উন্নয়ন আছে, আগ্রহ নেই

মংলা বন্দরে নামছে গাড়ি
মংলা বন্দরে নামছে গাড়ি

মংলা বন্দরের উন্নয়নে সরকার সম্প্রতি বড় অঙ্কের অর্থ ব্যয় করলেও এটির ব্যবহারে ব্যবসায়ীদের আগ্রহ বাড়ছে না। বরং বন্দর ব্যবহারকারী ও ব্যবসায়ী নেতাদের দাবি, চট্টগ্রাম বন্দরের তুলনায় এটির সুযোগ-সুবিধার ব্যাপক ঘাটতি রয়েছে। অবকাঠামো থেকে শুরু করে যোগাযোগব্যবস্থা উন্নত নয়। তাই এ বন্দর ব্যবহারে ব্যবসায়ীরা উদ্যোগী হচ্ছেন না।
মংলা বন্দর কর্তৃপক্ষ (মবক) জানিয়েছে, বন্দরের উন্নয়নে সরকারের এই মেয়াদে প্রায় ৫০০ কোটি টাকার প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। একদিকে উন্নয়নে সরকার বিপুল অর্থ ব্যয় করছে, অন্যদিকে সরকারের আমদানিপণ্যেই সচল রাখতে হচ্ছে এই বন্দরকে। ফলে এই বন্দরের পেছনে উভয় দিক থেকে সরকারের ব্যয়ই কেবল বাড়ছে।
বাংলাদেশ নিট পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিকেএমইএ) সহসভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, ‘বন্দরে পর্যাপ্ত কন্টেইনার নেই। মাওয়া হয়ে বন্দরে পণ্য পৌঁছাতে দীর্ঘ সময় লাগে। এ ছাড়া নাব্যতা কম হওয়ায় সব ধরনের জাহাজ ওই বন্দরে ভিড়ে না।’
বাংলাদেশ রিকন্ডিশন্ড ভেহিক্যালস ইম্পোর্টার্স অ্যান্ড ডিলার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বারবিডা) সভাপতি মো. হাবিব উল্লাহ ডন প্রথম আলোকে বলেন, গাড়ি আমদানিকারকেরা এখন চট্টগ্রাম বন্দরের চেয়ে মংলা বন্দরকে বেশি ব্যবহার করছে। তবে কয়েক বছর গাড়ি ব্যবসায় মন্দাভাব বিরাজ করায় আমদানির পরিমাণ কমে গেছে। তা ছাড়া চট্টগ্রাম বন্দরের তুলনায় মংলা বন্দরে সুযোগ-সুবিধার বেশ ঘাটতি রয়েছে।
বন্দর দিয়ে গত ২০১০-১১ অর্থবছরে গাড়ি আমদানি হয়েছে প্রায় ১০ হাজারটি। ২০১১-১২ অর্থবছরে সেটি কমে দাঁড়িয়েছে প্রায় নয় হাজারে। আর ২০১২-১৩ অর্থবছরে মংলা বন্দর দিয়ে গাড়ি আমদানি হয়েছে মাত্র চার হাজারটি। চলতি ২০১৩-১৪ অর্থবছরের প্রথম চার মাসে প্রায় আড়াই হাজার গাড়ি আমদানি হয়েছে।
অন্যদিকে ২০১২-১৩ অর্থবছরে চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর দিয়ে প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার গাড়ি আমদানি হয়েছে। এ ছাড়া ২০১০-১১ ও ২০১১-১২ অর্থবছরে এর পরিমাণ ছিল যথাক্রমে প্রায় ১৮ হাজার ও সাড়ে পাঁচ হাজার।
বারভিডার সভাপতি অভিযোগ করেন যে সাম্প্রতিক সময়ে মংলা বন্দরে গাড়ির যন্ত্রাংশ চুরির ঘটনা বেড়েছে। আর আমদানি করা গাড়ি রাখার জন্য বন্দরে আলাদা কোনো ব্যবস্থাও নেই। এ কারণে তিনি গাড়ি রাখার জন্য দ্রুত মংলায় আলাদা শেড নির্মাণের দাবি জানান।
এসব বিষয়ে মবক চেয়ারম্যান কমোডর এইচ আর ভূঁইয়া প্রথম আলোকে বলেন, ‘বন্দরের প্রধান সমস্যা ছিল নাব্যতা ও পণ্য পরিবহনের ক্ষেত্রে অনুন্নত যোগাযোগব্যবস্থা। এই দুটি সমস্যা সমাধানে আমরা এরই মধ্যে উদ্যোগ নিয়েছি। ১০ বছর পর মংলা বন্দরের নাব্যতা বৃদ্ধিতে খননকাজ শুরু করা হয়েছে। এটি সম্পন্ন হলে সাড়ে সাত মিটার গভীরতার জাহাজ বন্দরে ভিড়তে পারবে। এখন বন্দরে ভিড়তে পারে ৬ দশমিক ৩ মিটার গভীরতার জাহাজ। এ ছাড়া পণ্য পরিবহন সহজ করতে মাওয়া ফেরি পারাপারে আলাদা একটি ফেরির ব্যবস্থা করা হচ্ছে।’
খুলনা চেম্বারের সাবেক সভাপতি শাহরুজ্জামান মর্তুজা প্রথম আলোকে বলেন, বন্দর ব্যবহারকারীদের আকৃষ্ট করার জন্য যেসব সুযোগ-সুবিধা থাকা দরকার সেগুলোর বেশ অভাব রয়েছে মংলায়। নব্বই-পরবর্তী সরকারগুলো এই বন্দরের উন্নয়নে নানা পদক্ষেপ নিলেও সেগুলোর যথাযথ বাস্তবায়ন হয়নি। উন্নয়নের পরিবর্তে দুর্নীতি বেশি হয়েছে। এ ছাড়া অতীতের কিছু অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার জন্য বিদেশি বড় বড় জাহাজ এই বন্দরে আসতে চায় না।
আমদানিকারকেরা জানান, পর্যাপ্ত ব্যাংকিং সুবিধা না থাকায় বন্দর থেকে পণ্য ছাড় করাতে হলে হয় নগদ টাকা বহন করতে হয়, নয়তো খুলনায় যেতে হয়।
সরেজমিনে দেখা গেছে, সেখানে ব্যাংকিং সুবিধা খুবই অপ্রতুল। মংলা বন্দরসংলগ্ন এলাকায় সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে ব্যাংকের মাত্র তিনটি শাখা রয়েছে। এর মধ্যে বেসরকারি ব্যাংকের শাখা দুটি সম্প্রতি স্থাপিত হয়েছে। আর আমদানি বা রপ্তানিপণ্যের শুল্কায়নের জন্য মংলা বন্দরে রয়েছেন দুজন সহকারী কমিশনার ও চারজন সুপার।
মংলায় কাস্টমসের সহকারী কমিশনার মতিয়ার রহমান প্রথম আলোকে বলেন, আমদানি-রপ্তানিপণ্যের সরেজমিন যাচাই-বাছাইয়ের কাজটি বন্দরে করা হয়। তবে শুল্কায়নসংক্রান্ত অন্যান্য কাজ হয় খুলনায়।
বন্দরসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, ব্যবহারকারীদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে সম্প্রতি সরকার মংলা বন্দরে একাধিক সহকারী কমিশনার নিয়োগ দিয়েছে। তবে কাস্টমস কর্মকর্তাদের অফিসের আলাদা কোনো ব্যবস্থা এখনো করা হয়নি।