ করতে হবে। অবকাঠামো খাতের উন্নতি ঘটাতে হবে। এর সঙ্গে উৎপাদন থেকে শুরু করে সব খাতের কর্মদক্ষতার উন্নতির বিষয়টি জড়িত। এ জন্য সরকারি-বেসরকারি উভয় ধরনের অর্থায়নই প্রয়োজন। অর্থায়নের পাশাপাশি সুশাসন নিশ্চিত করাও জরুরি।
প্রথম আলো: বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) বালি ঘোষণার এক বছর হতে যাচ্ছে। খাদ্যনিরাপত্তা ও কৃষি ভর্তুকিতে ভারতের আপত্তিও মেনে নেওয়া হয়েছে। তাহলে কি দোহা আলোচনা পর্ব দ্রুত সম্পন্ন হবে বলে মনে করেন?
লুকা কাটসেলি: কৃষি ভর্তুকি বিষয়ে একটা স্থায়ী সমাধানের প্রতিশ্রুতি ছাড়া ভারত বাণিজ্য সহজীকরণের চুক্তি অনুমোদনে রাজি হচ্ছিল না। এখন মনে হচ্ছে একটা অগ্রগতি হয়েছে। সে ক্ষেত্রে স্বল্পোন্নত দেশগুলোর স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয় নিয়েও অগ্রগতি হবে। কিন্তু সেবা-বাণিজ্যের আওতায় মোড ফোর হিসেবে পরিচিত শ্রমের অবাধ চলাচলের বিষয়ে তেমন অগ্রগতি হবে কি না সন্দেহ। অথচ উন্নত দেশগুলো ভারত, বাংলাদেশের মতো দেশগুলো থেকে মেধাবী জনগোষ্ঠীকে বেশি সুযোগ-সুবিধা দিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। এতে করে এসব উন্নয়নশীল দেশগুলো মেধার সংকটে পড়ছে। তা ছাড়া ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকার দেশগুলো ঘর-গৃহস্থালির মতো কাজে আধা দক্ষ শ্রমশক্তির জন্য উন্নয়নশীল দেশগুলোর ওপর অনেকটা নির্ভরশীল। কিন্তু রাজনৈতিক কারণে উন্নয়নশীল দেশগুলো এ সুবিধা ঠিকমতো কাজে লাগাতে পারছে না। যেমন ইউরোপের বিভিন্ন দেশ ঘানাসহ আফ্রিকার বিভিন্ন দেশ থেকে প্রচুর প্রশিক্ষিত সেবিকাকে তাদের দেশের হাসপাতালগুলোতে চাকরি দেয়। অন্যদিকে তারাই আবার আফ্রিকার দেশগুলোর স্বাস্থ্য খাত উন্নয়নে বৈদেশিক সহায়তা দিয়ে থাকে। যে অর্থ উন্নয়ন-সহায়তা হিসেবে দেওয়া হচ্ছে, তা সঠিকভাবে কাজে লাগছে না। কারণ, ওই অর্থে প্রশিক্ষিত হয়ে সেবিকারাই কাজের জন্য ইউরোপে চলে যান। এভাবে দাতা দেশগুলো এখান থেকে লাভবান হলেও সাহায্য গ্রহণকারী দেশগুলোর তেমন কোনো লাভ হচ্ছে না।
প্রথম আলো: বৈশ্বিক আর্থিক সংকটের পরও আর্থিক বাজার নিয়ন্ত্রণের বিষয়ে যথেষ্ট অগ্রগতি হয়নি বলে মনে করা হচ্ছে। আপনি বিষয়টি কীভাবে দেখছেন?
লুকা কাটসেলি: বিশ্ব অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় গুটি কয়েক বড় ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কাছে পুরো বিশ্ব একপ্রকার জিম্মি হয়ে পড়েছে। বিশ্বের মোট সম্পদের ৪০ শতাংশই এখন কয়েকটি বড় ব্যাংকের দখলে। কিছু লোক দেখানো নির্দেশনা ছাড়া এসব ব্যাংককে নিয়ন্ত্রণে কার্যত কোনো আইন নেই। এসব আর্থিক প্রতিষ্ঠানের বাণিজ্যিক ও বিনিয়োগ কার্যক্রমকে আলাদা করা না হলে এবং ফাটকা কারবার নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ কিংবা পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর মন্দাবস্থা কাটবে না। এ জন্য একটি সমন্বিত বা বৈশ্বিক তদারকি কর্তৃপক্ষ প্রয়োজন। যুক্তরাষ্ট্রে ১৯৯৯ সালে গ্লাস-স্টিগাল আইন বাতিল করে দিয়ে পুঁজিবাজারের ফাটকা কারবারের সঙ্গে ব্যাংক খাতকে জড়িয়ে ফেলার সুযোগ দেওয়া হয়েছে। এখন আবার এ রকম আইন প্রয়োজন যেন পুঁজিবাজার থেকে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো দূরত্ব বজায় রাখে।
প্রথম আলো: টোবিন কর আরোপ করে বিশ্বজুড়ে আর্থিক ও মুদ্রাবাজারের ফাটকাবাজি কিছুটা নিয়ন্ত্রণ করা যাবে বলে অনেকে মনে করেন। আপনি কি একমত?
