পাটের পুনর্জাগরণে ভাটার টান

মন্দার কবলে পড়ে বিশ্ববাজারে পাটের দাম কম। তাই কৃষকের মুখে এই হাসি এখন আর নেই ষ ফাইল ছবি
মন্দার কবলে পড়ে বিশ্ববাজারে পাটের দাম কম। তাই কৃষকের মুখে এই হাসি এখন আর নেই ষ ফাইল ছবি

সোনালি আঁশ পাটের পুনর্জাগরণে ভাটার টান পড়েছে। মন্দার কবলে পড়ে দুই বছর ধরে বিশ্ববাজারে পাটের দাম কম। সেটির প্রভাবে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ পাটকল করপোরেশন (বিজেএমসি) এখন আবার দুর্দিনে। লাগামহীনভাবে লোকসানের বোঝা বেড়েই চলছে সংস্থাটির।
টানা ২২ বছর লোকসানের পর ২০১০-১১ অর্থবছরে বিজেএমসি লাভের মুখ দেখেছিল। সে বছর সব খরচ বাদে তাদের লাভ হয় পৌনে ১৮ কোটি টাকা। তবে এমন আলোর ঝলকানির পর আবার পথ হারায় করপোরেশন। এরপর ২০১১-১২ অর্থবছরে সংস্থাটি লোকসান করেছে ৬৬ কোটি টাকা। আর সর্বশেষ ২০১২-১৩ অর্থবছর তা বেড়ে ৩৮০ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। অবশ্য প্রতি ১০০ টাকার পাটপণ্য রপ্তানিতে সরকার ১০ টাকা করে নগদ সহায়তা দেওয়ায় লোকসানের পরিমাণ কিছুটা কমেছে।
এদিকে বিজেএমসির বেশির ভাগ পাটকল ধারাবাহিকভাবে লোকসান করে চলেছে। গত অর্থবছর করপোরেশনের ১২টি পাটকল লোকসান করে। তার আগের বছর লোকসানি ছিল নয়টি পাটকল।
এত লোকসানের মধ্যে অবশ্য কিছুটা আশার কথা আছে। বিজেএমসির পাটপণ্যের রপ্তানির পরিমাণ বাড়ছে। গত অর্থবছরের এপ্রিল পর্যন্ত এক হাজার ১০০ কোটি টাকার পণ্য রপ্তানি হয়েছে। আগের বছর এক হাজার কোটি টাকার পণ্য রপ্তানি করেছিল সংস্থাটি।
লোকসান বৃদ্ধি প্রসঙ্গে বিজেএমসি বলছে, গত বছর পাটকলশ্রমিকদের মজুরি ৭০ শতাংশ এবং বিদ্যুতের দাম ৪০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। অন্যদিকে বিশ্ববাজারে পাটপণ্যের দাম কমেছে কমপক্ষে ১০ শতাংশ।
সংশ্লিষ্ট একাধিক ব্যক্তি জানান, বর্তমান সরকার উদ্যোগী হয়ে কয়েকটি মিল চালু করে। সেই হিসাবে বর্তমানে চালু আছে ২৩টি পাটকল। বন্ধ আছে একটি। কিন্তু এগুলো লাভজনক করতে সংস্কার ও আধুনিকায়নে যথাযথ পদক্ষেপ নেয়নি সরকার। বিজেএমসির হাজার কোটি টাকার একটি প্রকল্প প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরে দেড় বছরের বেশি সময় ধরে পড়ে আছে।
অন্যদিকে পণ্যের বহুমুখীকরণ ও নতুন বাজার ধরতে না পারা এবং দেশের অভ্যন্তরে পণ্যে পাটজাত মোড়কের ব্যবহার বাধ্যতামূলক আইনের বাস্তবায়নে নিশ্চিত না হওয়ায় এখনো বিজেএমসিকে লোকসান গুনতে হচ্ছে বলে মনে করেন সংস্থাটির একাধিক কর্মকর্তা।
লোকসানের খতিয়ান: অর্থনৈতিক সমীক্ষা-২০১৩-এর তথ্য অনুযায়ী, ২০১২-১৩ অর্থবছরে বিজেএমসির লোকসান প্রাক্কলন করা হয়েছে ৩৮০ কোটি ৪৩ লাখ টাকা। রাষ্ট্রায়ত্ত করপোরেশনগুলোর মধ্যে সর্বোচ্চ লোকসান দিয়েছে বিজেএমসি। প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, বিজেএমসির গত ১০ বছরের লোকসানের মধ্যে এটি সর্বোচ্চ। এর মধ্যে ২০১০-১১ অর্থবছরে ১৭ কোটি ৭২ লাখ টাকা লাভ করেছিল সংস্থাটি। এবার নিয়ে গত ১১ বছরে সংস্থাটি মোট তিনবার ৩০০ কোটির টাকার বেশি লোকসান দিয়েছে।
