নীতি প্রণয়ন, ব্যাংকিং ব্যবস্থা এবং দুটি গল্প

অর্থনীতির উন্নয়নের স্বার্থে সরকার যেসব নীতি গ্রহণ করে, সেগুলো কেমন হওয়া উচিত? বাংলাদেশ সফরে আসা বিশ্বব্যাংকের প্রধান অর্থনীতিবিদ কৌশিক বসু তার একটি দিকনির্দেশনা দিয়েছেন। আর আর্থিক বাজারের প্রতারণা কমাতে হলে মেধার ব্যবহারের প্রয়োজনীয়তার কথা তুলে ধরেন তিনি। তাঁর মতে, শিক্ষিত ও দক্ষ মানবসম্পদ দিয়েই সমস্যার সমাধান করতে হবে।
নীতি প্রণয়নের ও আর্থিক বাজার প্রসঙ্গে কৌশিক বসু গতকাল রোববার বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে (বিআইসিসি) দেওয়া লোকবক্তৃতায় দুটি গল্পও শোনান। গতকাল বেলা তিনটায় বাংলাদেশ ব্যাংক এ লোকবক্তৃতার আয়োজন করে।
প্রথম গল্পটি ছিল এক টুপি বিক্রেতাকে নিয়ে। এক গরিব মানুষ মাথার টুপি বিক্রি করতেন গ্রামে গ্রামে ঘুরে। একদিন টুপি বিক্রি করতে বের হয়ে ক্লান্ত হয়ে রাস্তার পাশে সব টুপি রেখে ঘুমিয়ে পড়েন। ঘুম ভেঙে উঠে দেখেন সব টুপি উধাও। দেখলেন একদল বানর তাঁর সব টুপি নিয়ে গাছের ডগায় বসে আছে। বিমর্ষ টুপি বিক্রেতা মুষড়ে পড়েন। হঠাৎ তাঁর মাথায় বুদ্ধি এল। নিজের মাথায় থাকা টুপিটিও মাটিতে ছুড়ে ফেললেন। আর দেখাদেখি অনুকরণপ্রিয় বানরগুলোও তাদের মাথার টুপি ছুড়ে দিতে শুরু করলে সব মাটিতে এসে পড়ে। আর সেগুলো কুড়িয়ে নিয়ে হাসিমুখে আবারও বিক্রির জন্য বেরিয়ে পড়েন টুপি বিক্রেতা।
এরই পুনরাবৃত্তি ঘটল ওই টুপি বিক্রেতার নাতির বেলায়ও। একদিন ক্লান্ত হয়ে টুপি মাটিতে রেখে ঘুমিয়ে পড়েন তিনিও। উঠে দেখেন সব টুপি নিয়ে গেছে একদল বানর। হঠাৎই তাঁর দাদার কথা মনে হলো। একই পন্থা অবলম্বন করে নিজের মাথার টুপিও ছুড়ে দিলেন মাটিতে। কিন্তু এবার ঘটল উল্টোটি। মাথার টুপি ছুড়ে ফেলার সঙ্গে সঙ্গে গাছ থেকে একটি বানর এসে সেটিও কুড়িয়ে নিয়ে গেল। আর বলে গেল, ‘তুমি মনে করেছ তোমারই শুধু দাদা ছিল। ভুলে গেছ আমাদেরও দাদা ছিল।’
কৌশিক বসু এবার বললেন, যখনই নীতিনির্ধারকেরা কোনো নীতি করবেন, তখন তাঁদের ভাবতে হবে যাঁদের জন্য নীতি তাঁরা নীতি প্রণয়নকারীদের চেয়েও বুদ্ধিমান হতে পারেন। তাই নীতি করতে হবে জনগণের সক্ষমতা, যোগ্যতা ও মেধাকে বিবেচনায় নিয়ে।
বিশ্বজুড়ে আর্থিক বাজার ও ব্যাংকিং ব্যবস্থা বর্ণনা করতে গিয়ে শিবরাম চক্রবর্তীর লেখা আরেকটি গল্প শোনান কৌশিক বসু। একদিন শিবরামের হঠাৎ ৫০০ টাকা খুব দরকার পড়ল। নানা জনের কাছে ব্যর্থ হয়ে টাকা জোগাড়ের জন্য পুরোনো বন্ধু গোবর্ধনের শরণাপন্ন হলেন কোনো এক শনিবারে। বুধবার টাকা ফিরিয়ে দেওয়ার ওয়াদা করে ৫০০ টাকা ধার নিয়ে নিজের প্রয়োজন সারলেন। এরপর বুধবার ঘনিয়ে আসে। কিন্তু গোবর্ধনের ধার শোধ করার সামর্থ্য নেই শিবরামের। তখন তিনি শরণাপন্ন হলেন আরেক বন্ধু হর্ষবর্ধনের। শনিবার তাঁকে ফিরিয়ে দেবেন এই ওয়াদা করে হর্ষবর্ধনের কাছ থেকে ৫০০ টাকা ধার নিয়ে তা দিয়ে গোবর্ধনের ধার শোধ করেন। এভাবেই চলল। শনিবার গোবর্ধন, আর বুধবার হর্ষবর্ধন। কিন্তু একদিন একসঙ্গে গোবর্ধন ও হর্ষবর্ধন শিবরামের মুখোমুখি। বিপদ টের পেয়ে বুদ্ধিমান শিবরাম নতুন ফন্দি বের করলেন। দুজনকেই বললেন, ‘তোমাদের দুজনের কাছ থেকে টাকা ধার নেওয়া ও পরিশোধ করতে গিয়ে আমার অনেক সময়ের অপচয় হচ্ছে। এখন থেকে শনিবার ও বুধবার তোমরা একে অপরের সঙ্গে টাকার বিনিময়ের সেই কাজটি করে নিয়ো।’
১৯৯২ থেকে ২০১৫ সাল। ২৩ বছর পর বাংলাদেশে এসে এ দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের প্রশংসা করলেন ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহের প্রধান অর্থনীতি-বিষয়ক উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালনকারী কৌশিক বসু। তাঁর মতে, সামাজিক অনেক সূচকে ভারতের চেয়েও বাংলাদেশ অনেক এগিয়ে।
৪০ মিনিটের বক্তব্যের পর আরও ৫০ মিনিট তিনি প্রশ্নোত্তর পর্বে অংশ নিয়ে বিনিয়োগ, মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপি প্রবৃদ্ধি, বেকারত্ব, বৈশ্বিক বাণিজ্য, আঞ্চলিক যোগাযোগ, ধনী-গরিবের মধ্যকার সম্পদ বৈষম্য, দারিদ্র্য দূরীকরণ, কর্মসংস্থান বিষয়ে বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেন।