ভোজ্যতেলের বাজারে নতুন চার প্রতিযোগী

দেশের ভোজ্যতেলের বাজারে যুক্ত হচ্ছে নতুন চার প্রতিযোগী। শীর্ষস্থানীয় ভোগ্যপণ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান এসিআই কনজ্যুমার ব্র্যান্ডস নিয়ে এসেছে এসিআই পিওর ব্র্যান্ডের সয়াবিন তেল। আরেক বড় প্রতিষ্ঠান আবদুল মোনেম লিমিটেড নেচার ফ্রেশ ব্র্যান্ডের রাইস ব্র্যান অয়েল বা ধানের কুঁড়ার তেল নিয়ে ভোজ্যতেলের বাজারে প্রবেশ করেছে। অন্যদিকে প্ল্যাটিনাম গ্রুপ সরিষার তেলের পরে প্ল্যাটিনাম ব্র্যান্ডে সানফ্লাওয়ার অয়েল ও অলিভ অয়েল নিয়ে আসছে।
এর বাইরে দেশের অন্যতম বড় শিল্পগোষ্ঠী বসুন্ধরা গ্রুপ আটা, ময়দা ও সুজির পরে এবার ভোজ্যতেলের বাজারে ঢোকার উদ্যোগ নিয়েছে। তারা দৈনিক ২ হাজার টন উৎপাদনক্ষমতার ভোজ্যতেল পরিশোধন কারখানা বা রিফাইনারি নির্মাণের চুক্তি করেছে।
দেশে ভোজ্যতেলের চাহিদার সিংহভাগ পূরণ হয় পাম তেল দিয়ে। তবে বাসাবাড়িতে বোতলজাত সয়াবিন তেলের চাহিদা বেশি। অন্যদিকে স্বাস্থ্যের দিক চিন্তা করে মানুষ এখন রাইস ব্র্যান অয়েল, সানফ্লাওয়ার অয়েল ও অলিভ তেলের দিকে ঝুঁকছে। ফলে দেশের বাজারে এসব তেলের বিক্রি বাড়ছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
বাংলাদেশ ট্যারিফ কমিশন গত বছর দেশের ভোজ্যতেল পরিশোধন শিল্প নিয়ে একটি সমীক্ষা করেছিল। ওই সমীক্ষা অনুযায়ী দেশে এখন পরিশোধিত ভোজ্যতেলের চাহিদা বছরে প্রায় ১৫ লাখ টন। মাথাপিছু দৈনিক ৪০ গ্রাম ধরে ২০২১ সালে তেলের চাহিদা প্রায় ২৪ লাখ ৯১ হাজার টনে দাঁড়াবে বলে উল্লেখ করা হয়েছে ওই সমীক্ষায়। এতে মাথাপিছু চাহিদা হবে গড়ে ১৪ দশমিক ৬ কেজি।
ভোজ্যতেল পরিশোধনকারীদের তথ্যমতে, দেশের বোতলজাত সয়াবিন তেলের বাজারে এখন বড় খেলোয়াড় তিনটি কোম্পানি—রূপচাঁদা ব্র্যান্ডের তেল বাজারজাতকারী বাংলাদেশ এডিবল অয়েল, তীর ব্র্যান্ডের তেল বাজারজাতকারী সিটি গ্রুপ ও ফ্রেশ ব্র্যান্ডের তেল বাজারজাতকারী মেঘনা গ্রুপ। এ তিনটি কোম্পানি বোতলজাত সয়াবিন তেলের ৮০ থেকে ৯০ শতাংশ বাজার দখল রেখেছে এবং তাদের প্রত্যেকের বাজার অংশীদারত্ব বা মার্কেট শেয়ার পরস্পরের কাছাকাছি।
এ ছাড়া টিকে গ্রুপের পুষ্টি, নুরজাহান গ্রুপের নুরজাহান, এস আলম গ্রুপের মোরগ, এসএ গ্রুপের মুসকান, ইলিয়াস ব্রাদার্সের দাদা, মোস্তফা ভেজিটেবল তেলের মোস্তফা ও রুবাইয়া ভেজিটেবল তেলের রুবাইয়া ব্র্যান্ডের সয়াবিন তেল আছে।