বিপুল লোকসানের কারণ সম্পর্কে বিজেএমসির চেয়ারম্যান হুমায়ুন খালেদ সম্প্রতি প্রথম আলোকে বলেন, শ্রমিক ও বিদ্যুতের খরচ বেড়ে যাওয়ায় এই লোকসান গুনতে হয়েছে।এ সময় তিনি খরচ বেড়ে যাওয়ার একটি হিসাব তুলে ধরেন। তিনি জানান, বর্তমানে রাষ্ট্রীয় পাটকলগুলোতে প্রায় ৭৯ হাজার শ্রমিক কর্মরত আছেন। গত বছর জুলাইতে শ্রমিকদের বেতন ৭০ শতাংশ বাড়িয়েছে সরকার। ফলে এখন প্রতি সপ্তাহে শ্রমিকদের মজুরি বাবদ ১৪ কোটি টাকা দিতে হয় বিজেএমসিকে; আগে যার পরিমাণ ছিল সাড়ে ছয় কোটি টাকা। এ ছাড়া বিদ্যুৎ বিল বাবদ প্রতি মাসে করপোরেশনের ১২ থেকে ১৫ কোটি টাকা খরচ হয়। আগে এ খাতে খরচ ছিল সাত-আট কোটি টাকা।
ঝুলে আছে প্রকল্প: বহুবছরের পুরোনো যন্ত্রাংশ দিয়ে চলছে পাটকলগুলো। বর্তমানে সব কটি মিলে দৈনিক ৬৮০ মেট্রিক টন পাটপণ্য উৎপাদিত হয়। তবে করপোরেশন বলছে, আধুনিক যন্ত্রপাতি সংযোজন করা হলে এক লাফে উৎপাদন ৯০০ মেট্রিক টনে উন্নীত হবে। রপ্তানিবাজার ধরতে হলে আধুনিকায়নের কোনো বিকল্প নেই।
এ জন্য ২০১১ সালে বিজেএমসি এক হাজার ৮৪ কোটি টাকার একটি সম্মিলিত উন্নয়ন প্রকল্প হাতে নেয়। যার মধ্যে শ্রমিকের কর্মপরিবেশ উন্নয়ন থেকে শুরু করে যন্ত্রপাতির আধুনিকায়ন ও অবকাঠামো উন্নয়ন অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। প্রকল্পটি ওই বছরই অনুমোদনের জন্য বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। পরে সেটি চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের জন্য প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরে পাঠানো হলেও এখনো সেখানেই পড়ে আছে।
অন্যদিকে বন্ধ থাকা আদমজী পাটকল নতুন করে চালুর উদ্যোগ নেয় বর্তমান সরকার। এজন্য ৩০৭ কোটি টাকার প্রকল্পটিও প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরে পড়ে আছে।
অভ্যন্তরীণ বাজারে হতাশা: অভ্যন্তরীণ পাটের বাজার বাড়াতে সরকার ‘পণ্যে পাটজাত মোড়কের ব্যবহার বাধ্যতামূলক আইন-২০১০’ অনুমোদন করে। ওই আইনে সরকারি-বেসরকারি সব প্রতিষ্ঠানের উৎপাদিত পণ্যের মোড়ক হিসেবে ৭৫ শতাংশ পাট আছে এমন উপাদান দিয়ে তৈরি মোড়কের বিধান আছে।
বিজেএমসির চেয়ারম্যান হুমায়ুন খালেদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘আইনটির ১০ থেকে ১৫ শতাংশও যদি বাস্তবায়ন করা যায়, তাহলে আমাদের পাটপণ্য দেশের বাইরে রপ্তানির প্রয়োজন হবে না। নিজেদের চাহিদা দিয়েই আমরা লাভজনক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হতে পারব।’ তাই এই আইনের বাস্তবায়নে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণের কথা বলেন তিনি। এর বাইরে বর্তমান অবস্থায় লোকসান থেকে বেরিয়ে আসতে পণ্যের বহুমুখীকরণ এবং নতুন রপ্তানিবাজার খুঁজে বের করতে হবে বলে জানান হুমায়ুন খালেদ। এ জন্য তিনি কাজ করছেন বলেও জানান।