লুকা কাটসেলি: আমি একমত নই। টোবিন ট্যাক্স মূলত বৈদেশিক মুদ্রার কারবারের ওপর প্রযোজ্য। আর কারসাজি করে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো যত টাকা আয় করে, তা থেকে সামান্য অংশই টোবিন ট্যাক্সের মাধ্যমে দিতে হবে। এতে এ ধরনের অপকর্ম বন্ধ করা যাবে না। যুক্তরাষ্ট্রের অনেক ব্যাংক মুদ্রা কারসাজির অপরাধে অনেক বড় অঙ্কের জরিমানা দিলেও তা বন্ধ হয়নি। এ ক্ষেত্রে নজরদারি বাড়ানো, তথ্য আদান-প্রদান, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির মতো বিষয়গুলো নিশ্চিত করার মাধ্যমে আরও কার্যকর ফল পাওয়া যেতে পারে।
প্রথম আলো: তাহলে কি আপনি আর্থিক খাতে বড় ধরনের নিয়ন্ত্রণ আরোপের পক্ষে? মানে আর্থিক বাজারের নিয়মকানুন কঠোর করার পক্ষে?
লুকা কাটসেলি: হ্যাঁ, তা-ই। কেননা, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো এখন বড় চালিকাশক্তি হয়ে উঠেছে। ভয় দেখানো কিংবা চাপে ফেলে তারা সরকারের নীতিনির্ধারণী কার্যক্রমে ভূমিকা রাখে। ফলে সাধারণ মানুষ, করদাতা, শ্রমিক, তরুণসমাজের চাওয়া অনুযায়ী নীতি তৈরি হচ্ছে না। জাতিসংঘের উন্নয়ন নীতিমালাবিষয়ক কমিটি ১৯৯৮ সালে একটি বিশ্ব আর্থিক সংস্থা (ডব্লিউএফও) গঠনের প্রস্তাব করেছিল। সেটা এখনো হয়নি। এর অংশ হিসেবে প্রাথমিকভাবে ‘গ্লোবাল কাউন্সিল অব সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট ফাইন্যান্স’ নামে একটি সংস্থা গড়ে তোলা যেতে পারে। আর্থিক বিষয়ে সহযোগিতা বাড়ানো, তথ্য আদান-প্রদান, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করা, কীভাবে বিভিন্ন দেশের আর্থিক ও শিল্প খাতে অর্থায়ন করা যায়, এসব কাজ করাই হবে এই উদ্যোগের উদ্দেশ্য।
প্রথম আলো: বলা হচ্ছে, অবশেষে গ্রিস মন্দা থেকে বেরিয়ে এসেছে। প্রকৃত অবস্থা আসলে কী?
লুকা কাটসেলি: আসলে গ্রিস এখনো মন্দা কাটিয়ে উঠতে পারেনি। মন্দার ফলে গ্রিসের মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) ২৫ শতাংশ কমে গেছে। এখনো সে ধাক্কা আমরা কাটিয়ে উঠতে পারিনি। বেকারত্বের হার গড়ে ২৬ শতাংশ, প্রতি দুজন কর্মক্ষম ব্যক্তির একজন বেকার। চার লাখ পরিবারে একজনও উপার্জনকারী সদস্য নেই। এটিকে বড় আকারের সামাজিক মন্দাও বলা যেতে পারে। সংকট কাটাতে রাজস্ব কৃচ্ছ্রতার পথ বেছে নেওয়া হয়েছিল। তাতে পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। কেননা, এর মূল করণীয় ছিল, সরকারি ব্যয় সংকোচন। এতে বিপুলসংখ্যক মানুষ কাজ হারিয়েছে। নয়া উদারবাদী নীতি দিয়ে আর্থিক সংকটের সমাধান হয় না। গ্রিস তার প্রমাণ।
(সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আসজাদুল কিবরিয়া ও আশরাফুল ইসলাম)