মোংলায় অবস্থিত সিঙ্গাপুরের সুন সিং গ্রুপের ভোজ্যতেলের রিফাইনারি সম্প্রতি কিনে নিয়েছে বাংলাদেশ এডিবল অয়েল। এতে তাদের দৈনিক উৎপাদনক্ষমতা ৬০০ টন থেকে বেড়ে ১ হাজার ৬০০ টনে উন্নীত হয়েছে। কারখানা কিনে নিলেও বাংলাদেশ এডিবল ভিওলা ব্র্যান্ডের সয়াবিন তেলটি বাজারে রাখবে। তবে তারা লাকি ব্র্যান্ডের একটি পাম তেল শিগগিরই বাজারে ছাড়বে।
দেশের শীর্ষস্থানীয় শিল্পগোষ্ঠী এসিআইয়ের এসিআই পিওর ব্র্যান্ডের লবণ, মসলা, আটা-ময়দা ও চিনি আছে। সম্প্রতি যুক্ত হয়েছে সয়াবিন তেল। অবশ্য ভোজ্যতেলের বাজারে তারা নতুন নয়। এসিআই নিউট্রিলাইফ নামে তাদের একটি রাইস ব্র্যান অয়েল রয়েছে। এসিআই তাদের পিওর ব্র্যান্ডের সয়াবিন তেল পরীক্ষামূলকভাবে বাজারে ছেড়েছে দুই মাস আগে। তবে তারা নিজেরা অপরিশোধিত তেল আমদানি করে না। আমদানি করা তেল কিনে পরিশোধন করে বাজারে ছাড়ছে। এ জন্য তারা একটি মিল ইজারা নিয়েছে।
এসিআই কনজ্যুমার ব্র্যান্ডসের নির্বাহী পরিচালক সৈয়দ আলমগীর প্রথম আলোকে বলেন, পরীক্ষামূলকভাবে সরবরাহ করতে করতেই একসময় পুরোদমে সরবরাহ নিশ্চিত হবে। তবে প্রাথমিকভাবে বাজারে ছেড়ে ভালো সাড়া পাচ্ছেন দাবি করে তিনি আরও বলেন, ভোজ্যতেলের বাজার অনেক বড়। এ বাজারে প্রবেশ করার লক্ষ্য ক্রেতাদের হাতে একটি খাঁটি ও ভালো মানের সয়াবিন তেল পৌঁছে দেওয়া।
আবদুল মোনেম লিমিটেডের বিভিন্ন ধরনের ব্যবসা থাকলেও ভোজ্যতেলের বাজারে তারা নতুন। রাইস ব্র্যান অয়েল উৎপাদনের জন্য টাঙ্গাইলের সাগরদিঘিতে তারা থাইল্যান্ডের সুরিন নামের একটি কোম্পানির সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে কারখানা করেছে। কোম্পানিটি নেচার ফ্রেশ ব্র্যান্ডে রাইস ব্র্যান অয়েল বাজারে ছাড়তে শুরু করেছে ঈদুল আজহার কয়েক দিন আগে থেকে।
আবদুল মোনেমের ব্যবসা উন্নয়ন ব্যবস্থাপক জুবায়ের মাহমুদ প্রথম আলোকে বলেন, তাঁরা এখন পরিবেশক পর্যায়ে তাঁদের তেল সরবরাহ করছেন। শিগগিরই তা ক্রেতাদের কাছে পৌঁছে যাবে।
