সব আয়করদাতার বিবরণী যাচাই-বাছাই করা হবে

এখন থেকে সব করদাতার আয়কর বিবরণী যাচাই-বাছাই করবেন কর কর্মকর্তারা। যাচাই-বাছাই না করে আয়কর বিবরণীর প্রাপ্তি স্বীকারপত্র করদাতাকে দেবেন না কর কর্মকর্তারা। এত দিন সর্বজনীন স্বনির্ধারণী পদ্ধতিতে আয়কর বিবরণী জমা দিলে তা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে পারতেন না কর্মকর্তারা। করদাতারা আয়-ব্যয় বিবরণী জমা দিয়ে যে কর দিতেন, তা বিনা প্রশ্নে মেনে নিতেন কর কর্মকর্তারা।
সর্বজনীন স্বনির্ধারণী পদ্ধতি হলো করদাতা নিজেই আয়-ব্যয় হিসাবনিকাশ শেষে করের পরিমাণ নির্ধারণ করে বার্ষিক বিবরণী জমা দেন। এটা করদাতার চূড়ান্ত করনথি মূল্যায়ন। অবশ্য পরে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) অনুমোদন নিয়ে এক থেকে দুই শতাংশ করদাতার করনথি নিরীক্ষা করে সংশ্লিষ্ট কর অঞ্চলগুলো।
কিন্তু আগামী করবর্ষ থেকে এ ধরনের ব্যবস্থা আর থাকছে না। সর্বজনীন স্বনির্ধারণী পদ্ধতিতে আয়কর বিবরণী জমার পরপরই সংশ্লিষ্ট কর কর্মকর্তা মূল্যায়ন করবেন। আয়কর বিবরণীতে দেওয়া কোনো তথ্যের ভুল রয়েছে কি না কিংবা কর নির্ধারণের হিসাবমতে কোনো ভুল আছে কি না, তা যাচাই-বাছাই করে করদাতাকে প্রাপ্তি স্বীকারপত্র দেবেন। অর্থবিল ২০১৫-এ আয়কর অধ্যাদেশের ৮২ (বিবি) ধারা সংশোধন করে এ নতুন বিধান করা হয়েছে।
এ বিষয়ে এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আবদুল মজিদ প্রথম আলোকে বলেন, যে উদ্দেশ্যে সর্বজনীন স্বনির্ধারণী পদ্ধতিতে আয়কর বিবরণী দাখিলের বিধান করা হয়েছিল, এর সঙ্গে নতুন উদ্যোগটি পরিপন্থী। এতে নতুন ও পুরোনো করদাতাদের কাছে ‘নেতিবাচক বার্তা’ যাবে। অনেকেই নতুন করে হয়রানির আশঙ্কায় সর্বজনীন স্বনির্ধারণী পদ্ধতিতে আয়কর বিবরণী জমা দিতে উৎসাহিত হবেন না।
২০০৭-০৮ অর্থবছরে প্রথমবারের মতো সর্বজনীন স্বনির্ধারণী পদ্ধতিতে বার্ষিক আয়কর বিবরণী জমা দেওয়ার ব্যবস্থা চালু করা হয়। কর কর্মকর্তাদের হয়রানির ভয়ে অনেক কর শনাক্তকরণ নম্বরধারী (টিআইএন) বার্ষিক আয়কর বিবরণী জমা দেন না বলে অভিযোগ রয়েছে। এ জন্য করদাতাদের আস্থায় আনতে সর্বজনীন স্বনির্ধারণী পদ্ধতিতে বার্ষিক আয়-ব্যয় বিবরণী জমা দেওয়ার প্রথা চালু করা হয়। তখন এর উদ্দেশ্য ছিল করদাতারা আয়-ব্যয়ের বিবরণী দিয়ে যে পরিমাণ কর দেবেন, তা-ই মেনে নেবে এনবিআর। এতে করদাতাদের আস্থায় আনা যাবে।
