এখনো বেকার ২৬ লাখ মানুষ

দেশের বেকার পরিস্থিতির কোনো পরিবর্তন হয়নি। সরকারের দাবি, ব্যাপক কর্মসংস্থান হয়েছে, কিন্তু পরিসংখ্যান তা বলে না। মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি যে হারে হচ্ছে, সে হারে বাড়ছে না কর্মসংস্থান। ২০১৩ সালের হিসাবে দেশে বেকার ২৬ লাখ। ২০১০ সালেও বেকারের সংখ্যা একই ছিল।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) শ্রমশক্তি জরিপ ২০১৩-এর প্রাথমিক খসড়া প্রতিবেদন থেকে এ তথ্য পাওয়া গেছে। শিগগিরই এ প্রতিবেদন প্রকাশিত হবে।
বিশাল এ বেকার জনগোষ্ঠী সপ্তাহে মজুরির বিনিময়ে এক ঘণ্টাও কাজ করার সুযোগ পায় না। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) মানদণ্ড অনুযায়ী এ হিসাব তৈরি করা হয়েছে। আইএলও মনে করে, সপ্তাহে এক ঘণ্টা কাজ না করলে ওই ব্যক্তিকে বেকার বিবেচনা করা হবে।
কিন্তু, বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে সপ্তাহে এক ঘণ্টা কাজ করে জীবন ধারণ করা অসম্ভব। এ জন্য পরিসংখ্যান ব্যুরো শ্রমশক্তি জরিপে সপ্তাহে ১ থেকে ৩৫ ঘণ্টা কাজ করার সুযোগ পান—এমন ব্যক্তির কাজের হিসাব জরিপে নিয়ে থাকে। তাঁদের অবশ্য অর্ধবেকার বলা হয়। তাঁরা চাকরি করে মাস শেষে বেতন বা মজুরি পান না। টিউশনি, গৃহকর্মের মতো অস্থায়ী কাজ করেন।
বিবিএসের শ্রমশক্তি জরিপের প্রাথমিক এ হিসাবে দেখা গেছে, ২০১১ থেকে ২০১৩ সালের মধ্যে এ ধরনের অর্ধবেকার বেড়েছে এক কোটির বেশি। আর ২০১৪ সালে এসে তা হয়েছে প্রায় ২ কোটি ১৫ লাখ। ২০১০ সালের জরিপে ১ কোটি ১০ লাখ অর্ধবেকারের হিসাব মেলে। অর্ধবেকারেরাও শ্রমশক্তিতে যুক্ত হন। তাই অর্ধবেকারের সংখ্যা বেড়ে যাওয়াকে ইতিবাচক মনে করা হয়। অর্থাৎ বাড়তি এক কোটি মানুষ এখন কমবেশি কাজ পাচ্ছেন।
বেকার পরিস্থিতি অপরিবর্তিত থাকলেও দেশের কর্মক্ষম মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধিতে বেকারত্বের হার কিন্তু কমেছে। ২০১০ সালে এ হার ছিল সাড়ে ৪ শতাংশ। এখন তা কমে দাঁড়িয়েছে ৪ দশমিক ৩ শতাংশ।
পুরুষ বেকার কমলেও নারী বেকার বেড়েছে। তিন বছরের ব্যবধানে পুরুষ বেকারের সংখ্যা কমেছে তিন লাখ। এখন ১৩ লাখ পুরুষ বেকার। আবার একইভাবে নারী বেকার বেড়েছে তিন লাখ। এখন নারী বেকারের সংখ্যা ১৩ লাখ। এর মানে হলো, নারী ও পুরুষ বেকারের সংখ্যা এখন সমান। নারী বেকার বৃদ্ধি মানে নারীরা আগের চেয়ে এখন পড়াশোনায় বেশি সম্পৃক্ত হচ্ছেন—এটা আশার দিক।
২০১১, ১২, ১৩ সাল অর্থাৎ তিন বছরে দেশে ৪০ লাখ লোকের কর্মসংস্থান হয়েছে। সেই হিসাবে প্রতিবছর গড়ে ১৩ লাখের বেশি মানুষ কাজ পেয়েছেন। আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী, বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল অর্থনীতিতে প্রতি ১ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হলে আড়াই লাখ লোকের কর্মসংস্থান হওয়ার কথা। কয়েক বছর ধরেই বাংলাদেশে ৬ শতাংশের বেশি প্রবৃদ্ধি হচ্ছে। সে হিসাবে প্রতিবছর কমপক্ষে ১৫ লাখ মানুষের জন্য নতুন কাজ তৈরি হওয়ার কথা। কিন্তু তা হয়নি।
বেকার লোকের সংখ্যা অপরিবর্তিত রয়েছে ঠিকই, কিন্তু জনসংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় বেকারত্বের হার কমেছে।
পর্যাপ্ত কর্মসংস্থান নিশ্চিত করতে এই মুহূর্তে উচ্চ প্রবৃদ্ধি দরকার বলে মনে করেন সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক মোস্তাফিজুর রহমান। তিনি জানান, উচ্চ প্রবৃদ্ধি হলে বর্তমানে যে হারে কর্মসংস্থান হচ্ছে, তার চেয়ে বেশি হারে কর্মসংস্থান হবে। এতে প্রতিবছর যতসংখ্যক মানুষ শ্রমবাজারে যুক্ত হয়, তাদের জন্য কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করা যাবে। তাঁর মতে, উৎপাদন বাড়িয়ে শ্রমনির্ভর শিল্পের দিকে বেশি নজর দিতে হবে। কৃষির পাশাপাশি শিল্প ও সেবা খাতের ওপর জোর দিতে হবে। পরিবহন ও রেস্টুরেন্টের মতো ব্যবসা, যেখানে বেশি শ্রমিক দরকার, এমন কর্মস্থানের দিকে মনোযোগী হতে হবে।
এ পরিস্থিতি কিছুটা ভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করেছেন বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) গবেষণা পরিচালক বিনায়ক সেন। তাঁর মতে, যখন একটি দেশের প্রবৃদ্ধি বাড়তে থাকবে, তখন প্রতি ১ শতাংশ প্রবৃদ্ধির জন্য আড়াই লাখ লোকের কর্মসংস্থান হবে—এ তত্ত্বটি স্থির থাকবে না। আলোচ্য সময়ে প্রতিবছর সাড়ে তিন থেকে চার লাখ লোক কাজ নিয়ে বিদেশে গেছেন। তাঁরা বিদেশে যে কাজ করেন, দেশে সে কাজ করলে যে মজুরি পেতেন, বিদেশে তার দুই থেকে আড়াই গুণ পান। বেশি মজুরি পাওয়ায় তাঁরা দেশের বাইরে গেছেন। এর ফলে দেশের অভ্যন্তরেও এ ধরনের কর্মসংস্থানের জন্য লোকের সরবরাহ কমেছে। তাঁরা দেশে থাকলে হয়তো প্রতি শতাংশ প্রবৃদ্ধির জন্য যে কর্মসংস্থানের ঘাটতি রয়েছে, তা দেখা যেত না।
এখন বিভিন্নভাবে কাজের মধ্যে রয়েছেন বা কর্মরত আছেন ৫ কোটি ৮১ লাখ মানুষ। ২০১০ সালে এ সংখ্যা ছিল ৫ কোটি ৪১ লাখ। আর বর্তমানে ১৫ থেকে ৬৫ বছর বয়সী কর্মক্ষম মানুষের সংখ্যা ৬ কোটি ৭ লাখ।