গত বছর বাংলাদেশ ট্যারিফ কমিশন ‘বাংলাদেশে ধানের কুঁড়ার তেলের সম্ভাবনা’ শীর্ষক একটি সমীক্ষা করে। ওই সমীক্ষা অনুযায়ী, দেশে রাইস ব্র্যান অয়েল মিলের সংখ্যা ১৫টি। এদের মোট উৎপাদনক্ষমতা বছরে ২ লাখ ৫৮ হাজার টন। উদ্যোক্তারা জানান, এসব মিলের মধ্যে ১৩টি উৎপাদনে এসেছে। উৎপাদনে আসা মিলের মধ্যে একটি বিক্রি হয়ে গেছে, একটি বন্ধ হয়ে গেছে। উদ্যোক্তাদের মতে, অতি বিনিয়োগ এ খাতটিকে বিপাকে ফেলেছে। এ পর্যায়ে আবদুল মোনেমের রাইস ব্র্যান তেল বাজারে এল।
জোবায়ের মাহমুদ বলেন, তাঁদের উদ্দেশ্য ক্রেতাদের কাছে স্বাস্থ্যসম্মত তেল পৌঁছে দিয়ে রাইস ব্র্যান তেলের বাজারে সেরা ব্র্যান্ড হওয়া।
এদিকে, বসুন্ধরা গ্রুপ নিয়ে আসছে দৈনিক ২ হাজার টন উৎপাদনক্ষমতার ভোজ্যতেল রিফাইনারি। তাদের রিফাইনারিটি হবে কেরানীগঞ্জে বসুন্ধরার প্রস্তাবিত অর্থনৈতিক অঞ্চলে। সম্প্রতি প্রতিষ্ঠানটি বসুন্ধরা স্পেশাল ইকোনমিক জোন ও ইস্ট ওয়েস্ট স্পেশাল ইকোনমিক জোন নামের দুটি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল বা এসইজেড নির্মাণের প্রাক্-যোগ্যতা লাইসেন্স পেয়েছে।
২০১৩ সালে বসুন্ধরা খাদ্যপণ্যের ব্যবসায় এসেছে। বর্তমানে তাদের বসুন্ধরা ব্র্যান্ডের আটা, ময়দা ও সুজি আছে। শিগগিরই তারা নুডলস, পাস্তা ইত্যাদি হালকা খাবার বাজারে নিয়ে আসবে।
বসুন্ধরা ফুড অ্যান্ড বেভারেজের ব্র্যান্ড ম্যানেজার আশফাক হামিদ প্রথম আলোকে বলেন, তাঁদের ভোজ্যতেল আসবে বসুন্ধরা মাল্টি প্রোডাক্টস নামে একটি কোম্পানির অধীনে। ব্র্যান্ড নাম হবে বসুন্ধরা।
প্ল্যাটিনাম গ্রুপ এখন সানফ্লাওয়ার অয়েল আমদানি করে বাজারে বিক্রি করছে, তবে নিজস্ব ব্র্যান্ড নামে নয়। তারা ইতালির একটি কোম্পানির সঙ্গে বাংলাদেশে এ তেল ব্র্যান্ড নামে বাজারে ছাড়ার জন্য চুক্তি করেছে। বাংলাদেশে বাজার বড় হলে প্ল্যাটিনাম গ্রুপ এ তেল দেশেই পরিশোধন করবে। তাদের নিজস্ব ব্র্যান্ড নামে তেল সানফ্লাওয়ার অয়েল আসবে আগামী মার্চ মাসে। আর অলিভ অয়েল আসবে জুলাই থেকে।
গ্রুপের চেয়ারম্যান নিজাম উদ্দিন চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, দেশে সানফ্লাওয়ার তেলের বিক্রি দিন দিন বাড়ছে। তবে এ তেলের দাম সয়াবিন তেলের দ্বিগুণ। দাম কীভাবে কমিয়ে আনা যায়, সে চেষ্টা চলছে।
উল্লেখ্য, দেশে এখন এক লিটার বোতলজাত সয়াবিন তেল বিক্রি হচ্ছে ৯২ থেকে ৯৮ টাকার মধ্যে। তবে সানফ্লাওয়ার তেলের দাম লিটারপ্রতি ২০০ টাকার বেশি।