এরপর ব্যবস্থাটি বেশ জনপ্রিয় হয়েছে। বর্তমানে প্রায় ৯৫ শতাংশের বেশি করদাতা সর্বজনীন স্বনির্ধারণী পদ্ধতিতে কর বিবরণী জমা দেন। গতবার প্রায় ১১ লাখ করদাতা বার্ষিক আয়কর বিবরণী জমা দেন। সাধারণ পদ্ধতিতে এখন আর কেউ কর দেন না।
এনবিআরের কর্মকর্তারা জানান, গত কয়েক বছরে অনেক করদাতা এ সুযোগটির অপব্যবহার করেছেন। এ জন্য আয়কর অধ্যাদেশ সংশোধন করে কর কর্মকর্তাদের এ বিশেষ ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। এতে সৎ করদাতাদের হয়রানি হওয়ার সুযোগ নেই।
এ ছাড়া নির্ধারিত সময়ে আয়কর বিবরণী জমা দিতে ব্যর্থ হলে যৌক্তিক কারণ দেখিয়ে তিন মাস পর্যন্ত সময় বৃদ্ধি করা যায়। কিন্তু আগামী অর্থবছর থেকে তা আর করা যাবে না। তিন মাসের পরিবর্তে দুই মাস সময় বৃদ্ধির ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে উপকর কমিশনারদের। কর ফাঁকি ঠেকাতে আগামী অর্থবছর থেকে কর কর্মকর্তাদের ক্ষমতাও বৃদ্ধি করা হয়েছে। আবার প্রতিষ্ঠান পর্যায়ের করদাতাদের ওপর বিভিন্ন মেয়াদের শাস্তি ও জরিমানার বিধান রাখা হয়েছে।
উল্লেখ্য, প্রত্যক্ষ কর থেকেই আগামী অর্থবছরে সবচেয়ে বেশি ৬৫ হাজার ৯৩২ কোটি টাকা আদায়ের লক্ষ্য রয়েছে। এ জন্যই নজরদারি বৃদ্ধি করতে এমন উদ্যোগ নিয়েছে এনবিআর।
বিদেশি কর্মী কাজ করেন এমন প্রতিষ্ঠানই সবচেয়ে বেশি নজরদারিতে থাকবে। বিনিয়োগ বোর্ডের অনুমোদনহীন অবৈধ বিদেশি কর্মী থাকলে এসব প্রতিষ্ঠানের নিয়োগকর্তা ব্যক্তি বা কোম্পানিকে বড় অঙ্কের জরিমানা গুনতে হবে। কোনো প্রতিষ্ঠানে এ ধরনের অবৈধ কর্মীকে পাওয়া গেলে নিয়োগকর্তাকে তিন মাস থেকে তিন বছর পর্যন্ত জেলদণ্ড দেওয়ার বিধান রাখা হয়েছে। এ ছাড়া পাঁচ লাখ টাকা পর্যন্ত জরিমানাও করতে পারবেন কর কর্মকর্তারা।
প্রতিষ্ঠান পর্যায়ে কোনো করদাতা যদি মিথ্যা বা জাল নিরীক্ষা প্রতিবেদন দেন, তবে ওই করদাতাকে তিন মাস থেকে তিন বছর পর্যন্ত জেলদণ্ড দেওয়ার বিধান রাখা হয়েছে। এ ছাড়া ওই করদাতাকে এক লাখ টাকা পর্যন্ত জরিমানাও গুনতে হতে পারে।
অন্যদিকে বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর ওপর নজর রাখবে এনবিআর। আন্তর্জাতিক লেনদেনের সঙ্গে সম্পৃক্ত প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের আন্তর্জাতিক লেনদেনের বিবরণী জমা দিতে ব্যর্থ হলে লেনদেন মূল্যের ২ শতাংশ জরিমানা আরোপ করবেন কর কর্মকর্তারা।
বর্তমানে দেশের ২৫ ধরনের কর্তৃপক্ষ সেবা প্রদানকালে কর শনাক্তকরণ নম্বর (টিআইএন) সনদ যাচাই না করলে ওই প্রতিষ্ঠানকে ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত জরিমানা আরোপের বিধান করা হয়েছে।